সম্প্রতি কুমিল্লায় মা-মেয়ের ওপর সংঘটিত মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে আলোচিত হয়েছে। এটি আমাদের সমাজে ধর্মের নামে চলা ভণ্ডামি, অজ্ঞতা ও ইসলামের বিধান সম্পর্কে চরম অবহেলার করুণ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে। এক শিক্ষিত মা ও তার বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়ে কবিরাজের নামে এক ভণ্ডের হাতে নিজেদের সমর্পণ করেছিলেন জিনের আছর থেকে মুক্তি পেতে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই ভণ্ডই হয়ে ওঠে তাদের মৃত্যুদূত।
পুরুষ ডাক্তারের চেম্বারে নারীদের শ্লীলতাহানির ঘটনা নতুন নয়। ডাক্তারি না পড়ে বা সামান্য পড়াশোনা করে ডাক্তার সেজে প্রতারণা করার ঘটনাও পুরোনো। কবিরাজের বেশ ধরে মানুষকে ঠকানোর কাহিনিও দীর্ঘদিনের। আর এর সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে রুকইয়ার নামে নতুন ভণ্ডামি। রুকইয়া মূলত ঝাড়ফুঁককেই বলে, যদি সেই ঝাড়ফুঁক কোরআন-হাদিসের নির্দেশিত পন্থায় হয়, যেখানে শিরক, কুসংস্কার, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বা শ্লীলতাহানি থাকে না। যিনি রুকইয়া করেন, আরবিতে তাকে বলা হয় রাকি। কোরআন-হাদিসনির্ভর এ চিকিৎসাপদ্ধতি অবলম্বন করে অনেকেই উপকৃত হচ্ছিলেন। এটি দেখে কিছু সুযোগসন্ধানী রুকইয়াকে বাণিজ্যিক রূপ দেয় এবং রুকইয়ার নামে কালো জাদু, যাবতীয় কুসংস্কার ও নারীদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশার পথ তৈরি করে। এরই বলি হলেন আলোচিত মা ও মেয়ে। প্রকৃত ডাক্তার, কবিরাজ কিংবা রাকি কখনোই শাস্ত্রের বাইরে গিয়ে কাজ করেন না, প্রতারণার আশ্রয় নেন না। কিন্তু যারা প্রকৃত ডাক্তার, কবিরাজ বা রাকি, তাদের ক্ষেত্রেও বর্তমানে বিভিন্ন রকমের বাড়াবাড়ি দেখা যাচ্ছে।
আমাদের দেশের মানুষ এখনো প্রথমে ডাক্তারের কাছেই যান। কিন্তু প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় সব টেস্ট শেষে যখন রোগী কোনো রাকির শরণাপন্ন হতে চান, তখন অনেক ডাক্তার জিনের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে বসেন। অথচ এটি প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালার একটি সৃষ্টিকে অস্বীকার করার শামিল। আবার অন্যদিকে কিছু রাকি আছেন, যারা যেকোনো রোগীর ভেতরেই জিনের প্রভাব খুঁজে পান। অথচ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গেই একটি শয়তান নির্ধারিত আছে।’ সাহাবিরা প্রশ্ন করলেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনার সঙ্গেও কি?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার সঙ্গেও। কিন্তু তার মোকাবিলায় আল্লাহ আমাকে সহযোগিতা করেছেন। এখন আমি তার ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ। এখন সে আমাকে ভালো কাজ ব্যতীত কখনো অন্য কিছুর নির্দেশ দেয় না।’ (মুসলিম: ৬৮৪৮)। এ হাদিসের দাবি হলো, নিজের ব্যক্তিগত সৎ আমলের মাধ্যমে ভেতরের দুষ্টুটাকেও সৎ বানিয়ে তোলা।
নারীর পর্দা ও নিরাপত্তা
ইসলামে নারীর সম্মান, মর্যাদা ও নিরাপত্তার জন্য পর্দাকে একটি অপরিহার্য বিধান হিসেবে রাখা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেছেন, ‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদের ও মেয়েদের এবং মুমিনদের স্ত্রীদের বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের ওপর টেনে নেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে। ফলে তাদের উত্ত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ (সুরা আহজাব : ৫৯)
আরেক আয়াতে বলা হয়েছে, ‘নারীরা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে যা সাধারণত প্রকাশ পায়, তা ছাড়া তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশকে আবৃত করে রাখে।’ (সুরা নূর: ৩১)। এই আয়াতগুলো স্পষ্ট করে দেয়, নারীর ইজ্জত রক্ষা, সমাজে অপমান এড়ানো এবং অপকর্ম থেকে দূরে থাকার জন্য পর্দা কতটা জরুরি।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও পবিত্র ব্যক্তি আর কে আছেন? অথচ তিনি পর্যন্ত নারীদের ঈমানের অঙ্গীকার (বাইআত) নিতেন মৌখিকভাবে। তিনি কখনোই কোনো নারীর হাতে হাত রেখে বাইআত করেননি। নিজ কর্তৃত্বাধীন মহিলা ছাড়া রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাত অন্য কোনো মহিলার হাত স্পর্শ করেনি। (তিরমিজি: ৩৩০৬)।
এ থেকে বোঝা যায়, ইসলামে নারী-পুরুষ-সম্পর্কিত সীমারেখা অত্যন্ত কঠোরভাবে সংরক্ষিত, এমনকি সবচেয়ে পবিত্র পরিবেশেও শারীরিক সংস্পর্শকে অনুমোদন দেওয়া হয়নি। তাহলে আজ যারা রুকইয়ার নামে নারীদের শরীরে হাত দেয় বা নির্জনে সাক্ষাৎ করে, তারা স্পষ্টতই হারাম কাজে লিপ্ত। তাদের ওপর সামাজিক চাপ আরোপ করা এবং তাদের কাছ থেকে দূরে থাকা অবশ্য কর্তব্য।
সঠিক উৎস থেকে ইসলামের জ্ঞান আহরণের গুরুত্ব
ধর্মের নামে ভণ্ডামি থেকে বাঁচতে হলে কোরআন-হাদিসের আলোকে সঠিক জ্ঞান অর্জন অপরিহার্য। কোরআনের প্রথম বাণীই তো হলো—‘পড়ো’। মহান আল্লাহ বলেন, ‘পড়ো তোমার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা আলাক: ১-২)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন।’ (বুখারি: ৭১)।
অতএব, ইসলামী জ্ঞান কেবল বিশ্বস্ত আলেম এবং সহিহ সূত্র থেকেই গ্রহণ করতে হবে। মিথ্যা কবিরাজ, অশিক্ষিত পীর বা অযোগ্য রাকিদের কাছে ধর্মের ব্যাখ্যা শোনা বা চিকিৎসা নেওয়া কখনোই নিরাপদ নয়।
রুকইয়ার নিরাপদ পদ্ধতি
রুকইয়ার সবচেয়ে নিরাপদ ও কার্যকর পদ্ধতি হলো সেলফ রুকইয়া বা নিজেই নিজের রুকইয়া করা। যদি অসুস্থতা গুরুতর হয়, তবে পরিবারের নিকটজনকেও অন্তর্ভুক্ত করা যায়। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন আপন বিছানায় আসতেন, তখন তিনি নিজের উভয় হাতের তালুতে সুরা ইখলাস এবং মু‘আওব্বিযাতাইন অর্থাৎ সুরা ফালাক ও সুরা নাস পড়ে ফুঁ দিতেন। তারপর উভয় তালু দ্বারা আপন চেহারা ও দু-হাত শরীরের যত দূর পর্যন্ত পৌঁছায় ততদূর পর্যন্ত মাসাহ করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন অসুস্থ হন তখন তিনি আমাকে অনুরূপ করার নির্দেশ দিতেন।’ (বুখারি: ৫৩৩৭)।
সকাল-সন্ধ্যা ও রাতে ঘুমের আগে নিয়মিত সুন্নাত দোয়াগুলো, কোরআনের বিখ্যাত ৩৩ আয়াতের মঞ্জিল, অন্তত সুরা ফাতিহা, আয়াতুল কুরসি এবং চার কুল (সুরা কাফিরুন, সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক ও সুরা নাস) পাঠ করে নিজের শরীরে ফুঁ দেওয়া খুবই শক্তিশালী ও কার্যকর আমল।
অতএব প্রকৃত রুকইয়া হলো কোরআন-হাদিসনির্ভর চিকিৎসা, যেখানে শিরক, কুসংস্কার, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বা শ্লীলতাহানি নেই। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আজকের সমাজে রুকইয়ার নামে ভণ্ডদের বাণিজ্য ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। কবিরাজ, পীর কিংবা রাকি নামধারীরা মানুষের দুর্বলতা, অসহায়ত্ব ও ধর্মীয় অজ্ঞতাকে পুঁজি করে প্রতারণা ও শারীরিক-আধ্যাত্মিক শোষণ চালাচ্ছে।
যদি সেই মা ও মেয়ে সহজ ও নিরাপদ সুন্নতি আমলগুলো আঁকড়ে ধরতেন, অথবা প্রয়োজনে একজন যোগ্য, বিশ্বস্ত ও সৎ আলেম বা নারী রাকির কাছে যেতেন, তবে হয়তো এই করুণ ঘটনা ঘটত না। বলাবাহুল্য, আমরা সরকারের কাছে ওই ভণ্ডের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করি।
লেখক : সিনিয়র পেশ ইমাম ও খতিব, বুয়েট সেন্ট্রাল মসজিদ

