আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

নির্বাচন ঘিরে গুজব-অপপ্রচার, চ্যালেঞ্জের মুখে রাজনৈতিক দল

স্টাফ রিপোর্টার
নির্বাচন ঘিরে গুজব-অপপ্রচার, চ্যালেঞ্জের মুখে রাজনৈতিক দল
ছবি : সংগৃহীত

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতার সুযোগে গুজব, অপপ্রচার, মিথ্যা ও বিকৃত তথ্য প্রচার বেড়েই চলেছে। অপপ্রচার দ্রুত ছড়ানো বা ভাইরালের জন্য সহজ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে গণমাধ্যমের ভুয়া ফটোকার্ড এবং এআই প্রযুক্তি।

সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত এসব ভিত্তিহীন তথ্য নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা নির্বাচনি মাঠ থেকে গড়াচ্ছে প্রথম সারির ইলেকট্রনিক মিডিয়ার টকশোতেও। এছাড়া কিছু গণমাধ্যমেও বিকৃত বা খণ্ডিত বক্তব্য-তথ্য প্রকাশ করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে। এতে চরম অস্বস্তিতে পড়ছে জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।

বিজ্ঞাপন

আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে এসব অপ্রচার মোকাবেলাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল ছাড়াও ডলার আয়ের জন্য অনেকে সামাজিক মাধ্যমে ভিত্তিহীন তথ্য ভাইরালে ব্যস্ত। দেশ-বিদেশ বিশেষ করে ভারত থেকেও চলছে অপপ্রচার। এক্ষেত্রে পতিত আওয়ামী গোষ্ঠী ও তাদের দোসররা সম্পৃক্ত বলে জানা গেছে।

সূত্রমতে, দেশের রাজনৈতিক দলের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির সম্পর্কে অপপ্রচার ও ভুয়া তথ্য বেশি ছড়ানো হচ্ছে। এতে সংশ্লিষ্টদের মাঝে দ্বন্দ্ব ও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে। দলগুলোর পক্ষ থেকে একের পর এক বক্তব্য-বিবৃতিতে এসব অপপ্রচার সম্পর্কে সতর্ক ও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে। এছাড়া বিএনপি, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে কম-বেশি অপপ্রচার বা ভুয়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছে বলে জানা গেছে।

সম্প্রতি ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভুয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডাকসুর ভিপি ও ডিএমপি কমিশনার সম্পর্কে বক্তব্য দিয়ে বেশ বিব্রত হন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। পরে তিনি ওই বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তবে তার আগেই ওই বক্তব্য নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মাঝে ব্যাপক চাপা ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

এর আগে সামাজিক মাধ্যমে এমনকি কিছু গণমাধ্যমের অনলাইনে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, জামায়াতের প্রার্থী হচ্ছেন মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারী। পরে আবার ছড়ানো হয়, প্রার্থী হবেন না আজহারী। এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার পর দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। একইভাবে জামায়াতের আমির থেকে শুরু করে শীর্ষ অনেক নেতা এবং দলের নামে নানা বিভ্রান্তিকর ও ভিত্তিহীন খবর প্রকাশ করা হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে। সেই খবরের সূত্র ধরে গণমাধ্যম এমনকি টিভির টকশোতেও আলোচনা ছড়িয়ে পড়ছে।

এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, নির্বাচনের আগে অপপ্রচার একটা সংস্কৃতি হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে এআই প্রযুক্তিরও অপব্যবহার হচ্ছে। এতে আমরা নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছি। এ বিষয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের বড় দায়িত্ব হলো, অপপ্রচারের পথ বন্ধ করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা। রাজনৈতিক দলগুলোরও জবাবদিহি থাকা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

তিনি বলেন, আমরা ইতিবাচক কাজে বিশ্বাসী। আইনি সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেই অপপ্রচার মোকাবিলা নিয়ে আমাদের নির্বাচনি কমিটি কাজ করছে। এক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা কামনা করছি, বিশেষ করে গণমাধ্যমের বড় দায়িত্ব রয়েছে।

অ্যাডভোকেট জুবায়ের আরো বলেন, বড় উদ্বেগের বিষয় হলো পতিত আওয়ামী লীগের লোকেরা অনেক সাইট থেকে ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছে। তারা সরকারের থাকতে যেভাবে গুজব ছড়াত, এখনো সরকার ও সমাজের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এটা মোকাবিলায় রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যের পাশাপাশি সরকারকে বড় দায়িত্ব পালন করতে হবে। অপপ্রচারে জড়িতদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তা না হলে আগামী নির্বাচন অনেক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে।

গুজব ও অপপ্রচারের বিস্তৃতি সম্পর্কে ফ্যাক্ট চেক বিশেষজ্ঞ এবং ডিজিটাল অনুসন্ধানমূলক সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ডিসেন্ট’ সম্পাদক কদরুদ্দীন শিশির আমার দেশকে জানান, সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার, গুজব বা ভুয়া তথ্য প্রচার বাড়তে শুরু করেছে। প্রধানত বিএনপি-জামায়াতের পক্ষের লোকেরা নামে-বেনামে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে গুজব ও অপপ্রচার ছড়াচ্ছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সবচেয়ে বেশি গুজব প্রচার করছে আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসররা। দেশের পাশাপাশি বিদেশ থেকে বিশেষ করে ভারত থেকে এই অপপ্রচার বেশি হচ্ছে। এতে বিএনপি-জামায়াত সবাই ভুক্তভোগী।

আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে অপপ্রচার আরো বাড়তে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, স্থানীয় নেতাকর্মীরা প্রতিপক্ষ দল ও প্রার্থীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। অনেক সময় গণমাধ্যমের ভুয়া ফটোকার্ড ব্যবহার করা হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে কদরুদ্দীন শিশির বলেন, সাধারণ সামাজিক মাধ্যমের খবরে বিশ্বাস না করে গণমাধ্যমগুলোর নিজস্ব ওয়েবসাইট বা তাদের সামাজিক মাধ্যম ফলো করা উচিত। তাছাড়া ভিত্তিহীন তথ্য ভাইরাল করে ডলার আয়ের মানসিকতা থেকেও বেরিয়ে আসা দরকার।

সম্প্রতি ‘দ্য ডিসেন্টে’ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন গণমাধ্যমের ফটোকার্ড নকল করে প্রধান উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের নামে ভুয়া বক্তব্য প্রচার করা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। মূলধারার গণমাধ্যমের ডিজাইন ও লোগো সম্বলিত ফটোকার্ড ব্যবহার করে এসব ভুয়া উক্তি ছড়ানোর ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা যেমন বিভ্রান্ত হচ্ছেন, তেমনি যাদের নামে এসব ভুয়া বক্তব্য ছড়ানো হচ্ছে তারাও বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন।

এছাড়া বিভিন্ন টকশোতেও দেখা গেছে সাংবাদিক এবং বিশ্লেষকদের কেউ কেউ ভুয়া খবরকে রেফারেন্স হিসেবেও ব্যবহার করছেন। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক নেতাদের ভুয়া উক্তি প্রচারের প্রবণতা বাড়ছে।

গত কয়েক মাসে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নামে ছড়ানো অন্তত ২৫টি আলোচিত ভুয়া উক্তি তুলে ধরা হয় ওই প্রতিবেদনে।

এ প্রসঙ্গে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় প্রচার ও দাওয়াহ সম্পাদক শেখ ফজলুল করীম মারুফ বলেন, মিথ্যা তথ্য, ভুল তথ্য, অপতথ্য এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খণ্ডিত তথ্যের ব্যাপকতা আগামী নির্বাচনের আরেকটি চ্যালেঞ্জ। অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে কোনো ধরনের সম্পাদনা ছাড়াই তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ মানুষের কাছে থাকছে। ফলে মিথ্যা, ভুল, অপতথ্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খণ্ডিত তথ্যে সয়লাব হয়ে আছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, অনেক শিক্ষিত ও জানাশোনা মানুষও এসব বিশ্বাস করছে এবং নিজ উদ্যোগে তা ছড়িয়েও দিচ্ছে।

তিনি বলেন, সম্প্রতি মিথ্যা ও অপতথ্য সম্বলিত ফটোকার্ড ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মূলধারার সংবাদমাধ্যমের ফটোকার্ডের ডিজাইন ও লোগো ব্যবহার করে ভুল ও অপতথ্য পরিবেশ করা হচ্ছে আবার কোনো ক্ষেত্রে ডিজাইন ঠিক রেখে লোগো ও নামে সামান্য পরিবর্তন করে অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে। খুব সতর্ক না হলে সহজে বোঝা যায় না।

তিনি আরো বলেন, যেমন কয়েক দিন আগে ‘ইসলামী আন্দোলন জামায়াতের কাছে দুই শ আসন চেয়েছে’—মর্মে একটা ফটোকার্ড কিছু মূলধারার অনলাইনে প্রচারিত হয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, কারো কাছে কোনো সূত্র নাই। ভূঁইফোড় একটা অনলাইন পোর্টালের বরাতে তারা এটা পরিবেশন করেছে। দেশের আরেকটি আলোচিত সংবাদমাধ্যমের অনলাইনে ইসলামী আন্দোলনের আমিরের বক্তব্যকে কাটছাট করে সম্পূর্ণ ভিন্ন বার্তা সম্বলিত করে প্রকাশ করা হয়েছে। এগুলো আগামী নির্বাচনের জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জ। যারা এসব অপতথ্য ছড়ায় তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি দাবি জানান তিনি।

অপপ্রচার চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক আতিক মুজাহিদ বলেন, মিথ্যা অপপ্রচার ভয়াবহ আকারে চলছে। এটা এক ধরনের নৈতিক অবক্ষয়। সামনে আরো বড় আকারে এটা প্রচার হতে পারে। অনেকে তথ্য প্রস্তুত করে রাখছে, নির্বাচনের আগে তারা সেগুলো ছড়িয়ে দেবে। কীভাবে এসব অপপ্রচার নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সে বিষয়ে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে।

তিনি বলেন, সব প্রার্থীর পক্ষ থেকে একটি বিষয়ে স্বাক্ষর করা দরকার যে, কেউ যেন ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো অপপ্রচার না চালায়। উদ্দেশ্যমূলকভাবে কেউ কিছু করলে সেটা আলাদা বিষয়। সরকারকে এখনই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। প্রয়োজনে মসজিদে-মন্দিরে চিঠি দিয়ে অপপ্রচার বিষয়ে সতর্ক করার আহ্বান জানানো যেতে পারে।

সাম্প্রতিক অপপ্রচার প্রসঙ্গে গত সোমবার এক আলোচনা সভায় জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের বক্তব্য ভালো লাগলে তা হুবহু তুলে ধরুন। আর ভালো না লাগলে পুরোটাই বাদ দিয়ে দিন। তবে বক্তব্যের খণ্ডিত অংশ বা বিকৃতভাবে প্রচার করে জাতিকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলবেন না।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন