আ.লীগ নেতা বাচ্চুর দখলবাণিজ্য

মুহাম্মদ আজাদ, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২: ২৩

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য আরশেদুল আলম বাচ্চু। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এমইএস কলেজের সাবেক জিএস থাকাবস্থায় চট্টগ্রাম নগরীর জিইসিসহ তার আশপাশে একক আধিপত্য ছিল তার। ওই এলাকায় জায়গা কেনার কৌশল করে ‘টোপ’ ফেলতেন বাচ্চু।

এই ফাঁদে শুরুতে অল্প টাকা দিয়ে জমি বা জায়গার জন্য বায়নাচুক্তি করতেন। তবে চুক্তির কাজ শেষ হলেই রাতে আঁধারে দখলে নিতেন সেসব। দখল করা স্থানে অন্য কোনো মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান থাকলে সে প্রতিষ্ঠানগুলোও হাতিয়ে নিতেন বাচ্চু। তার ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন অনেকেই। স্থানীয় বাসিন্দা ও ভুক্তভোগীদের সূত্রে এসব অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বিজ্ঞাপন

গত ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার বিজয়ের পর গোপনে কলকাতায় পালিয়ে যান বলে গুঞ্জন রয়েছে। সেখান বসেই দখলবাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ করছেন। এছাড়া বর্তমানে বিএনপির কিছু নেতার যোগসাজশে নিজের অনুসারীদের দিয়ে বাচ্চু তার দৌরাত্ম্য চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা আসার আগে আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল আরশেদুল আলম বাচ্চুর। কয়েক বছরের মাথায় দখল-টেন্ডারবাণিজ্য, চাঁদাবাজি করে সাড়ে ১৫ বছরে নামে-বেনামে অন্তত কয়েক শ কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৮ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন। ওই সময় দলীয় প্রতীক না পাওয়ায় স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমাও দিয়েছিলেন এই নেতা।

জানা গেছে, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেলের অতি আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন বাচ্চু। মূলত নওফেলের ছত্রছায়ায় অপরাধ জগতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। গত ৫ আগস্টের পর বাচ্চুর বিরুদ্ধে অন্তত ১৫টি মামলা করেছেন ব্যবসায়ী ও ভুক্তভোগীরা।

ভুক্তভোগীদের সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ সালে নগরের গোলপাহাড় মোড়ে একটি ভবনে রেস্টুরেন্ট এমএফসি নামীয় প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু করেন প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী শরফুল হক। ১৯ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করে আসছিলেন তিনি।

ভবনটির মালিক ওমর ফারুক নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ভবন কেনার বায়নাচুক্তি সূত্র ধরে ২০২৩ সালের ২০ এপ্রিল রাতের আঁধারে বাচ্চু ও তার সহযোগী আব্দুল জলিল বাহাদুর মিলে অবৈধভাবে দখলে নেন ভবনটি। ওইদিন ভবনে থাকা শরফুল হকের মালিকানাধীন দুটি প্রতিষ্ঠান এনএফসি ও র‌্যাবসন কেয়ারও জোর করে দখল করে নেন বাচ্চু ও তার লোকেরা।

২০২৪ সালের ১৪ মার্চ চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন শরফুল হক। তবে বাচ্চুর রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ওই সময় রেস্টুরেন্ট মালিকের পক্ষে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।

এ বিষয়ে ব্যবসায়ী শরফুল হক বলেন, ‘বাচ্চুর সেকেন্ড ইন কমান্ড হলেন বাহাদুর। ভবনটির মালিক ওমর ফারুকের সঙ্গে তার ভবন কেনার বায়নাচুক্তি করেন বাচ্চু। চুক্তির পরের দিন অর্থাৎ, গত রমজানের ঈদের আগের রাতেই ভবনটি দখল করে নেন বাচ্চু তার লোকজন। ওই সময় ভবনে থাকা আমার দুটি রানিং প্রতিষ্ঠান দখল করে নেন তারা।’

ব্যবসায়ী ফারুক আরও বলেন, “একটি চুক্তি থাকা অবস্থায় ভবনের মালিক ওমর ফারুক অন্যজনের সঙ্গে বায়নাচুক্তি করেন। দখলের ঘটনায় আদালতে দুটি মামলা করেছি। প্রতিষ্ঠানের ভাড়ার বিষয়েও আরও দুটি মামলা করি ভবন মালিকের বিরুদ্ধে।

বর্তমানে আদালতের মাধ্যমে ভাড়া পরিশোধ করে আসছি। ভবনমালিক ফারুকের আপন বোনজামাই রিপন ছিলেন বাচ্চুর অন্যতম সহযোগী। বাচ্চুর এ দুই শীর্ষ ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ বাহাদুর ও রিপনকে দিয়ে দখলবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। সম্প্রতি বাচ্চুরপক্ষে বাহাদুর আমাকে হুমকি দিয়ে বলেন- আমি যেন এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি না করি।’’

সূত্র বলছে, গত ৫ আগস্ট হাসিনার পালানোর পর বাচ্চুও গোপনে ভারতের কলকাতায় পালিয়ে যান। তবে এখনো পালাতে পারেননি তার অন্যতম দুই সহযোগী বাহাদুর ও রিপন। এই দু’জন বর্তমানে বাচ্চুর সব দখল করা সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণ করছেন। তবে তাদের এ কাজে সহযোগিতা করছেন বিএনপির কতিপয় সুবিধাবাদী নেতা।

তাদের মাধ্যমেই মূলত এসব দখলবাণিজ্য পরিচালনা করছেন। এসব বিএনপি নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন বাহাদুর ও রিপন। গত ২০ দিন আগে আরশেদুল আলম বাচ্চু কলকাতায় অবস্থান করার বিষয়টি জানিয়েছেন চট্টগ্রামের এক বিএনপি নেতা।

যেই কৌশলে জায়গা দখলে নিতেন বাচ্চু

২০০৯ সালে ৩১ ডিসেম্বর রাতে চট্টগ্রামের গোলপাহাড় মোড়ে এক বিহারির জায়গা দখলে নিতে গিয়ে মৃত সালামত খানের ১৫ শতকের বাড়ি ও সানাই কমিউনিটি সেন্টারে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেন বাচ্চু ও তার সহযোগী আব্দুল জলিল বাহাদুর। ২০১৫ সালের দিকে গোলপাহাড় মোড়ে ১২ শতক জায়গা দখলে নেন বাচ্চু ও বাহাদুর। ওই জায়গায় আরবি টাওয়ার নামে একটি ছয়তলা ভবন নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে বাচ্চুর লোকজন সেটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বসবাস করছেন।

২০১৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নগরীর চকবাজার থানার সেন্ট্রাল প্লাজার জায়গার মালিক মোহাম্মদ ইদ্রিসের সঙ্গে ১৫ লাখ টাকায় দশমিক ৮২২ কাঠার জমির বায়নাচুক্তি করেন বাচ্চু ও হাফিজ উল্লাহ আমিন তিমুর। বায়নার সূত্রে ওই মালিকের আরেক ভাই মো. ইব্রাহিমকে ব্ল্যাকমেইল করে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার মধ্যে ৩৭ লাখ টাকা দিয়ে ৩.০৪ শতক মার্কেটের জায়গার রেজিস্ট্রি করে নেন বাচ্চু ও তিমুর। বর্তমানে চুক্তির টাকা পরিশোধ না করে উল্টো ১৬টি দোকান ও অফিস অবৈধভাবে দখলে রেখেছেন বাচ্চু। বর্তমানে সেগুলো বিএনপির কতিপয় সুবিধাবাদী নেতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।

জিইসি মোড়ে সেন্ট্রাল প্লাজার কিছু অংশের মালিকপক্ষের প্রতিনিধি মোস্তফা আলম কিশোর জানান, ২০১৭ সালে সেন্ট্রাল প্লাজা মার্কেটের তৃতীয় তলার ৩০১ (এ), ৩০২ (বি) ও ৩০৪ নম্বর দোকানসহ মার্কেটের সামনের অংশের ওপরে ছাদের পুরো অংশ দখল করে নেন বাচ্চু। দখল করা অংশের মালিক কিশোরসহ তার আত্মীয়স্বজন। দখল করা দোকান ও ছাদের অংশ ভাড়া দিয়ে প্রতি বছরে আয় হতো ৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত আট বছরে অন্তত ৪০ কোটি টাকা লোকসানে পড়েছেন ভুক্তভোগীরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেন্ট্রাল প্লাজার একটি অংশের মালিক মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, ‘এখন এসব বিষয়ে আর কি বলব। যেহেতু বিক্রি হয়ে গেছে, এখন বাকি টাকাটা পেলে বাঁচি।’
২০২১ সালের ৭ এপ্রিল ভোরে নগরের পাঁচলাইশ থানার মিমি সুপার মার্কেট-সংলগ্ন হিলভিউ আবাসিক এলাকায় নাহার ভবন থেকে ব্যাংক কর্মকর্তা মোরশেদ চৌধুরীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

এ ঘটনায় মোরশেদের স্ত্রী ইসরাত জাহান বাদী হয়ে বাচ্চু, নাজমুল করিম শারুন, যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শহিদুল রাসেলসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মোরশেদ চৌধুরীকে বাচ্চু ধরে নিয়ে যান। পরে নগর পুলিশের উপ-কমিশনার বিজয় বসাকের উপস্থিতিতে মোরশেদের কাছ থেকে আরও ১২ কোটি টাকা বাড়তি পাওয়ার কথা বলে স্ট্যাম্পে সই নেন। সেই মামলায় সাবেক মন্ত্রী নওফেলের তদবিরে মামলা থেকে বেঁচে যান বাচ্চু।

৫ আগস্টের আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের সময়ে শিক্ষার্থীদের ওপর যুবলীগ-ছাত্রলীগের গুলিতে শুধু চট্টগ্রামে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১১ জন। আহত হয়েছেন কয়েক শ। লালখান বাজার, জিইসি ও ২ নম্বর গেট এলাকায় স্বৈরাচারবিরোধী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাচ্চু। বহদ্দারহাট ও নিউমার্কেটের ছাত্রদের সশস্ত্র হামলা চালায় বাচ্চু ও তার ক্যাডার বাহিনী।

৫ আগস্টের পর দেশের পটপরিবর্তনের ফলে কলকাতায় পালিয়ে যান বাচ্চুসহ অনেক আওয়ামী লীগ নেতা। অভিযোগের বিষয়ে জানতে আরশেদুল আলম বাচ্চুর মুঠোফোনে কল করা হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। আব্দুল জলিল বাহাদুরের মুঠোফোনটিও বন্ধ পাওয়া যায়।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত