আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা

আবু সুফিয়ান

ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা

বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার সম্প্রতি সরকারি অনুষ্ঠানে মুসলিম নারী চিকিৎসকের হিজাব প্রকাশ্যে টেনে খুলে ফেলে ভারতীয় সরকারের ক্ষমতা কাঠামোর প্রচণ্ড ইসলামবিদ্বেষী চরিত্রের প্রমাণ দিয়েছেন। হিজাব পরিহিত নবনিযুক্ত ওই চিকিৎসক তার নিয়োগপত্র নিতে এসেছিলেন। পরে ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

একজন মুখ্যমন্ত্রীর এমন ঘৃণার প্রকাশ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ২০১৫ থেকে ২০২৫Ñএই এক দশকে ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ধারাবাহিক ও কাঠামোগত রূপ নিয়েছে। সরকারিভাবে ধর্মভিত্তিক নিহতের পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যান প্রকাশ না করা হলেও সংবাদমাধ্যম, মানবাধিকার সংগঠন ও স্বাধীন ট্র্যাকারগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করলে একটি উদ্বেগজনক চিত্র স্পষ্ট হয়—সহিংসতার ধরন বদলেছে; কিন্তু লক্ষ্যবস্তু হিসেবে মুসলমানরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।

বিজ্ঞাপন

ভারতের জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি) কিংবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডেটায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সামগ্রিক সংখ্যা থাকলেও ধর্মভিত্তিক নিহতের আলাদা হিসাব নিয়মিতভাবে প্রকাশ করা হয় না। ফলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সহিংসতার প্রকৃত মাত্রা সরকারি পরিসংখ্যানে অস্পষ্টই থেকে যায়। প্রশ্ন ওঠে—এটি কি কেবল প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা, নাকি রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাব? কারণ, ধর্মভিত্তিক ডেটা প্রকাশ করলে স্পষ্ট হয়ে যাবে কারা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।

প্রত্যেক নিহতের গল্পে মানুষের জীবন, পরিবার, স্বপ্ন ও নির্যাতনের মুহূর্ত লুকিয়ে থাকে। দাদরিতে মোহাম্মদ আখলাক, আলওয়ারে পেহলু খান, ঝাড়খণ্ডে তাবরেজ আনসারি—তারা কেবল নাম নন; তারা এমন প্রতীক, যাদের পিটিয়ে মারা যায় এবং পরে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কলকাঠিতে বিচার মেলে না।

ভারতে গত এক দশকে মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতার যে ধারা লক্ষ করা গেছে, তা আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখা যায় না। ২০১৫ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত অন্তত ৭০-৮০ জন মুসলমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন। এদের বড় অংশ হিন্দুত্ববাদীদের সংঘটিত হামলার শিকার। দেশটির সরকারি পরিসংখ্যান এই সংখ্যা প্রকাশ করে না; তবে সংবাদমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা এবং স্বাধীন গবেষণার রিপোর্টগুলোর সমন্বয়ে এ বিষয়ে ভয়ংকর একটি চিত্র দেখা যায়। অবশ্য এই সংখ্যাও চূড়ান্ত নয়। বরং এটি রাষ্ট্রের লুকোচুরি, প্রশাসনিক নীরবতা আর বিচারহীনতার এক নির্মম সংস্কৃতি।

সহিংসতার যত প্যাটার্ন

এক দশকের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মুসলমানদের ওপর সহিংসতার কিছু সুনির্দিষ্ট প্যাটার্ন রয়েছে। হামলার প্রধান কারণগুলো সাধারণত গরু জবাই বা গরুর মাংস পরিবহনের অভিযোগ, বিতর্কিত ‘লাভ জিহাদ’ তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম ও হিন্দু তরুণীদের সম্পর্ক, ধর্ম অবমাননা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো অপতথ্য। এছাড়া ধর্মীয় শোভাযাত্রার রুট বা সময় নিয়ে উত্তেজনা, মুসলিম ব্যবসায়ীদের বয়কট, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিবিদদের উসকানিমূলক বক্তব্য ও সামাজিকমাধ্যমে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য সহিংসতা উসকে দেয়। কিছু ক্ষেত্রে মুসলিম সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে আইনের অপপ্রয়োগের অভিযোগও উঠেছে।

পুলিশের দেরিতে হস্তক্ষেপ বা পক্ষপাত, দীর্ঘসূত্র বিচার ও রাজনৈতিক আশ্রয়ের কারণে অভিযুক্তরা প্রায়ই দায়মুক্ত থাকে। ২০১৫-২০১৯ সালের মধ্যে গণপিটুনি নতুনভাবে প্রথাগত প্যাটার্নে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ সময়ে প্রায়ই গুজব ছড়ানো, ধর্মীয় পরিচয় শনাক্তকরণ, গণপিটুনিতে হত্যা ও রাজনৈতিক আশ্রয় বা আইনি ছাড়ের পুনরাবৃত্তি দেখা গেছে।

আক্রান্তদের অধিকাংশই সাধারণ মুসলমান—বাজারে কাজ করা বা গ্রামের পথে চলাফেরা করা মানুষ। তাদের মৃত্যু কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়; এটি পুরো মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর ভয়, অসম্মান ও নিরাপত্তাহীনতার প্রতীক।

এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক কাশ্মিরী রাজনৈতিক কর্মী ও ওয়ার্ল্ড কাশ্মীর ফ্রিডম মুভমেন্টের সভাপতি এবং দ্য জাস্টিস ফাউন্ডেশন কাশ্মীর ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক ডা. মুজ্জাম্মিল আইয়ুব ঠাকুর আমার দেশকে বলেন, রাষ্ট্রীয় মদতে সংঘটিত, সমর্থিত ও ন্যায্যতা দেওয়া সহিংসতা বোঝার জন্য আমাদের পর্দার আড়ালে তাকাতে হবে, যেখানে দেখা যায় বিজেপির মূল সংগঠন আরএসএস সুতো টানছে এবং এক ভয়ংকর গণহত্যামূলক প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করছে, যাকে কেবল ‘গণহত্যা’ বলেই বর্ণনা করা যায়। আরএসএসের শিকড় নাৎসি জার্মানিতে প্রোথিত। তাদের আদর্শ, দর্শন ও কৌশল অনুকরণ করে; এমনকি তাদের স্যালুট ও পোশাকও নকল করা হয়েছে। নাৎসি ফ্যাসিবাদ অবসানের পর আরএসএসের কর্মসূচি নতুন এক আধ্যাত্মিক অংশীদার খুঁজে পায় জায়নবাদের মধ্যে, যেখানে সংখ্যালঘুদের ক্ষতির বিনিময়ে একই সম্প্রসারণবাদী আদর্শ ভাগাভাগি করা হয়।

গুজব ও কয়েকটি প্রাণহানি

২০১৫ সালে ভারতের উত্তরপ্রদেশের দাদরি শহরে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে। ৫০ বছর বয়সি মুসলিম কৃষক আখলাক একটি ভিত্তিহীন গুজবের শিকার হন। স্থানীয় কিছু কট্টরপন্থি হিন্দুত্ববাদী মানুষ আখলাকের বিরুদ্ধে গরুর মাংস-সংক্রান্ত অভিযোগ ছড়ায়। গুজবটি সামাজিকমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। কয়েকশ মানুষ তার বাড়িতে প্রবেশ করে তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। পুলিশ ও প্রশাসন ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই আখলাক নিহত হন। পরে তার পরিবার নিরাপত্তাহীনতার কারণে শহর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে ঘটে এক দশকের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। কয়েক দিনে অন্তত ৫৩ জন নিহত হন, যার দুই-তৃতীয়াংশই মুসলিম। সংঘর্ষের প্রথম দিন থেকেই ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট শুরু হয়। মুসলিম সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ও দোকানপাট লুটপাটের শিকার হয়। শত শত পরিবার রাতারাতি নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। আহতের সংখ্যা শতাধিক; শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে ভয় ও দীর্ঘস্থায়ী ট্রমার প্রভাব লক্ষ করা যায়।

ঝাড়খণ্ডে তাবরেজ আনসারি নামে একজন মুসলিম যুবকও গুজবের শিকার হন। স্থানীয়রা মিথ্যা অভিযোগ ছড়িয়ে তাকে নির্যাতন করে। ধারালো অস্ত্র ও লাঠির আঘাতে তাবরেজ গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তার পরিবার ও স্থানীয় মুসলমানরা নিরাপত্তাহীন অবস্থায় দিন কাটাতে বাধ্য হন।

বিভিন্ন স্বাধীন সংস্থা ও ট্র্যাকার ২০২৪-২৫ সালেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে হিন্দু উগ্র হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের হাতে অন্তত ২০ মুসলিম নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে। সরকারি ডেটায় ধর্মভিত্তিক নিহতের সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। প্রকাশিত সংখ্যার অদৃশ্যতার কারণে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর প্রায়ই সহিংসতার চক্র চলতে থাকে।

ভয় কমলেও চ্যালেঞ্জ অব্যাহত

করোনা-পরবর্তী ২০২১-২৩ সালে ধর্মীয় শোভাযাত্রা, মিছিল ও স্থানীয় উত্তেজনার কারণে বিচ্ছিন্ন সহিংসতা কিছুটা কমলেও থেমে যায়নি। নিহতের সংখ্যা কমলেও এ ধরনের ঘটনায় মুসলমান সম্প্রদায় প্রধান ভুক্তভোগী ছিল। অভিযুক্তরা দীর্ঘ সময় বিচার কার্যক্রমের বাইরে থাকে বা রাজনৈতিক আশ্রয় পায়; ফলে স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর ভয় ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে।

২০২৪-২৫ সালে লক্ষ্যভিত্তিক সহিংসতা আবার বেড়েছে। বিভিন্ন রাজ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে গুজব, হেট স্পিচ ও সামাজিক-রাজনৈতিক ইস্যুকে কেন্দ্র করে ছোট কিন্তু প্রাণঘাতী হামলার ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের দেরি বা পক্ষপাত, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং অভিযুক্তদের রাজনৈতিক আশ্রয়ে পরিস্থিতি আরো জটিল করেছে। স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়েছে, মুসলমানদের নিরাপত্তা ও অধিকার কমেছে।

স্বাধীন গবেষণা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, ২০২৪ সালে দাঙ্গা ও গণপিটুনির ফলে অন্তত ২৪ জন নিহত হন, যার মধ্যে প্রায় ১৮ জন মুসলিম। বড় দাঙ্গা না হলেও লক্ষ্যভিত্তিক সহিংসতা জোরালো হয়েছে। এক বছরের মধ্যে ৫৯টি সহিংস ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে। অনেক ঘটনাই ঘটেছে ধর্মীয় উৎসব, প্রক্রিয়া বা মিছিলকে কেন্দ্র করে।

২০২৫ সালের প্রথম কয়েক মাসেও একাধিক বিচ্ছিন্ন হামলার খবর পাওয়া গেছে। পুরো বছরের চিত্র এখনো স্পষ্ট নয়, তবে সহিংসতার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে পুরোপুরিই।

যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ স্কলার মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা অধ্যুষিত ভারতে নিম্নবর্ণের দলিত সম্প্রদায়, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিষ্টান ও মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা, অর্থাৎ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রতিনিয়ত অনিরাপদ জীবনের মুখোমুখি। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকারে আসার পর গত এক দশকে কেন্দ্রীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীসহ বিভিন্ন রাজ্য সরকারের পদস্থ প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের উগ্র হিন্দুত্ববাদী কর্মকাণ্ড উচ্চবর্ণের হিন্দু ব্যতীত অন্যদের অস্তিত্বকে ক্রমাগতভাবে সংকটাপন্ন করে তুলেছে।

তিনি বলেন, একদিকে কথিত গো-মাংসবিরোধী উগ্র হিন্দুত্ববাদী ঘৃণার শিকারে পরিণত হয়ে মুসলিমসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অসংখ্য নিরীহ মানুষ গণপিটুনিতে খুন হয়েছেন এবং অগণিত পরিবার তাদের জীবিকা ও সম্পদ হারিয়েছে। অন্যদিকে, ২০২৫ সালের ওয়াকফ্ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টের মতো অন্যায্য আইন প্রণয়নের মাধ্যমে রাষ্ট্র মুসলিমদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার বন্দোবস্ত করেছে। ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে সাংবিধানিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের মুসলিমদের ওপর নিপীড়নের বিস্তৃতি ঘটানোর উদ্দেশ্যে সেখানকার স্বশাসনের অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে গোটা অঞ্চলকে প্রকৃতপক্ষে খোলা আকাশের নিচে একটি কারাগারে পরিণত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, গবেষক, লেখকদের কথিত সন্ত্রাসবাদের মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত করে কারাবন্দি করা ও স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার খর্ব করা হয়েছে। মানবাধিকার কর্মকাণ্ড পরিচালনাকে প্রকারান্তরে ‘অপরাধ’ হিসেবে চিহ্নিত করে মুসলিম নেতৃত্বাধীন সব মানবাধিকার সংগঠনের কার্যক্রম মূলত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মুসলিম পরিচয়ের কারণে হত্যাসহ রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চালানোর সামাজিক বৈধতার বয়ান তৈরি করা হয়েছে।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন