কোরআন নাজিলের মাস পবিত্র রমজান মর্যাদার পাশাপাশি ইসলামের বিজয়ের মাস। রমজান এলে গুটিয়ে যাওয়া নয়, বিজয়ের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়া উচিত। রমজানে বিজয়ের কিছু স্মরণীয় ঘটনা নিচে তুলে ধরা হলো—
‘সিইফুল বাহার’ জয়
মুসলিমদের বিজয়ের ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছিল এ রমজান মাস দিয়েই। মক্কা থেকে মদিনা হিজরতের পর হিজরি প্রথম সালে হামজা ইবন আব্দুল মুত্তালিবের নেতৃত্বে রমজান মাসে (মার্চ, ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দ) ৩০ জন মর্দে মুজাহিদের সমন্বয়ে ‘সিইফুল বাহার’ অভিযানে মুসলিমরা সফলতা লাভ করেন। এ অভিযানের ফলে ইসলামের চিরশত্রু আবু জাহেলদের মনে ভীতির সঞ্চার হয়।
বদরের মহাবিজয়
দ্বিতীয় হিজরির ৩ রমজান রাসুলুল্লাহ (সা.) বদরের উদ্দেশে মদিনা থেকে রওনা হন এবং ১৭ রমজান বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এটি ছিল ইসলামের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা ও মহাবিজয়। সত্যের পদচারণায় সেদিন মিথ্যার কবর রচনা হয়েছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নেতৃত্বে ৩১৩ জন মর্দে মুজাহিদ সাহাবি সেদিন সুসজ্জিত সহস্রাধিক শত্রুর মোকাবিলা করে বিজয়ের মুকুট পরিধান করেছিলেন।
খন্দক যুদ্ধের প্রস্তুতি
ইসলামের আরেক মহাবিজয় খন্দকের যুদ্ধ। নির্ভরযোগ্য মতানুসারে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল পঞ্চম হিজরির শাওয়াল মাসে। আর এ যুদ্ধের প্রস্তুতি বিশেষ করে মদিনার তিন দিকে খন্দক খননের কাজ হয়েছিল রমজান মাসে।
মক্কা বিজয়
অষ্টম হিজরির ২ রমজান, ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে রাসুলুল্লাহ (সা.) ১০ হাজার বীর সেনানী নিয়ে মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে মদিনা থেকে রওনা করেন। তিনি বিনা যুদ্ধে মক্কাবিজয় লাভ করেন। ২০ রমজান মক্কা বিজয় সম্পন্ন হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবিরা সেদিন কাবার ভেতরে নির্মিত ৩৬০টি মূর্তি ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেন।
তায়েফ বিজয়
অষ্টম হিজরির ২২ রমজান মোতাবেক ১২ জানুয়ারি, ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে রাসুলুল্লাহ (সা.) তায়েফে যান, হুনায়ন যুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং জয়লাভ করেন।
তাবুক যুদ্ধ
নবম হিজরির ৮ রমজান মোতাবেক ১৮ সেপ্টেম্বর, ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর জীবনের সর্বশেষ জিহাদ তাবুক যুদ্ধ করেন এবং একই মাসে যুদ্ধশেষে বিজয়ীর বেশে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন।
কাদেসিয়া যুদ্ধ
এক বর্ণনা অনুযায়ী কাদেসিয়া যুদ্ধ ১৫ হিজরি সনের রমজান মাসে সংঘটিত হয়। সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)-এর নেতৃত্বে মুসলমান ও রুস্তুম ফাররাখজাদের নেতৃত্বে পারসিকদের মধ্যে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তবে ইবনে কাছির (রহ.) তারিখ উল্লেখ ছাড়াই বলেছেন, এটা ১৪ হিজরি সনে হয়েছিল। চার দিন ও তিন রাত ব্যাপ্ত এ প্রচণ্ড যুদ্ধে মাত্র ৩৬ হাজার মুসলিম সৈন্য দুই লাখ সুসজ্জিত পারসিক বাহিনীকে পরাজিত করে।
উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) কর্তৃক বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়
১৫ হিজরির ১৩ রমজান, ১৮ অক্টোবর, ৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দে উমর (রা.) ফিলিস্তিনে আগমন করেন এবং মুসলিমরা বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয় লাভ করেন।
আলী (রা.)-এর শাহাদত
৪০ হিজরির ১৭ রমজান শুক্রবার আসাদুল্লাহহিল গালিব-খ্যাত প্রিয় নবী (সা.)-এর জামাতা ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলি (রা.) শাহাদত বরণ করেন। ইবন মুলজিম, অরদান ও শাবিব নামে তিন ঘাতক সেদিন তাঁকে তরবারির আঘাতে শহীদ করেন। (মুসতাদরাক হাকিম, হাদীস নং ৪৬৮৮)
হাসান ইবন আলী (রা.)-এর খিলাফত লাভ
৪০ হিজরির ১৮ রমজান, ২৪ জানুয়ারি, ৬৬১ খ্রিষ্টাব্দে হাসান ইবন আলী (রা.) খিলাফতে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর খিলাফতের মেয়াদ ছিল মাত্র ছয় মাস।
কায়রোয়ান শহরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন
৪৮ হিজরির ২৯ রমজান মোতাবেক ৯ নভেম্বর, ৬৬৮ খ্রিষ্টাব্দে বিশিষ্ট সাহাবি উকবা ইবন আমের (রা.)-এর নেতৃত্বে তিউনেসিয়ার ঐতিহাসিক কায়রোয়ান শহরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়।
মুহাম্মাদ ইবন কাসিমের সিন্ধু বিজয়
৯২ হিজরির ৬ রমজান মোতাবেক ৬৮২ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ মে খলিফা ওয়ালিদ ইবন আব্দুল মালেকের আমলে বীর সেনানী মুহাম্মাদ ইবন কাসিম ভারত উপমহাদেশের সিন্ধু প্রদেশ বিজয় করেন। সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে ইসলামের শান্তির ছায়াতলে প্রবেশ করতে থাকে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও আশেপাশের দেশগুলো।
স্পেনে ইসলামের বিজয় পতাকা
৯১ হিজরির ২৮ রমজান বীর পুরুষ তারেক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে মুসলিমরা ইউরোপের তৎকালীন প্রাণকেন্দ্র স্পেন বিজয় লাভ করেন। তারেক ইবন জিয়াদের মাত্র ১২ হাজার সৈন্য সেদিন স্পেনের সম্রাট লুজলাইকের লক্ষাধিক সৈন্যবাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন।
ইসলামের শীতল ছায়াতলে ফ্রান্স
মুসলমানরা স্পেন জয় করে উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। খলিফা উমর ইবন আব্দুল আজিজের শাসনামলে ১০০ হিজরির রমজান মাসে ‘সামহ ইবন মালেক আল-খাওলানি’-এর নেতৃত্বে মুসলিমরা ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চল বিজয় লাভ করেন। মুসলিম সেনাবাহিনী ‘আনবাসাহ ইবন সুহাইম’-এর নেতৃত্বে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের ৩০ কিলোমিটার দূরে ‘মাসুন শালুন ও সান্স’ প্রভৃতি শহর দখল করেন। ফ্রান্সে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হলে ধীরে ধীরে তা ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
আব্বাসীয় খিলাফাতের গোড়াপত্তন
১৩২ হিজরির দ্বিতীয় রমজান (১৩ এপ্রিল, ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ) আবুল আব্বাস আব্দুল্লাহর খিলাফতে আরোহণের মাধ্যমে আব্বাসীয় খিলাফতের গোড়াপত্তন হয় এবং উমাইয়া শাসনের অবসান ঘটে।
সিসিলি দ্বীপপুঞ্জ বিজয়
২১২ হিজরির ৯ রমজান মোতাবেক ১ সেপ্টেম্বর, ৮২৭ খ্রিষ্টাব্দে জিয়াদ ইবন আগলাবের নেতৃত্বে সিসিলি দ্বীপপুঞ্জ বিজিত হয় এবং সেখানে ইসলামের নিশান ওড়ে।
মঙ্গলদের বিরুদ্ধে মামলুক মুসলমানদের বিজয়
মঙ্গলদের বিরুদ্ধে মামলুক মুসলমানদের ঐতিহাসিক এক যুদ্ধ হলো আইনে জালুত। ১২৬০ ঈসায়ী সালের ৩ সেপ্টেম্বর দক্ষিণপূর্ব গ্যালিলিতে জাজরিল উপত্যকার আইন জালুতে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে মামলুকদের বিজয় হয়। হিজরি ক্যালেন্ডারে মাসটি ছিল পবিত্র রমজান।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

