চালে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি, স্বস্তি আলুতে

সরদার আনিছ
প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯: ২৫
আপডেট : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০: ৫৬

চালের দাম খাদ্য ও সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির ওপর এখনো উল্লেখযোগ্য চাপ তৈরি করছে। ক্রমেই বাড়ছে দাম। সেই চাপ কিছুটা হলেও প্রশমন করছে আলু। গত অর্থবছরে সবজির মূল্যস্ফীতি কমাতে বলিষ্ঠ প্রভাব রেখেছে। তবে খাদ্যবহির্ভূত খাতে গত অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল ছিল বলে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে।

খাদ্যপণ্যের মধ্যে শাকসবজি ও কন্দজাত ফসলের অবদান যথাক্রমে ৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ। দাম কমেছে ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ, যা খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়তা করেছে। এর মধ্যে আলু ও পেঁয়াজের অবদান যথাক্রমে ১৫ দশমিক ৭১ শতাংশ এবং ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

বিজ্ঞাপন

এছাড়া সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে দেখা যায়, ইলিশ, বেগুন, টমেটো, সয়াবিন তেল ও পাঙাশ মাছও মূল্যস্ফীতি কমাতে কিছুটা ভূমিকা রেখেছে। ভবিষ্যতে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কৃষি উপকরণের সময়মতো সরবরাহ এবং বাজার পরিস্থিতির নিবিড় পর্যবেক্ষণের ওপর জোর দিয়েছে জিইডি।

টিসিবির বাজারদরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৩১ জুলাই কেজিপ্রতি আলুর দাম ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। বছর ঘুরে পণ্যটি বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকায়। যা আগের বছরের তুলনায় ৫২ দশমিক ১৭ শতাংশ কম। চলতি সপ্তাহে বাজারে আলুর দাম আরো কম, ১৬ থেকে ২০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে।

অন্যদিকে সরকারি বিপণন সংস্থার টিসিবির বাজার দরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছরের ৩১ জুলাই সরু জাতের চালের দাম ছিল কেজিতে ৬০ থেকে ৭৮ টাকার মধ্যে; এক বছরে তা বেড়ে হয়েছে ৮৫ টাকা। মাঝারি মানের চাল, যা বেশি মানুষের খাদ্য, তার দাম ৫৮ টাকা থেকে লাফিয়ে উঠে ৭৫ টাকায়। আর মোটা চালের দাম ৫৪ থেকে ৬০ টাকায় পৌঁছেছে। এই তিন ধরনের চালের দামই বেড়েছে যথাক্রমে ১৫ দশমিক ৯৪, ২০ দশমিক ৫৪ ও ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ। চালের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি শুধু ভোক্তার পকেটই কাটেনি মূল্যস্ফীতির ওপর বড় চাপ তৈরি করেছে।

জিইডি প্রকাশিত সর্বশেষ অর্থনৈতিক হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, চালের দাম খাদ্য ও সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির ওপর এখনো বড় চাপ। মে মাসে যেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে চালের অবদান ছিল ৪০ শতাংশ, জুলাই মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫১ দশমিক ৫৫ শতাংশে। এর মধ্যে মাঝারি ও মোটা চালের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। মাঝারি চাল ২৪ শতাংশ এবং মোটা চাল ১৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ প্রভাব রেখেছে। চিকন, মাঝারি ও মোটাÑ এই তিন ধরনের চালেই জুলাই মাসে প্রায় ১৫ শতাংশ হারে মূল্যস্ফীতি হয়েছে।

তিন বছর ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। আগের চার মাস মূল্যস্ফীতি কমলেও গত জুলাই মাসে কিছুটা বেড়েছে। গত জুলাই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। গত জুনে এই হার ছিল ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ। তখন টানা চার মাস সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমেছিল।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত জুনে দেশের যে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল, তা বিগত ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। কিন্তু সে অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি। এর পরের মাসেই মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়।

বিবিএসের হিসাব অনুসারে, গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয় ৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ। দুই খাতেই আগের মাসের চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।

এক বছর আগে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ নেয়। এর কিছুটা সুফলও মিলেছে।

তিন বছর ধরেই দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। এনবিআরও চাল, তেল, আলু, পেঁয়াজ, ডিমসহ বেশ কিছু নিত্যপণ্যে শুল্ক-কর কমিয়ে দেয়। অতি সম্প্রতি বিনাশুল্কে মাত্র ২ শতাংশ আয়কর দিয়ে চাল আমদানি অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বাজারে নিত্যপণ্যের আমদানি প্রবাহ ঠিক রাখার চেষ্টা করা হয়।

এদিকে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন আমার দেশকে বলেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়ক হলেও আলুচাষিরা মূলধন হারিয়ে এখন দিশেহারা। তারা খরচের টাকা উঠাতে পারেননি। এ কারণে তারা আগামী মৌসুমে আলু চাষে নিরুৎসাহিত হবেন।

বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএসএ) পরিচালক ও হাসেন কোল্ড স্টোরেজের স্বত্বাধিকারী হাসেন আলী আমার দেশকে বলেন, আলুর দাম মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়ক হলেও ন্যায্য দাম না পেয়ে কৃষকরা দিশেহারা। গত বছরের তুলনায় এবার ১০ লাখ টন বেশি আলু এখনো হিমাগারে পড়ে আছে।

তিনি বলেন, এই দাম আলু উৎপাদনে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে পারে। চাষিরা সত্যি যদি আলু চাষ কমিয়ে দেন, সেক্ষেত্রে সংকটে পড়বে দেশ। তাই ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে রপ্তানি বাড়ানোর পাশাপাশি স্থানীয় বাজারেও ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে সরকারের উদ্যোগ জরুরি।

হিমাগার মালিকদের সংগঠন বিসিএসএর তথ্য বলছে, এবার এক কোটি ৩০ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে। দেশে বছরে আলুর চাহিদা ৮৫ থেকে ৯০ লাখ টন। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন ৪০ লাখ টন বেশি। কিন্তু বাজার ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যহীনতার কারণে হিমাগার ফটকে এলাকাভেদে কেজি এখন ১৩ থেকে ১৫ টাকা। অথচ সব মিলিয়ে কৃষকের প্রতি কেজিতে উৎপাদন খরচ হয়েছে ২৫ টাকা।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত