সম্প্রতি ইসলামি আলোচক আমীর হামজা আল্লাহর রাসুল (সা.)–কে ‘সাংবাদিক’ বলেছেন। তিনি যুক্তি দিয়েছেন, যেহেতু নবী (সা.) ছিলেন আল্লাহর বার্তাবাহক, তাই রূপক অর্থে তাঁকে সাংবাদিক বলা যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এই তুলনা ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে বিভ্রান্তিকর এবং রাসুলের মর্যাদার পরিপন্থী। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এই মন্তব্যকে নবীর শানের অবমাননা হিসেবে দেখেছেন।
প্রথমত, সাংবাদিক বলতে বোঝায় এমন ব্যক্তিকে, যিনি সমাজে ঘটে যাওয়া মানবীয় ঘটনা ও তথ্য সংগ্রহ করেন, যাচাই করেন, বিশ্লেষণ করেন এবং জনগণকে জানান। তার কাজ মানব–অভিজ্ঞতা ও সামাজিক বাস্তবতার প্রতিবেদন তৈরি করা। অপরদিকে, ‘রাসুল’ অর্থ প্রেরিত বার্তাবাহক, যিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহিপ্রাপ্ত হন এবং সেই আসমানি বার্তা নির্ভুলভাবে মানবজাতির কাছে পৌঁছে দেন। রাসুল কোনো মানবীয় ঘটনার প্রতিবেদন করতেন না, তিনি আল্লাহর নির্দেশিত সত্য ও নৈতিক পথের দিশারি ছিলেন। কোরআনে বলা হয়েছেÑ‘তিনিই সেইজন, যিনি তাঁর রাসুলকে হিদায়াত ও সত্য ধর্মসহ পাঠিয়েছেন…।’ (সুরা আস-সাফ: ৯)। সুতরাং রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন আসমানি বার্তার বাহক (Divine Messenger), মানবীয় সংবাদদাতা নন।
দ্বিতীয়ত, সাংবাদিকের কাজ মানবীয়। তাঁর প্রতিবেদনে অজ্ঞতা, পক্ষপাত বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ত্রুটি থাকতে পারে। ভুল হলে তা সংশোধনের সুযোগও থাকে। কিন্তু রাসুল (সা.) যা নিয়ে এসেছেন, তা সম্পূর্ণ নির্ভুল ও আল্লাহপ্রদত্ত। এতে সন্দেহ করা ঈমানের পরিপন্থী। তাই নবীকে ‘সাংবাদিক’ বলা শুধু শব্দের অপপ্রয়োগ নয়, বরং তাঁর ঐশী মর্যাদার অবমূল্যায়ন।
তৃতীয়ত, রাসুলের সংবাদের উৎস আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা। ওহি আসার আগে পর্যন্ত দুনিয়ার কেউ তা জানতেন না; রাসুলের মাধ্যমে জানানোই ছিল সেই জ্ঞানের প্রথম প্রকাশ। অপরদিকে সাংবাদিকের তথ্যের উৎস মানুষ, যা পর্যবেক্ষণ, সাক্ষ্য ও বিশ্লেষণনির্ভর। একই সংবাদ ভিন্ন ব্যক্তির দৃষ্টিতে ভিন্নভাবে উপস্থাপিত হতে পারে, কিন্তু রাসুলের বার্তা একক, অপরিবর্তনীয় এবং আল্লাহ-প্রদত্ত।
চতুর্থত, রাসুলের দায়িত্ব ছিল ইলাহি নির্দেশাধীন। প্রেরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি সাধারণ মানুষ ছিলেন; প্রেরিত হওয়ার পর তাঁর দায়িত্ব হয়ে যায় মানবজাতির দিশারি হওয়া মধ্য দিয়ে। অপরদিকে সাংবাদিকতা একটি পেশা; ইচ্ছা করলে কেউ এতে যুক্ত হন, না চাইলে কেউ বাধ্য করেন না। রাসুলের দায়িত্ব কোনো পেশা নয়, এটি ছিল একটি ইলাহি দায়িত্ব।
পঞ্চমত, রাসুল (সা.)-এর প্রতিটি কথা, কাজ ও অনুমোদন (যা আমরা হাদিস হিসেবে জানি) ওহির আলোকে পরিচালিত। তাঁর বলা ও করা কোনো কিছুই ব্যক্তিগত মত বা অনুমান ছিল না। আল্লাহ বলেন, ‘তিনি নিজের খেয়াল-খুশি থেকে কথা বলেন না; এটি তো ওহি, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়।’ (সুরা আন-নাজম : ৩-৪)
অর্থাৎ, যে কথা সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে ওহি হিসেবে আসত না, তাও তিনি আল্লাহর নির্দেশনার অধীনেই বলতেন। তাঁর প্রতিটি কথা ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য, নিজের চিন্তা বা মতপ্রকাশের জন্য নয়। অপরদিকে সাংবাদিকের লেখা বা বক্তব্য সম্পূর্ণ মানবীয় চিন্তা, বিশ্লেষণ ও অভিজ্ঞতার ফল। তাই নবীর বক্তব্য ও সাংবাদিকের বক্তব্যের উৎস, প্রেরণা ও উদ্দেশ্য একেবারেই ভিন্ন।
ষষ্ঠত, সাংবাদিকতা সময়, সমাজ ও প্রেক্ষাপটনির্ভর। আজ যে সংবাদ গুরুত্বপূর্ণ, কাল তা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। বাংলাদেশের কোনো খবর তুরস্কে হয়তো কোনো গুরুত্বই পায় না; আবার ঢাকার মানুষের কাছে যা জরুরি, কুমিল্লার মানুষের কাছে তা হয়তো অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু রাসুল (সা.) যে বার্তা নিয়ে এসেছেন, তা চিরন্তন, অপরিবর্তনীয় ও সর্বজনীন। তাঁর বার্তা সময়, স্থান ও সংস্কৃতির সীমা ছাড়িয়ে সব যুগের মানুষের জন্য পথনির্দেশক। এই কারণেও নবীকে সাংবাদিক বলা একেবারেই অবান্তর ও যুক্তিহীন।
সপ্তমত, সাংবাদিকরা প্রায়ই সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রভাবের মধ্যে কাজ করেন। অনেক সময় তাঁদের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ থাকে, সত্য প্রকাশে বাধা আসে। কিন্তু রাসুল (সা.) ছিলেন আল্লাহর সরাসরি প্রেরিত প্রতিনিধি। তাঁর ওপর কোনো মানবীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক চাপ ছিল না। তিনি কারো তুষ্টির জন্য নয়, শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করেছেন। তাঁর দাওয়াত ও বার্তা সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন, নিখাদ ও নির্ভীক।
অষ্টমত, সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য মূলত পৃথিবীর বাস্তবতা তুলে ধরা। একজন সাংবাদিক মানুষকে পৃথিবীর খবর দেন—রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি বা মানবজীবনের নানা ঘটনা। কিন্তু রাসুল (সা.)-এর উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে আখিরাতের বাস্তবতা স্মরণ করানো। তিনি দুনিয়ার খবর নয়, বরং দুনিয়া ও পরকাল দু’জগতের পরিণতি জানাতেন। এটাই তাঁদের দায়িত্বের মৌলিক পার্থক্য। রাসুল (সা.) মানুষকে কেবল তথ্য দেননি; তিনি তাঁদের জীবনবিধান শিখিয়েছেন, যা দুনিয়া ও আখিরাতে মুক্তির পথ দেখায়।
সবশেষে একজন সাংবাদিকের কাজের উদ্দেশ্য সমাজে সচেতনতা তৈরি করা; কিন্তু পাঠক সংবাদ গ্রহণ করবেন কি না, তাতে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। রাসুলের বার্তা ভিন্ন—এটি মানবজাতির জন্য জীবনবিধান। যিনি তা মেনে চলেন, তিনি পুরস্কৃত হন; আর অমান্য করলে শাস্তির যোগ্য হন। তাই নবীর দায়িত্ব ছিল কেবল সংবাদ দেওয়া নয়, বরং আল্লাহর নির্দেশিত পথ অনুসরণের আহ্বান জানানো।
এই যুক্তিগুলো থেকে স্পষ্ট, নবী ও সাংবাদিকের দায়িত্ব ও মর্যাদা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমীর হামজা যদি এ কথা সজ্ঞানে বলে থাকেন, তবে তার উচিত প্রকাশ্যে ভুল স্বীকার করে তওবা করা। একজন ধর্মীয় বক্তার মুখে এমন বিভ্রান্তিকর তুলনা সাধারণ মানুষকে ভুল পথে নিতে পারে। সুতরাং তার নিকটজন ও রাজনৈতিক দলকেও এ বিষয়ে দায়িত্ব নিতে হবে। প্রয়োজনে তাকে বিশ্রাম ও চিকিৎসার পরামর্শ দেওয়া উচিত, যাতে তিনি আবার সুস্থভাবে ইসলামি দাওয়াতের আসল চেতনাকে উপস্থাপন করতে পারেন।
লেখক : প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

