ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক

সংস্কার প্রস্তাবের আইনগত ভিত্তির জন্য গণভোট চায় জামায়াত

বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১৮ মে ২০২৫, ১৯: ৩১
আপডেট : ১৮ মে ২০২৫, ২১: ৩৩

সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আলোচনায় যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে অথবা যেসব বিষয় ঐকমত্য হয়নি, কিন্তু তা গুরুত্বপর্ণ- এ সবের আইনগত ভিত্তি বা আইনগত চূড়ান্তের জন্য গণভোট চেয়েছে জামায়াতে ইসলামী।

বিজ্ঞাপন

রোববার জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে অনুষ্ঠিত ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে এই মতামত দেয় দলটি। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত এই বৈঠক চলে। এতে জামায়াতের পক্ষে নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের এবং কমিশনের পক্ষে সহসভাপতি আলী রীয়াজ নেতৃত্ব দেন।

বৈঠক শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, এই বৈঠকে আগের কিছু দ্বিমত পোষণ করা বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি, আবার কিছু বিষয়ে আজও দ্বিমত পোষণ করেছি। ১২৭টি প্রস্তাবের মধ্যে আমরা ১২০টির বেশিতে একমত হয়েছি।

তিনি বলেন, দুই দিনের এই আলোচনা শেষ হলে আবারও দলগুলোকে ডাকবেন ঐকমত্য কমিশন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে প্রধান স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে আলাদা অথবা একসঙ্গে বসবেন তারা।

ডা. তাহের বলেন, আজকের বৈঠকে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, অথবা ঐকমত্য হয়নি কিন্তু তা গুরুত্বপূণ-এমন বিষয়ে কী পদ্ধতিতে আইনগত ভিত্তি হবে তা জানতে চায় কমিশন। আমরা বলেছি, গণভোটের মাধ্যমে এটার আইনি ভিত্তি হবে। সেটা জুলাই চার্টার/ন্যাশনাল চার্টার অথবা বাইরে কিছু থাকলে তা সংযুক্ত করে আমরা গণভোট চাই। কারণ গণভোটের মাধ্যমেই সাধারণ মানুষের মত পাওয়া যায়।

বৈঠকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিষয়ে আমরা দুটি প্রস্তাব দিয়েছি। একটি হলো সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এবং সার্চ কমিটির মাধ্যমে ঠিক করা। আর সার্চ কমিটির সদস্য হবেন-প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় প্রধান এবং প্রধান বিচারপতি। তারাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ঠিক করবেন।

তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি সিনিয়রিটির ভিত্তিতে নিয়োগের কথা বলেছি। যার বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে কোন অভিযোগ না থাকে। জনপ্রশাসনের জন্য স্থায়ী কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছি।

ডা. তাহের বলেন, আমরা কোন দলীয় দৃষ্টিতে নয়, যেটা কল্যাণকর সেটাই সংস্কারের প্রস্তাব করেছি। কিছু প্রস্তাব পরিবর্তন করে নতুন প্রস্তাব দিয়েছি, তারা তাতে একমত হয়েছে।

তিনি বলেন, তারা চার প্রদেশে বিভক্ত করার প্রস্তাব করেছিল, আমারা বলেছি-এতে নিরাপত্তা ঝুঁকির প্রশ্ন থাকবে।

নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে দুই বছরের বেশি সাজাপ্রাপ্ত হলে এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে চার্জশিটভুক্ত হলে প্রার্থী হতে পারবেন না। আমরা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়ে শুধু শাস্তি হলেই অযোগ্য বলেছি। আমরা সংসদ নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতেই চেয়েছি।

এর আগে দুপুরে বৈঠকের বিরতিতে প্রেস ব্রিফিংয়ে ডা. তাহের বলেন, নির্বাচন কমিশনারদের ত্রুটিবিচ্যুতির জন্য চাকরিচ্যুত, এমনকি অবসরে থাকলেও যাতে তাদের শাস্তি হয়, সেই বিধান চায় জামায়াত। এ জন্য প্রয়োজনীয় আইনের সংশোধন করার প্রস্তাব দিয়েছি আমরা।

তিনি বলেন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য কোনো দলের প্রধান যেন একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী পদে না থাকতে পারে সেই সুপারিশ করা হয়েছে। আমরা আজ দুর্নীতি দমন কমিশন সংশ্লিষ্ট সংস্কার প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি, দুদক নিজেই দুর্নীতিগ্রস্ত বলে দেশের মানুষ জানে। তাই দুদকের উপরে ওয়াচডগের মতো একটি টাস্কফোর্স বা কমিশন করা যেতে পারে, যেটি দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করতে পারবে। এই প্রস্তাবের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরাও একমত হয়েছেন।

জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ডা. তাহের বলেন, আমরা এনসিসি গঠনের সঙ্গে নীতিগতভাবে একমত। কিন্তু যে ফরম্যাট দেওয়া হয়েছে, সেখানে আমরা কিছু সংশোধনী এনেছি। মূলত প্রধান বিচারপতি এবং রাষ্ট্রপ্রধানকে তারা বডির ভেতরে প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু আমরা বলেছি তাদের এখান থেকে দূরে রাখতে হবে। কারণ, কোনো জরুরি সংকট তৈরি হলে যাতে মানুষ সমাধানের জন্য তাদের কাছে যেতে পারে।

বৈঠক শুরুর আগে প্রেস ব্রিফিংয়ে জামায়াত নেতা ডা. তাহের বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন একেবারেই সঠিক ও সুষ্ঠু হবে-এরকম পরিস্থিতি দেখার কোন অবকাশ নেই। সম্প্রতি বিভিন্ন স্থানে সংঘাত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এরই মধ্যে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। পাবনায় জামায়াতের নেতা কর্মীদের মারধর করা হয়েছে। এখনো নির্বাচন ঘোষণা করা হয়নি, তার আগেই জায়গা দখল, এলাকা দখল চলছে। তাই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে সরকারের আরো কঠোর হওয়াসহ যা যা করা দরকার করা উচিত। সংস্কার শেষে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিতে হবে।

ডা. তাহের বলেন, নির্বাচন কমিশনের কিছু ভূমিকা আরও প্রশ্নবিদ্ধ মনে হচ্ছে। সরকার যেন সেদিকে খেয়াল রাখে। নির্বাচনের আগেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ঠিক করতে হবে।

তিনি বলেন, নির্বাচনের সুস্পষ্ট টাইমলাইন না থাকায় অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তাই বেশি সময় না নিয়ে সংস্কারের বিষয়ে একটা ঐকমত্যে পৌঁছানো উচিত।

জাতীয় সনদের দিকে দ্রুত অগ্রসর হতে চায় ঐকমত্য কমিশন : বৈঠকের শুরুতে প্রেস ব্রিফিংয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, জাতীয় সনদ তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনা দুয়েক দিনের মধ্যে শেষ করে শিগগিরই দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরু করা হবে।

প্রাথমিক পর্যায়ে যেসব বিষয়ে মতভিন্নতা থাকবে, দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় সেসব বিষয়ে ঐকমত্যের লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

আলী রীয়াজ বলেন, অনেক রক্ত ও প্রাণের বিনিময়ে এই আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যাদের আত্মদানে এই সুযোগ তৈরি হয়েছে তাদের প্রতি আমাদের দায় আছে। এ দায় শুধুমাত্র কমিশনের নয়, বরং বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক শক্তি, সুশীল সমাজ ও সামাজিক শক্তিগুলোরও এ দায় রয়েছে।

এ সময় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. ইফতেখারুজ্জামান, আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।

জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলটির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এ টি এম মা‘ছুম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, ড. হামিদুর রহমান আজাদ, এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, মতিউর রহমান আকন্দ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল, উত্তরের আমির মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, শিশির মোহাম্মদ মনির ও সরকার মোহাম্মদ মহিউদ্দিন।

গত ২০ মার্চ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলোর ওপর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে মতামত জমা দেয় জামায়াতে ইসলামী। পরে ২৬ এপ্রিল দলটির সঙ্গে বৈঠক করে কমিশন। সেদিনের আলোচনার অসমাপ্ত বিষয়গুলো নিয়ে রোববার বর্ধিত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত