আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিধানে ইসলাম

মুফতি রাশেদুর রহমান

ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিধানে ইসলাম

নিরাপত্তা মহান আল্লাহতায়ালার এক বড় নিয়ামত। নিরাপত্তা থাকলে জীবনের চাকা গতিশীল থাকে, থাকে সবকিছু স্থিতিশীল। কারো হাতে হয়তো টাকাপয়সা নেই, জীবনমান তেমন উন্নত নয়, দালানকোঠা ও বসতবাড়ি অভিজাত নয়; কিন্তু দুবেলা খাবার খেয়ে নিরাপদে জীবন কাটানোর সুযোগ আছে-তাহলে এর চেয়ে বড় সুখ আর কী আছে! রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যার পরিজন নিয়ে নিরাপদে সকাল হয়, তার শরীর যদি সুস্থ থাকে আর তার কাছে যদি থাকে ওইদিনের ক্ষুণ্ণিবৃত্তির মতো খাবার, তবে তার জন্য সারা পৃথিবীই যেন একত্র হয়ে গেল।’ (তিরমিজি : ২৩৪৬)

বিজ্ঞাপন

নিরাপত্তা এবং নিরাপদ নগরীর জন্য ইবরাহিম (আ.) বিশেষভাবে দোয়া করেছিলেন, মক্কা নগরীতে যখন তিনি কলিজার টুকরো ইসমাইলকে এবং প্রাণপ্রিয় স্ত্রী হাজেরকে রেখে আসেন, তখন তিনি ফরিয়াদ করেছিলেন, ‘হে আমার রব, একে তুমি নিরাপদ নগরী বানাও এবং এর অধিবাসীদের দান করো যাবতীয় ফলমূল।’ (সুরা বাকারা : ১২৬)

মক্কাবাসীর প্রতি আল্লাহতায়ালার যতগুলো নিয়ামতÑএর মধ্যে অন্যতম ছিল নিরাপদ স্থানে তাদের বসতিদান। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তারা কি দেখে না যে, আমি হারামকে (মক্কা) করেছি নিরাপদ স্থান অথচ তাদের চতুষ্পার্শ্ব থেকে মানুষকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। তবে তারা কি মিথ্যাতেই বিশ্বাস করবে আর আল্লাহর অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে?’ (সুরা আনকাবুত : ৬৭)

মহান আল্লাহর দেওয়া এই নিরাপত্তা লাভের পর মানুষের কর্তব্য হলো সেই মহান আল্লাহর শোকরগুজার হওয়া এবং তাঁর ইবাদত-বন্দেগিতে লেগে থাকা। ইরশাদ হয়েছে, ‘অতএব তারা যেন এ গৃহের রবের ইবাদত করে, যিনি ক্ষুধায় তাদের আহার দিয়েছেন আর ভয় থেকে তাদের নিরাপদ করেছেন।’ (সুরা কুরাইশ : ৪)

কিন্তু মানুষের গুনাহ ও কুফর এবং জুলুম ও সীমালঙ্ঘনের কারণে আল্লাহতায়ালা কখনো কখনো নিরাপত্তার এই নিয়ামত ছিনিয়ে নেন। তখন জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আল্লাহ উপমা পেশ করছেন, একটি জনপদ, যা ছিল নিরাপদ ও শান্ত। সবদিক থেকে তার রিজিক তাতে বিপুলভাবে আসত। অতঃপর সে (জনপদ) আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকার করল। তখন তারা যা করত, তার কারণে আল্লাহ তাকে ক্ষুধা ও ভয়ের পোশাক পরালেন।’ (সুরা নাহল : ১১২)

দুর্বিষহ জীবন থেকে বাঁচা সম্ভব হয় এবং স্থিতিশীল ও নিরাপদ জীবন লাভ হয় ঈমান ও ইসলামের মাধ্যমে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে জুলুম (শিরক) দ্বারা কলুষিত করেনি, নিরাপত্তা তাদেরই জন্য এবং তারাই হেদায়েতপ্রাপ্ত।’ (সুরা আনআম : ৮২)

ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যা মানুষকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিরাপত্তা দান করেছে। মানুষকে দিয়েছে জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু এবং অন্যসব কিছুর নিরাপত্তা। কোরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করে, সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে এবং যে কারো জীবন রক্ষা করে, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করে। তাদের কাছে আমার পয়গম্বররা প্রকাশ্য নিদর্শনাবলি নিয়ে এসেছেন। বস্তুত এরপরও তাদের অনেক লোক পৃথিবীতে সীমাতিক্রম করে।’ (সুরা মায়েদা : ৩২)

অন্যদিকে যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করবে, দুনিয়ায় তার শাস্তির পাশাপাশি আখিরাতের শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে মুসলমানকে হত্যা করে, তার শাস্তি জাহান্নাম, তাতেই সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্য ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।’ (সুরা নিসা : ৯৩)

ইসলামে শুধু মুসলমানের নিরাপত্তাই নিশ্চিত করা হয়নি, বরং মুসলিম দেশে মুসলমানদের অধীনে বসবাসরত কাফের-মুশরিকদের প্রাণের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে তাগিদ করা হয়েছে। ইসলামের নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম নাগরিকের ওপর জুলুম করে বা তার কোনো ক্ষতি করে কিংবা তার ওপর সাধ্যাতীত কোনো বিষয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয় অথবা তার সন্তুষ্টি ছাড়া কোনো কিছু ছিনিয়ে নেয়, কিয়ামতের দিন আমি তার বিরুদ্ধে অমুসলিমের পক্ষে প্রতিবাদকারী হব।’ (আবু দাউদ : ৩০৫১)

রহমতের নবী (সা.) এ কথাও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করল, সে জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুঘ্রাণ ৪০ বছরের দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়।’ (বুখারি : ৩১৬৬)

মানুষের সহায়-সম্পত্তি এবং তাদের ইজ্জত-সম্মানের সুরক্ষা প্রসঙ্গে নবীজি (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেছিলেন, ‘নিশ্চয় তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ, তোমাদের সম্ভ্রম পরস্পরের জন্য হারাম, যেমন আজকের এই দিন ও এ শহর হারাম।’ (তিরমিজি : ২১৫৯)

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করবে না, তবে পরস্পরের সম্মতিতে ব্যবসা করা বৈধ, তোমরা একে অন্যকে হত্যা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু। আর কেউ সীমালঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে এমন কাজ করলে তাকে অগ্নিদগ্ধ করব, তা আল্লাহর পক্ষে সহজ।’ (সুরা নিসা : ৩০) নবীজি (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কোনো মুসলমানের সম্পদ তার সম্মতি ছাড়া গ্রহণ করা বৈধ নয়।’ (দাইলামি : ৭৬৩৫)

বস্তুত পরিপূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ এবং ইসলামের যাবতীয় অনুশাসন পালনের মাধ্যমেই সম্ভব সমাজ-সংসার থেকে ভয়ভীতি দূর করে নিরাপত্তার জীবন প্রতিষ্ঠা করা। মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের ওয়াদা দিয়েছেন, তাদের অবশ্যই পৃথিবীতে শাসন কর্তৃত্ব দান করবেন। যেমন : তিনি শাসন কর্তৃত্বদান করেছেন তাদের পূর্ববর্তীদের এবং তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের ধর্মকে, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের ভয়ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই তাদের শান্তি দান করবেন। তারা আমার এবাদত করবে এবং আমার সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না। এরপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে, তারাই অবাধ্য।’ (সুরা নুর : ৫৫)

ইসলামের দৃষ্টিতে একটি রাষ্ট্রে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা সবার আগে। কিয়ামতের দিন রাষ্ট্রের প্রতিটি দায়িত্বশীলকে মানুষের জীবনের নিরাপত্তার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। রাষ্ট্রপ্রধানের প্রধান দায়িত্ব হলো, জনগণের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিয়ামতের দিন প্রথম বিচার হবে নর হত্যাকারীদের। যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করে পৃথিবীতে সে নিজের বেঁচে থাকার অধিকার হারিয়ে ফেলে।

ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রের পাশাপাশি ব্যক্তিরও দায়িত্ব আছে। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা নবীজির (সা.) শেখানো অনেক সুন্দর সুন্দর দোয়া রয়েছে, যেগুলো পড়লে আল্লাহতায়ালা তাকে বিশেষ নিরাপত্তা দেন। সেগুলো পাঠ করতে হবে। হাদিসে একাকী সফর করতে নিষেধ করা হয়েছে। শত্রু সম্পর্কে সদা-সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। এসবও খেয়াল রাখতে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে শত্রু থেকে হেফাজত করুন।

লেখক : সিনিয়র পেশ ইমাম, বুয়েট কেন্দ্রীয় মসজিদ

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর

খুঁজুন