পদত্যাগ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং মাহফুজ আলম। গতকাল বুধবার তারা পদত্যাগপত্র জমা দিলে তা গৃহীত হয়। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এ পদত্যাগপত্র কার্যকর হবে। গতকাল সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বিষয়টি জানান। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করা দুই উপদেষ্টার মঙ্গল কামনা করে ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও বিকাশে তারা একই ভাবে সক্রিয় ভূমিকা রাখবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।
জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে আসিফ ও মাহফুজ উপদেষ্টা পরিষদে স্থান পেয়েছিলেন। এর মধ্যে আসিফ স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি যুব ও ক্রীড়া এবং মাহফুজ তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছিলেন। আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার লক্ষ্যে তারা পদত্যাগ করেন বলে জানা গেছে। আসিফ এরই মধ্যে জানিয়েছেন, তিনি নির্বাচন করবেন।
এর আগে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে জুলাই আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা নাহিদ ইসলাম সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে জায়গা পেলেও দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার লক্ষ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে পদত্যাগ করেন। সর্বশেষ দুই উপদেষ্টার পদত্যাগের পর বর্তমানে সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে আর কোনো ছাত্র প্রতিনিধি থাকল না।
এতদিন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য প্রধান উপদেষ্টাসহ ২৩ জন ছিলেন। দুজন ছাত্র প্রতিনিধি বাদ পড়ায় এই সংখ্যা এখন দাঁড়াল ২১ জনে। দুই উপদেষ্টার পদত্যাগের ফলে তিনটি মন্ত্রণালয় উপদেষ্টাবিহীন হলো। এই মন্ত্রণালয়গুলোর দায়িত্বে কারা আসছেন সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। সরকার গঠনের সময় নাহিদ ও আসিফ উপদেষ্টা পরিষদে অন্তর্ভুক্ত হন। ওই সময় মাহফুজকে উপদেষ্টা মর্যাদায় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী করা হয়। পরে গত বছরের ১০ নভেম্বর মাহফুজ উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন। তবে ওই সময় তাকে কোনো দপ্তর দেওয়া হয়নি। নাহিদ উপদেষ্টা পরিষদ ছেড়ে গেলে এ বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি মাহফুজকে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
অন্যদিকে আসিফ শুরুতে ছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। পরে ১০ নভেম্বর তাকে নতুন করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর থেকে তিনি স্থানীয় সরকার এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলেছেন। আর শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় এম সাখাওয়াত হোসেনকে।
উপদেষ্টা হিসেবে আসিফ এক বছর ৪ মাস এবং মাহফুজ এক বছর এক মাস দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছেন। অপরদিকে উপদেষ্টা হিসেবে সাড়ে ৬ মাস দায়িত্ব পালন করে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি নাহিদ ইসলাম পদত্যাগ করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক হন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের সমন্বয়ে এনসিপি গঠিত হয়। দলটি এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন পেয়েছে। আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য তারা গতকাল ১২৫ জনের মনোনয়ন ঘোষণা করেছে।
আসিফ ও মাহফুজ নির্বাচন করবেন বলে জানালেও তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোট করবেন নাকি কোনো রাজনৈতিক দলের মনোনয়নে করবেন তা এখনো খোলাসা করেননি। তবে, ছাত্রদের দল এনসিপি এই দুই উপদেষ্টার সম্ভাব্য আসন দুটিতে এখনো কাউকে মনোনয়ন দেয়নি। জানা গেছে, আসিফ ঢাকা-১০ (ধানমন্ডি, কলাবাগান, নিউমার্কেট ও হাজারীবাগ) এবং মাহফুজ নিজের এলাকা লক্ষ্মীপুর-১ (রামগঞ্জ) আসনে নির্বাচন করতে চান। ঢাকা-১০ আসনে নির্বাচন করার লক্ষ্যে আসিফ সম্প্রতি তার ভোটার কুমিল্লা থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করেছেন। এদিকে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ঢাকা-১১ থেকে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। এনসিপিতে কোনো পদ না থাকলেও দলে মাহফুজ ও আসিফের বেশ প্রভাব রয়েছে।
পদত্যাগ প্রশ্নে যা জানালেন প্রেস সচিব
গতকাল সন্ধ্যায় যমুনার সামনে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, আজ (গতকাল) বিকাল ৫টায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের (দুই উপদেষ্টা) পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। তারা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় উপস্থিত হয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিলে প্রধান উপদেষ্টা তা গ্রহণ করেন। তাদের পদত্যাগ নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হবে। আপনারা জেনেছেন কালই (আজ) সম্ভবত তফসিল ঘোষণা হবে।
নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হয়েছে, আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণের মধ্য দিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবেন।
বৃহস্পতিবারের উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠকে এ দুই উপদেষ্টা থাকতে পারবেন কি নাÑএমন প্রশ্নের জবাবে শফিকুল বলেন, তফসিল যদি কাল সকালে হয় তাহলে বৈঠকে তো থাকতে পারবেন না। আর বিকালে হলে হয়তো থাকতে পারবেন।
প্রেস সচিব জানান, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সম্মুখ সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া এ দুই ছাত্রনেতার পদত্যাগপত্র গ্রহণের পর প্রধান উপদেষ্টা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের মঙ্গল কামনা করে বলেন, অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়ে তোমরা যেভাবে জাতিকে ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে মুক্তির পথে অবদান রেখেছ, জাতি তা মনে রাখবে। আমি বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতেও গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও বিকাশে তোমরা একই ভাবে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে।
প্রধান উপদেষ্টা আরো বলেন, আজ একটি ঐতিহাসিক দিন। অন্তর্বর্তী সরকার সবসময় তোমাদের অবদান স্মরণ করবে। আমি তোমাদের সুন্দর ও শুভ ভবিষ্যৎ কামনা করি। এত অল্প সময়ে তোমরা জাতিকে যা দিয়েছ, তা জাতি কখনো ভুলবে না। তিনি বলেন, এটি একটি রূপান্তর মাত্র। আমি আশা করি, আগামীতে বৃহত্তর পরিমণ্ডলে তোমরা আরো বড় অবদান রাখবে।
নিজেদের কর্মের মাধ্যমে দেশের মঙ্গলে নিয়োজিত থাকার আহ্বান জানিয়ে দুই ছাত্রনেতার উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা আরো বলেন, সরকারে থেকে যে অভিজ্ঞতা তোমরা অর্জন করেছ, তা ভবিষ্যৎ জীবনে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে।
মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব কাদের দেওয়া হবেÑএমন প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব বলেন, বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টার এখতিয়ার। তিনি শিগগির এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন।
নির্বাচন নিয়ে জনমনে শঙ্কার প্রশ্নে শফিকুল বলেন, নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে। আমরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখতে পাচ্ছি নির্বাচনের জোয়ার বইছে। তবে কিছু কিছু তথাকথিত কমেন্টেটর যারা ইউটিউব বা টেলিভিশনে কথা বলে, তারা এ কনফিউশনটা সৃষ্টি করছেন। তাদের মধ্যে তথাকথিত কিছু সিনিয়র সাংবাদিকও রয়েছেন। আমরা প্রথম থেকেই বলছি, নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে হবে এবং প্রধান উপদেষ্টা এ বিষয়ে সবাইকে প্রস্তুতি গ্রহণের কথা বলেছেন। সব ধরনের প্রস্তুতি এ সরকার নিচ্ছে। গণভোট নিয়ে প্রচার শুরু হচ্ছে বলে জানান তিনি।
পদত্যাগের আগে গতকাল বিকালে নিজ দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দেড় বছরের বিভিন্ন উন্নয়ন নিয়ে কথা বলেন আসিফ মাহমুদ। তিনি বলেন, আমি নির্বাচন করব। তবে কোন দল থেকে নির্বাচন করব সেটা নিশ্চিত নয়। এখনো বলার কিছু নেই। পদত্যাগের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জানানো হবে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ বিদায়ের পর বাকস্বাধীনতা ফিরে এসেছে। অভিজ্ঞতার বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমার প্রায় ২৫ বছরের জীবনে যা শিখেছি, গত দেড় বছরে তার থেকে অনেক বেশি শিক্ষা নিয়েছি। আসিফ গণমাধ্যমে কথা বললেও মাহফুজ এখনো মুখ খোলেননি।
এদিকে সাবেক সমন্বয়ক এবং এনসিপি থেকে সম্প্রতি পদত্যাগ করা মুহাম্মদ রাকিব উপদেষ্টা আসিফ ও মাহফুজের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। অন্যথায় জুলাই আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়করা মাঠে কর্মসূচি দেবেন বলে তিনি হুঁশিয়ারি দেন।
গত মঙ্গলবার রাকিব তার ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে এক পোস্টে তদন্তের দাবি তুলে লেখেনÑ‘ছাত্র উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আলম পদত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে দুদক যেন তদন্ত করে। না হলে আমরা সাবেক সমন্বয়করা মাঠের কর্মসূচি দেব।’
সম্প্রতি এনসিপি থেকে পদত্যাগ করেন দলটির দক্ষিণাঞ্চলের সমন্বয়ক মুহাম্মদ রাকিব এবং আরিফ তালুকদার। ওই সময় সংবাদ সম্মেলনে তারা দাবি করেন, দলটির সব অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে দুই ছাত্র উপদেষ্টা জড়িত। মন্ত্রিপাড়ায় বসে এ দুই উপদেষ্টাই এনসিপি পরিচালনা করছেন।
এর আগে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় গত এপ্রিলে উপদেষ্টা আসিফের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মোয়াজ্জেম হোসেনকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। অবশ্য মোয়াজ্জেম হোসেন দাবি করেছিলেন, তাকে অপসারণ করা হয়নি। তিনি পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগের পরপরই মোয়াজ্জেম হোসেনের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেয় দুদক। কমিশন এরই মধ্যে তাকে এক দফা তলব করেছিল। তার সম্পদের অনুসন্ধান কার্যক্রম চলমান বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে। কমিশনের এক কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, তার বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধান শেষে মামলা করা হবে।

