বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক মানচিত্রে অস্থিরতা ও কিছুটা আতঙ্কের ছায়া ঘনীভূত হচ্ছে। গত বছরের ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবের পর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং জনগণের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে যারা আপসহীন, তাদের টার্গেট করা হচ্ছে। বিশেষ করে ভারতের একপক্ষীয় নীতি ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে যারা রাজপথ এবং কলমে সোচ্চার, তাদের স্তব্ধ করার এক সুদূরপ্রসারী ‘নীলনকশা’ বাস্তবায়নের কিছু গুরুতর ইঙ্গিত পাচ্ছে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো।
সম্প্রতি ইনকিলাব মঞ্চের সংগঠক শরীফ ওসমান হাদির ওপর প্রকাশ্য দিবালোকে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল করিম মাসুদের গুলি এ আশঙ্কাকে রাজপথ থেকে নীতিনির্ধারণী মহলে নিয়ে এসেছে। নিরাপত্তাসংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দিল্লির প্রভাবমুক্ত স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির দাবি তোলা ব্যক্তিরাই এখন একটি বিশেষ হিটলিস্টের লক্ষ্যবস্তু।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর তরফে জানা গেছে, এ টার্গেট কিলিং বা দমনের পরিকল্পনা অত্যন্ত নিখুঁত ও বহুমুখী। সরাসরি কোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে সামনে না এনে ‘ছায়া সংগঠন’, ‘ভাড়াটে ক্যাডার’ এবং ‘ডিজিটাল ট্রল আর্মি’ ব্যবহার করা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় তিনটি স্তর লক্ষ করা যায়। প্রথমত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টার্গেট ব্যক্তিদের ‘ভারতবিদ্বেষী, ‘উগ্রবাদী, বা ‘সাম্প্রদায়িক’ তকমা দিয়ে তাদের জনবিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা হয়; যাকে বলা হচ্ছে ‘শিকারের পরিবেশ’ তৈরি করা। দ্বিতীয়ত, বিশেষ নজরদারির মাধ্যমে তাদের গতিবিধি ও ব্যক্তিগত অবস্থান ট্র্যাক করা হয়। তৃতীয়ত, সুযোগ বুঝে শারীরিক হামলা বা ডিজিটাল স্পেস থেকে তাদের সরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় করা হয়।
হাদির ওপর হামলার পর উচ্চপর্যায়ের নিরাপত্তা সূত্রগুলো মনে করছে, এটি কেবল ব্যক্তিগত হামলা নয়; বরং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে কথা বলা ব্যক্তিদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার একটি বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক চক্রান্তের অংশ।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতীয় আধিপত্যবাদ কেবল রাজনৈতিক নয়; এটি বর্তমানে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও শিকড় গেড়েছে। যারা তিস্তাচুক্তি, সীমান্ত হত্যা, অসম বাণিজ্য কিংবা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দিল্লির অহেতুক হস্তক্ষেপ নিয়ে তথ্যনির্ভর প্রশ্ন তোলেন, তারা সরাসরি একটি শক্তিশালী স্বার্থগোষ্ঠীর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ান। দীর্ঘ দেড় দশক ধরে আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের সঙ্গে যেসব গোপন বা অসম চুক্তি করেছিল, সেগুলোর স্বরূপ যারা জনসম্মুখে উন্মোচন করছেন, তারাই এখন ঘাতকদের মূল লক্ষ্যবস্তু। বিশেষ করে আবরার ফাহাদের উত্তরসূরি হিসেবে যারা তরুণ প্রজন্মকে সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ করছেন, তাদের মধ্যে ভয় ছড়িয়ে দেওয়াই এ কিলিং মিশনের মূল উদ্দেশ্য।
উচ্চঝুঁকিতে ৫০ ব্যক্তি
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এবং ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পক্ষের শক্তিগুলো সমন্বিতভাবে একটি তালিকা তৈরি করেছে, যাদের জীবনের নিরাপত্তা এখন সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে বলে মনে করা হচ্ছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের সবুজ সংকেত পাওয়ার পর ইতোমধ্যে প্রায় ৫০ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নিরাপত্তায় বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ তালিকার শীর্ষে রয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দীর্ঘ দেড় দশক ধরে তিনি জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রধান হিসেবে আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানকেও এ তালিকায় রাখা হয়েছে, যিনি ফ্যাসিবাদের পতন-পরবর্তী সময়ে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। বরাবরই দলটি ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্টের চক্ষুশূল।
এ তালিকায় রয়েছে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের নামও। ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক ও মাঠপর্যায়ের লড়াইয়ের অগ্রনায়ক এ সম্পাদককে ‘হাই-রিস্ক’ ক্যাটাগরিতে রেখে বিশেষ সশস্ত্র বডিগার্ড দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ ও মুজিবুর রহমান মঞ্জু-এবি পার্টির দুই শীর্ষ নেতা আন্তর্জাতিক ফোরামে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় ভারতের অযাচিত হস্তক্ষেপের চিত্র তুলে ধরেছেন। তাদের ওপর হামলার মাধ্যমে দিল্লির একপক্ষীয় নীতির বিরোধীদের একটি বড় অংশকে দুর্বল করার চেষ্টা হতে পারে বলে গোয়েন্দা তথ্যে উঠে এসেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান দুই সমন্বয়ক এবং বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের ম্যান্ডেট রক্ষায় ভূমিকা তাদের টার্গেটে পরিণত করেছে। নাহিদ ইসলাম এনসিপির আহ্বায়ক। ছাত্র আন্দোলনের প্রভাবশালী দুই মুখ হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলম মাঠপর্যায়ে তরুণদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়। উত্তরবঙ্গ থেকে শুরু করে সীমান্ত এলাকাগুলোয় তাদের সফরগুলো ভারতীয় স্বার্থের জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। তাদের সফরের রুট ম্যাপ লিক হওয়ার পেছনে বিশেষ কোনো মহলের হাত রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা। এনসিপির আখতার হোসেন রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কার ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সোচ্চার। গণঅধিকার পরিষদের শীর্ষ নেতা নুরুল হক নূর ও রাশেদ খান দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের একচেটিয়া প্রভাবের বিরুদ্ধে রাজপথে সক্রিয়।
তালিকায় কেবল রাজনৈতিক নেতা নন, রয়েছেন ধর্মীয় অঙ্গনের প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও। হেফাজতে ইসলামের মাওলানা মামুনুল হক এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির মুফতি রেজাউল করীমের জনভিত্তি ও আধিপত্যবাদবিরোধী অবস্থান তাদের টার্গেটে পরিণত করেছে। মঞ্চ-২৪-এর ইকরামুল হাসান ফাহিম ফরাজী এবং আপ বাংলাদেশের আলী আহসান জুনায়েদও রয়েছেন তালিকায়।
তালিকায় আরো আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি সাদিক কায়েম, যিনি ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে আইকন হিসেবে পরিগণিত হচ্ছেন। ছাত্রদলের পক্ষ থেকে ভিপি প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করা আবিদুল ইসলাম আবিদ, রাকসুর জিএস সালাউদ্দিন আম্মার, রাজশাহী সীমান্ত এলাকায় বিএসএফের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি স্থানীয়দের সংগঠিত করছেন। সীমান্ত অঞ্চলে ভারতীয় প্রভাব সরাসরি চ্যালেঞ্জ করায় তার নিরাপত্তা ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি বলে মনে করা হচ্ছে। আরিফুল ইসলাম আদিব এবং আব্দুল হান্নান মাসউদ, ডাকসুর নেত্রী ফাতেমা তাসনীম ঝুমা এবং ছাত্রনেতা বিন ইয়ামিন মোল্লার নাম রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ এ তালিকায়। এদের প্রত্যেকেই দিল্লির প্রভাবমুক্ত নতুন বাংলাদেশ গড়ার দাবিতে আপসহীন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগরে অস্থিরতার আশঙ্কা
আধিপত্যবাদবিরোধী ছাত্রনেতাদের একটি বড় অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক। অভিযোগ রয়েছে, ক্যাম্পাসের ভেতরে এবং আশপাশে এমন কিছু ‘স্লিপার সেল’ সক্রিয় রয়েছে, যারা ভারতের সমালোচনা করা ছাত্রনেতাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখছে। সম্প্রতি কয়েকজন ছাত্রনেতাকে পরিচয় গোপন করে ফোনে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অনেক আগেই একটি সংস্থা ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েমের নিরাপত্তাঝুঁকি রয়েছে বলে রিপোর্ট দিয়েছিল।
জানা গেছে, ইতোমধ্যে কয়েকজনের জন্য সশস্ত্র বডিগার্ড এবং চলাচলকালীন বিশেষ নিরাপত্তা বলয় নিশ্চিত করা হয়েছে। তারা যেসব জনসভা বা কর্মসূচিতে অংশ নেবেন, সেখানে আগাম নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরির ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বারবার আওয়ামী হামলার শিকার হওয়া, ভারতীয় হেজিমনির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সবচেয়ে সোচ্চার ব্যক্তিত্ব মাহমুদুর রহমানকে নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হলে তিনি বিষয়টি বিবেচনা করতে সময় চেয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ঝুঁকি বিবেচনায় তার নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার : ‘ডিজিটাল হিটলিস্ট’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ফেসবুকের কিছু গ্রুপ (‘বি জয়েন্ট’ বা ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত পেজগুলো) থেকে নিয়মিতভাবে আধিপত্যবাদবিরোধী ব্যক্তিদের ছবি দিয়ে ‘পাবলিক এনিমি’ হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। এই তালিকার ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত ফোন নম্বর এবং বর্তমান অবস্থান ডার্ক ওয়েবে শেয়ার করার প্রমাণও পেয়েছে কিছু সাইবার নিরাপত্তা সংস্থা। সংশ্লিষ্টদের মতে, এটি একটি বহুমুখী প্রক্রিয়া। প্রথম ধাপে শুরু হয় চরিত্রহনন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ভারত-বিদ্বেষী’ বা ‘উগ্রবাদী’ তকমা দিয়ে জনবিচ্ছিন্ন করা। দ্বিতীয় ধাপে পেশাগত ও পারিবারিক চাপ সৃষ্টি করা হয়। আর চূড়ান্ত পর্যায়ে শারীরিক আক্রমণ বা গুমের হুমকি দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়ায় ‘ডিজিটাল নজরদারি’ একটি ভয়ংকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অভিযোগ আছে, প্রতিবেশী দেশের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে টার্গেট ব্যক্তিদের ফোন কল ট্র্যাক করা, এনক্রিপ্টেড মেসেজ পড়া এবং তাদের রিয়েল-টাইম লোকেশন বা বর্তমান অবস্থান শনাক্ত করা হচ্ছে।
ফেসবুক এবং এক্সে একটি শক্তিশালী চক্র নিয়মিতভাবে ‘হিটলিস্ট’ প্রচার করছে। বিশেষ করে কিছু নামহীন পেজ থেকে এই ৫০ ব্যক্তির দৈনন্দিন গতিবিধি ও ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করা হচ্ছে। সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি একটি সুপরিকল্পিত ‘সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার’ বা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। এর মাধ্যমে সমালোচকদের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে যাতে তারা সীমান্ত হত্যা বা তিস্তা চুক্তির মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দেন। অভিযোগ রয়েছে, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত কিছু টেলিকম সংস্থার ডেটা ব্যবহার করে টার্গেট ব্যক্তিদের ‘ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট’ ট্র্যাক করা হচ্ছে।
নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, আওয়ামী লীগের একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী যারা বর্তমানে আত্মগোপনে বা বিদেশে অবস্থান করছে, তারা প্রতিবেশী দেশের কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগসাজশ করে এই ‘কিলিং মিশন’ পরিচালনা করছে। এরা সরাসরি কোনো সংস্থার নাম ব্যবহার না করে ‘স্লিপার সেল’ বা ‘ভাড়াটে অপরাধী’ ব্যবহার করছে। ফলে কোনো হামলা সফল হলে তার দায়ভার কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ওপর চাপানো কঠিন হয়ে পড়ে। হাদির ওপর হামলার ক্ষেত্রেও একই কৌশল দেখা গেছে।
নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর গৃহীত বিশেষ পদক্ষেপ
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, এই ৫০ জনের নিরাপত্তায় বর্তমানে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে—এসকর্ট টিম ও সেফ হাউস। গুরুত্বপূর্ণ মুভমেন্টের সময় ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে সাদা পোশাকে সশস্ত্র নিরাপত্তা কর্মী থাকছেন। পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক হলে তাদের জন্য অস্থায়ীভাবে ‘সেফ হাউস’ ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়েছে।
নিরাপত্তাব্যবস্থা ও গোয়েন্দা তৎপরতা সূত্রমতে, তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের নিরাপত্তায় একটি কেন্দ্রীয় সমন্বয় সেল গঠন করা হয়েছে। তাদের চলাচলকালীন অন্তত একজন করে সশস্ত্র বডিগার্ড নিশ্চিত করা হচ্ছে। এছাড়া তারা যখন কোনো সভা বা সমাবেশে অংশ নিচ্ছেন, তখন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আগে থেকেই সেই এলাকা তল্লাশি করে নিরাপত্তা বেষ্টনী নিশ্চিত করছে। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকা বা ঢাকার বাইরে ভ্রমণের সময় এই নিরাপত্তা আরো কঠোর করা হয়েছে।
হাদির ওপর হামলার পর হামলাকারী হিসেবে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল করিম মাসুদকে ইতোমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। হামলার পরপর র্যাব ও ডিবিসহ নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টায় দ্রুত সময়ের মধ্যে দোষী ব্যক্তির পরিচয় জানা যায়। তবে এই ঘটনার পেছনে বৃহত্তর কোনো আঞ্চলিক গোয়েন্দা সংস্থার যোগসূত্র আছে কি না, সেই তদন্ত কার্যত উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র মনে করে, এই হামলাটি ছিল একটি ‘টেস্ট কেস’। এটি দেখার জন্য যে, আধিপত্যবাদবিরোধী নেতাদের ওপর হামলা হলে রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া কেমন হয়। হাদি দীর্ঘদিন ধরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অসম পানি বণ্টন চুক্তি, সীমান্তে বিএসএফের হাতে বাংলাদেশি হত্যা এবং ট্রানজিট-করিডোর ইস্যু নিয়ে তরুণ প্রজন্মকে সংগঠিত করছিলেন। জনাকীর্ণ স্থানে তাকে হত্যার এই প্রচেষ্টা মূলত একটি ‘সতর্কবার্তা’—যারা দিল্লির নীতির সমালোচনা করবে, তাদের পরিণতি হবে ভয়াবহ। নিরাপত্তা মহলের একটি অংশ দাবি করছে, এই হামলার পেছনে কোনো গভীর গোয়েন্দা ষড়যন্ত্র বা ‘ছায়া শক্তি’র ইন্ধন থাকতে পারে, যারা আওয়ামী লীগের পলাতক বা আত্মগোপনে থাকা ক্যাডারদের ‘ভাড়াটে খুনি’ হিসেবে ব্যবহার করছে।
নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ায় শেখ হাসিনার শাসনামলের মতো বাংলাদেশে নিজেদের ইচ্ছামতো সব এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারছে না ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্ট। এসব কারণে নানাভাবে এদেশে অস্থিরতা তৈরিতে ইন্ধন ভারত যে দিচ্ছে, এ বিষয়ে অনেকটাই নিশ্চিত নিরাপত্তা সংস্থাগুলো।
সংস্থারগুলোর একাধিক উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তার মতে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক হতে হবে সমমর্যাদার। কিন্তু যখনই এই ন্যায্য দাবিকে ‘ভারত-বিদ্বেষ’ বলে গালি দিয়ে মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়, তখনই বোঝা যায় প্রতিবেশী রাষ্ট্র একটি বিপজ্জনক পথে হাঁটছে। তারা সতর্ক করছেন যে, আজ যারা ভারতের আধিপত্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তাদের যদি নিরাপত্তা না দেওয়া যায়, তবে দেশ তার মেরুদণ্ড হারাবে। এই নীরব সন্ত্রাস রুখতে প্রয়োজন একটি জাতীয় ঐক্য। তাদের সুপারিশ—স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। ডিজিটাল অধিকার রক্ষা, মতপ্রকাশের নিরাপত্তা এবং প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা—এই তিনটি স্তম্ভ শক্ত না হলে পরিস্থিতি আরো জটিল হবে।
কেন এই কণ্ঠস্বরগুলো এত ভয়ের কারণ? সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা সূত্র জানায়, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন আর কেবল পররাষ্ট্রনীতির বিষয় নয়, এটি সরাসরি সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিস্তা নদীর পানি না পাওয়া, সীমান্তে বিচারহীনভাবে বাংলাদেশি হত্যা এবং বাণিজ্যে আকাশচুম্বী ঘাটতি—এসব নিয়ে জনমানসে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে। এই ক্ষোভকে যখন তারেক রহমান, মাহমুদুর রহমান, ডা. শফিকুর রহমান বা নাহিদ ইসলামের মতো নেতারা কণ্ঠ দেন, তখন তা দিল্লির ‘পাপেট স্টেট’ বা আজ্ঞাবহ রাষ্ট্র বানানোর স্বপ্নকে বাধাগ্রস্ত করে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আবরার ফাহাদের উত্তরসূরি হিসেবে যে দেশপ্রেম জাগ্রত হয়েছে, তাকে রুখে দিতেই এই ‘টার্গেট কিলিং’ ক্যাম্পেইন।
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

