হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিতে গণকবর সরিয়ে নেয় আসাদ সরকার

আমার দেশ অনলাইন
প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ১২: ৫৬
আপডেট : ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ১৬: ৪১
সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর ধুমাইরের পার্শ্ববর্তী মরুভূমিতে গণকবরের চিত্র। ড্রোন থেকে তোলা। ছবি : রয়টার্স

সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ বহু পুরনো। গণহত্যা ধামাচাপা দিতে তার সরকার দেশটির পরিচিত সবচেয়ে বড় গণকবরের একটি থেকে হাজার হাজার লাশ প্রত্যন্ত মরুভূমিতে সরিয়ে নেয়। এ জন্য দুই বছর ধরে গোপনে অভিযান চালায় আসাদ বাহিনী। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের অনুসন্ধানে এমন চিত্র উঠে এসেছে।

বুধবার রয়টার্স জানায়, কুতায়ফা এলাকার গণকবর থেকে লাশ সরিয়ে ধুমাইর শহরের বাইরে মরুভূমিতে আরেকটি বিশাল গণকবর বানানোর ষড়যন্ত্রের খবর আগে কখনো প্রকাশ্যে আসেনি।

বিজ্ঞাপন

ধুমাইর কবরস্থানের অবস্থান উন্মোচন এবং অভিযানের বিস্তারিক জানতে লাশ স্থানান্তর প্রচেষ্টার সঙ্গে সরাসরি অবগত ১৩ জনের সঙ্গে কথা বলেছে রয়টার্স। এ ছাড়া সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের সরবরাহ করা নথি পর্যালোচনার পাশাপাশি কয়েক বছর ধরে উভয় কবরস্থানের শত শত স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করেছে রয়টার্স।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, কুতায়ফা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অন্য একটি গোপন স্থানে লাশ স্থানান্তরের অভিযানের নাম দেয়া হয়েছিল ‘অপারেশন মুভ আর্থ’। ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত অভিযানটি চালানো হয়। আসাদ সরকারের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে সহায়তা এবং তার সরকারের অপরাধ ঢাকাই ছিল অভিযানের উদ্দেশ্য।

সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার সরকারকে গত মঙ্গলবার বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করেছিল রয়টার্স। তবে সরকার তাৎক্ষণিকভাবে এ সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দেয়নি।

নতুন কবর বিকৃত করার সম্ভাবনা কমাতে জায়গাটির সুস্পষ্ট অবস্থান প্রকাশ করা হবে না। আসাদ সরকার কীভাবে গোপন অভিযান চালায় এবং সাংবাদিকরা কীভাবে এই পরিকল্পনা উন্মোচনা করে, তা আসন্ন আরেকটি প্রতিবেদনে জানাবে রয়টার্স।

কমপক্ষে ৩৪টি পরিখাসহ দুই কিলোমিটার দীর্ঘ ধুমাইর মরুভূমিতে অবস্থিত কবরি টসিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় বানানো অন্যতম বৃহৎ কবর। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং কবরটি আকারে ইঙ্গিত মেলে যে, সেখানে কয়েক হাজার মানুষকে সমাহিত করা হয়ে থাকতে পারে।

গৃহযুদ্ধের শুরু অর্থাৎ ২০১২ সালের দিকে কুতায়ফা এলাকায় মরদেহ দাফন শুরু কওে আসাদ বাহিনী। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, স্বৈরশাসকের কারাগার এবং সামরিক হাসপাতালে মারা যাওয়া সেনা ও বন্দিদের লাশ গণকবরে দাফন করা হয়।

সিরিয়ার এক মানবাধিকারকর্মী ২০১৪ সালে স্থানীয় গণমাধ্যমে ছবি প্রকাশ করে কুতায়ফা গণকবরের রহস্য উন্মোচন করেন। গণকবরটির অবস্থান রাজধানী দামেস্কের উপকণ্ঠে। কয়েক বছর পর আদালতে দেওয়া সাক্ষ্য এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে গণকবরটির প্রকৃত অবস্থান উন্মোচিত হয়।

অভিযানে সম্পৃক্ত প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহের চার রাত ধরে ছয় থেকে আটটি ট্রাকে করে মানব দেহাংশ ও আবর্জনা কুতায়ফাহ থেকে ধুমাইর মরুভূমিতে নেয়া হতো।

অন্য কোথাও থেকে লাশ গোপন জায়গায় পাঠানো হয়েছিল কি না, তা নিশ্চিত করা যায়নি। ‘অপারেশন মুথ আর্থ’ বা গণকবরের উল্লেখ রয়েছে, এমন কোনো নথি পাওয়া যায়নি।

প্রত্যক্ষভাবে লাশ স্থানান্তরে সম্পৃক্ত সবারই দুর্গন্ধের কথা স্পষ্ট মনে আছে। তাদের মধ্যে দু’জন ট্রাকচালক, তিনজন মেকানিক, একজন বুলডোজার অপারেটর এবং আসাদের রিপাবলিক গার্ডের একজন সাবেক কর্মকর্তা ছিলেন।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে বর্তমানে রাশিয়ার অবস্থান করা আসাদ এবং অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। গত বছরের শেষ দিকে সরকার পতনের পর আসাদ ও তাঁর অনেক সহযোগী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।

রিপাবলিকান গার্ডের এক সাবেক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৮ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে আসাদ যখন জয়ের দ্বারপ্রান্তে, তখন মরদেহ স্থানান্তরের বিষয়টি আলোচনায় আসে। বছরের পর বছর নিষেধাজ্ঞা ও বর্বরতার অভিযোগে একঘরে হয়ে পড়া একনায়ক আসাদ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার আশায় ছিলেন।

তখন আসাদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার সিরীয় সেনাকে আটকের অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু কোনো স্বাধীন সিরীয় গোষ্ঠী বা আন্তর্জাতিক সংস্থার কারাগারে বা গণকবরে প্রবেশাধিকার ছিল না।

দুই ট্রাকচালক ও এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সামরিক কমান্ডাররা তাদের বলেছিলেন যে, লাশ স্থানান্তরের মূল উদ্দেশ্য ছিল কুতায়ফা গণকবর পরিষ্কার করার পাশাপাশি গণহত্যার প্রমাণ লোপট করা।

আসাদের পতনের সময় কুতায়ফায় নথিভুক্ত ১৬টি পরিখা খালি করা হয়েছিল।

সিরীয় অধিকারগোষ্ঠীগুলোর মতে, আসাদের আমলে ১ লাখ ৬০ হাজারের বেশি মানুষ নিখোঁজ হন। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁদের সমাহিত করতে বেশি কিছু গণকবর তৈরি করা হয়েছিল।

তবে সিরিয়ায় মানবসম্পদের সংকটের কারণে সুপরিচিত গণকবরগুলোও অরক্ষিত অবস্থায় রয়ে গেছে এবং খনন করা হয়নি। নিখোঁজদের পরিবারের তরফ থেকে বারবার আহ্বান জানানো সত্ত্বেও সমাহিত ব্যক্তিদের সম্পর্কে কোনো নথি প্রকাশ করেনি সিরিয়ার নতুন সরকার।

সিরিয়ার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী রায়েদ আল-সালেহ বলেন, ভুক্তভোগীদের সংখ্যা এবং বিচার ব্যবস্থা পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তার কারণে কাজটি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

সিরিয়ার নিখোঁজ কমিশন নিখোঁজদের পরিবারের জন্য একটি ডিএনএ ব্যাংক এবং কেন্দ্রীয় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরির পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।

নিখোঁজদের সন্ধান করা এবং যুদ্ধাপরাধের তদন্তের কাজ করা সিরীয় সংস্থা সিরিয়া জাস্টিস অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিবিলিটি সেন্টারের প্রধান মোহাম্মদ আল আব্দুল্লাহ বলেছেন, কুতায়ফা থেকে ধুমাইরে লাশের এলোমেলো স্থানান্তর শোকার্ত পরিবারগুলো জন্য ছিল বিপর্যয়কর।

তিনি আরো বলেন, সম্পূর্ণ দেহাবশেষ পরিবারগুলোকে ফেরত দেওয়া উদ্দেশ্যে লাশগুলো একত্রিত করা হবে অত্যন্ত জটিল। নিখোঁজ কমিশনের প্রশংসা করে তিনি বলেন, এর প্রতি সমর্থন আছে। কিন্তু এটি বাস্তবায়নে এখনো মানবসম্পদ ও বিশেষজ্ঞের অভাব রয়েছে।

লাশ স্থানান্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ত গাড়িচালক, মেকানিক ও অন্যরা বলেছেন, গোপন অভিযানের সময় কথা বলার অর্থ ছিল নিশ্চিত মৃত্যু। কেউ আদেশ অমান্য করত না।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত