হাসিনার শাসনামলে শিবিরকর্মী বলে পায়ে শটগান ঠেকিয়ে গুলি

পঙ্গুত্বের দুর্বিষহ জীবন জাবি শিক্ষার্থী মালেকের

এস এম তাওহীদ, জাবি
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১: ০৩

২০১৩ সাল। আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এর মধ্যে ওই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের রায় হয়। ওই রায় আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। এর কয়েকদিন পর ২১ সেপ্টেম্বর ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটি মিছিলে যোগ দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আব্দুল মালেক। মিছিল থেকে অনুসরণ করে পুলিশ তার হাজারীবাগের বাসায় চলে আসে। সেখানেই পায়ে শটগান ঠেকিয়ে গুলি করে পুলিশ। দীর্ঘ আট মাস কারাভোগ এবং ১৫টিরও বেশি অস্ত্রোপচারের পর এখন কিছুটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরলেও পঙ্গুত্বের বেদনা নিয়ে চলছেন এই শিক্ষার্থী। আমার দেশকে লোমহর্ষক ওই ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন আব্দুল মালেক।

আব্দুল মালেক তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। একই সঙ্গে ছাত্রশিবিরের ঢাকা মহানগর পশ্চিমের সদস্য ও ৪৮নং ওয়ার্ডের (হাজারীবাগ) সভাপতি ছিলেন। তখন পুরো ঢাকায় তুমুল আন্দোলন চলছিল। আন্দোলনের ‘হটজোন’ হিসেবে পরিচিত ছিল ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর এবং কলাবাগান এলাকা। প্রায় প্রতিদিনই সেখানে রায়ের প্রতিবাদে মিছিল হতো। এমনই একটি মিছিল থেকে অনুসরণ করে পুলিশ হাজারীবাগে একটি ভবনের চতুর্থ তলায় আব্দুল মালেকের বাসার সন্ধান পায়।

বিজ্ঞাপন

সেদিন ছিল শনিবার। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস না থাকায় মিছিল শেষে বাসায় একাই অবস্থান করছিলেন আব্দুল মালেক। বিকালের দিকে হঠাৎ সাদা পোশাকে র‌্যাবের কয়েকজন সদস্য এসে দরজার কড়া নাড়েন। মালেক বুঝতে পারলেন তিনি গ্রেপ্তার হতে চলেছেন। র‌্যাব সদস্যরা তখন পুলিশ আসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। তবে পুলিশ এসেই মালেককে গুলি করতে উদ্যত হয়। তখন বাড়িওয়ালা ও আশপাশের লোকজন তাদের গুলি না করার অনুরোধ করেন। এমনকি উপস্থিত র‌্যাব সদস্যরাও বাধা দেন। কিন্তু পুলিশ ছিল বেপরোয়া।

তখন ওসি কাজী মঈনুল ইসলাম বলেন, আমরা পুলিশের লোক। গুলি করলে কিছুই হবে না। নিউজ করিয়ে দেব। ওসি নিজে শটগান লোড করে এসআইয়ের হাতে দেন। ওই এসআই বাড়িওয়ালাসহ সবার সামনেই মালেকের ডান পায়ে শটগান ঠেকিয়ে গুলি করেন। মুহূর্তেই ঝাঁঝরা হয়ে যায় হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত। পরদিন প্রথম আলো সংবাদ করে- ‘হাজারীবাগে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে শিবিরকর্মী আহত’। ওখান থেকে আহত মালেককে পুলিশ ভ্যানে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। বন্দুকযুদ্ধের নাটকে অংশ নেওয়া ছয় পুলিশ সদস্য আহত হওয়ার নাম করে চলে যান রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে।

ঢামেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় পঙ্গু হাসপাতালে। শটগানের ছররা গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া পা থেকে রক্তক্ষরণ কিছুতেই বন্ধ হচ্ছিল না। পুলিশ ডাক্তারদের পা কেটে ফেলতে বলে। সেখানে পরিবারের অনুরোধে পঙ্গু হাসপাতালের ডা. গণি মোল্লা বলেন, ‘ইয়াং মানুষ, পা কেটে ফেলবে কেন? তার প্রচেষ্টায় পায়ের ঊরু থেকে টিস্যু নিয়ে ক্ষতস্থানে বসানো হয়। পরে কয়েক দফা অস্ত্রোপচারের পর ডান পায়ে স্টিলের স্ট্রাকচার বসানো হয়।

সেসব দিনের কথা স্মরণ করে আব্দুল মালেক বলেন, দুজন কনস্টেবল ও দুজন কারারক্ষীর অধীন আমার চিকিৎসা হতো। হাসপাতালে আওয়ামীপন্থি ডাক্তাররা আমার সঙ্গে পুলিশের চেয়ে বেশি অমানবিক আচরণ করেন। ব্লক-২ ইউনিটে ডা. মোয়াজ্জেম, আ. সালাম এবং ডা. মামুন আমার চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন। এদের মধ্যে চমেকে ছাত্রলীগ করে আসা ডা. মামুন আমাকে গালাগালি করতেন। আমার ভাইকে একবার মারতে উদ্যত হয়েছিলেন তিনি। এমনকি অস্ত্রোপচারের পর যেখানে অন্তত ২১ দিন আমার নড়াচড়া সম্পূর্ণ নিষেধ, সেখানে তিনদিনের মাথায় রিলিজ দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দিতে চান। পরে পরিবারের অনুরোধে ডা. গণি মোল্লা আমাকে হাসপাতালে থাকার ব্যবস্থা করেন।

পরে ওই বছরের ৮ ডিসেম্বর মালেককে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। তখনো তার কোমর থেকে গোড়ালি পর্যন্ত পুরো ব্যান্ডেজ। কারো সাহায্য ছাড়া নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন। কারাগার থেকে হাসপাতাল, হাসপাতাল থেকে কারাগার- এভাবে দীর্ঘ আট মাস ৯ দিন পর জামিনে মুক্তি পান তিনি।

ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে হাজারীবাগ থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে প্রথমটির বিচারিক কার্যক্রম শেষের দিকে, অন্যটির বিচার এখনো শুরু হয়নি। মামলার শুনানিতে একপর্যায়ে বিচারক জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘মামলায় নথিতে লেখা- আশপাশের মানুষ খবর দেওয়ার পর পুলিশ এসেছে। আবার বলছেন শিবিরকর্মীরা পুলিশের ওপর প্রথম বোমা হামলা করেছে। এটা কীভাবে সম্ভব?’ বাড়িওয়ালাসহ অন্যরা সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, সেদিন বন্দুকযুদ্ধ বা পুলিশের ওপর বোমা হামলার কোনো ঘটনা ঘটেনি। দুটি মামলায়ই চূড়ান্ত রায়ে বেকসুর খালাস পাবেন বলে আশাবাদী তিনি।

আব্দুল মালেক জাবির ৪২তম ব্যাচের (২০১২-১৩ সেশন) শিক্ষার্থী হলেও দীর্ঘ অসুস্থতার কারণে প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দেন ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে। স্নাতকে ৩.২৫ ও স্নাতকোত্তরে ৩.৬১ সিজিপিএ নিয়ে ৪৪ ব্যাচের সঙ্গে ২০২১ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেন তিনি।

পুনরায় ক্যাম্পাস জীবনে ফেরার পর শঙ্কা ছিল অনেক। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, টানা ১০ দিন ক্লাসে না এলে সে জঙ্গি। বাধ্য হয়ে অসুস্থতা নিয়েই ক্র্যাচে ভর করে ক্লাসে আসতেন আব্দুল মালেক। তবে ওই বৈরী পরিবেশের মধ্যেও বিভাগের শিক্ষকরা তাকে সাপোর্ট দিয়েছিলেন।

ওই সময়ের স্মৃতিচারণ করে মালেক বলেন, শিক্ষকরা নিয়মিত আমার খোঁজখবর নিতেন। বিভাগে ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরাও তাকে সম্মানের সঙ্গে দেখতেন, নোট শেয়ার করতেন, খেলাধুলা ও বিভিন্ন আয়োজনে তাকে শামিল করে নিতেন।

আব্দুল মালেকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা বরিশালের মুলাদীতে। ২০০৪ সালে ঢাকায় হেফজ সম্পন্ন করে স্থানীয় একটি মাদরাসা থেকে দাখিল শেষ করেন তিনি। পরে ঢাকার মোহাম্মদীয়া আলিম মাদরাসা থেকে আলিম পাস করে ভর্তি হয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে তিনি ধানমন্ডির ইবনে সিনায় জনসংযোগ কর্মকর্তা (পিআরও) হিসেবে চাকরিরত। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত ও তাদের আট মাসের একটি কন্যাসন্তান রয়েছে।

এখন ক্র্যাচ ছাড়াই হাঁটাচলা করতে পারেন মালেক। তবে দীর্ঘ সময় বসে থাকতে পারেন না। পায়ের যন্ত্রণা নিয়েই দৈনন্দিন কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সর্বশেষ দায়িত্ব পালন করেছেন ইসলামী ছাত্রশিবির জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার মানবসম্পদ উন্নয়ন (এইচআরডি) সম্পাদক হিসেবে।

আব্দুল মালেক বলেন, চব্বিশের জুলাই বিপ্লব মাত্র এই কয়েক দিনের আন্দোলনে সম্পন্ন হয়নি। এটা আমাদের দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রামের অনিবার্য বাস্তবতা। নতুন বাংলাদেশে দলমত নির্বিশেষে প্রতিটি শিক্ষার্থীর অধিকার নিশ্চিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত