প্রাধান্য পাবে জাতীয় সনদ থাকছে আইনি ভিত্তি

মাহফুজ সাদি
প্রকাশ : ১৫ আগস্ট ২০২৫, ১১: ১৬
আপডেট : ১৫ আগস্ট ২০২৫, ১১: ১৭
ছবি: সংগৃহীত

নতুন বাংলাদেশ গড়তে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে জুলাই সনদের সমন্বিত খসড়া প্রস্তুত করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এতে জুলাই সনদের কোনো শব্দ, বাক্য ও নীতিমালা সংবিধান বা অন্য কোনো আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে সনদকে প্রাধান্য দেওয়া ও অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো জাতীয় নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়নের কথা আছে। জাতীয় সনদকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার পাশাপাশি দলগুলোর পক্ষ থেকে দাবি আসায় সনদের আইনি ভিত্তিও দেওয়ার কথা রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন, প্রধানমন্ত্রীর দলীয় প্রধান না হওয়া, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাসহ কিছু বিষয় সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের বাধ্যবাধকতার কথা বলা হয়েছে। তবে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে দ্বিকক্ষের বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ও উল্লেখ থাকছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম এবং জুলাই সনদের অগ্রগতি প্রধান উপদেষ্টা ও কমিশনের সভাপতি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জানান কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কমিশনের কাজের অগ্রগতি, জুলাই সনদের সমন্বিত খসড়া ও সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করা হয়েছে। এছাড়া কবে নাগাদ দলগুলোর কাছে সনদের কপি পাঠানো যাবে, দলগুলোর সঙ্গে আবার কবে বসা সম্ভব হবে—সেসব বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানান তিনি।

সূত্রমতে, প্রধান উপদেষ্টার মতামতের আলোকে সমন্বিত খসড়াটি ঠিক করে আজ শুক্রবারের মধ্যে দলগুলোর কাছে পাঠাবে কমিশন। দলগুলোকে আগামী সপ্তাহের মধ্যে চূড়ান্ত মতামত দিতে বলা হবে। তার ভিত্তিতে স্বাক্ষরের জন্য জুলাই সনদ প্রস্তুত করা হবে।

জানা গেছে, জুলাই সনদের সমন্বিত চূড়ান্ত খসড়ায় তিনটি ভাগ রয়েছে। এর প্রথম ভাগে পটভূমি, সংস্কার কমিশন গঠন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন এবং কমিশনের কার্যক্রমের বর্ণনা; দ্বিতীয় ভাগে দলগুলোর ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো এবং শেষ ভাগে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ৯ দফা অঙ্গীকারনামা রয়েছে। এছাড়া যেসব বিষয়ে দলগুলো ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে, তাও উল্লেখ থাকছে সনদে।

সূত্র জানায়, জুলাই সনদের সমন্বিত খসড়ার একটি নমুনা গত ২৯ জুলাই সংলাপে অংশ নেওয়া ৩০টি দল ও জোটকে দিয়েছিল কমিশন। এর মধ্যে ২৮টি দল সেটির ওপর মতামত দিয়েছে কমিশনকে। তাতে ১৮টি দল নির্বাচনের আগে মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়ন এবং জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি চেয়েছে। সনদ বাস্তবায়নে দলগুলোর এ মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে সেভাবে এগিয়েছে কমিশন। এতে দলগুলোর সনদে স্বাক্ষর করার আশা করছে কমিশন।

সূত্রমতে, জুলাই সনদের প্রথম ভাগে পটভূমিতে জনগণের মনে রাষ্ট্রকাঠামো পুনর্গঠনের প্রবল অভিপ্রায়, রাষ্ট্র-সংবিধানের মৌলিক সংস্কার, ধ্বংসপ্রাপ্ত নির্বাচনব্যবস্থার পুনর্গঠন, গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় আইন ও বিধি-বিধানের সংস্কার, স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা এবং জবাবদিহিমূলক সুশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি এবং এর সদ্ব্যবহার করাকে নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

সনদের দ্বিতীয় ভাগে দলগুলোর ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে। এই অংশে রাষ্ট্রভাষা, নাগরিকত্ব ও সংবিধানের ছয়টি বিষয় রয়েছে। তারপর রয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ও মৌলিক অধিকার। ১০-১৩ ধারায় রাষ্ট্রপতি, ১৪-১৬ ধারায় প্রধানমন্ত্রী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, ১৭-২০ ধারায় স্থানীয় সরকারব্যবস্থা, ২১-২৯ ধারায় আইনসভা, ৩০-৫০ পর্যন্ত বিচার বিভাগ, ৫১-৫৩ পর্যন্ত নির্বাচনব্যবস্থা, ৫৪-৫৭ ধারায় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, ৫৮-৬৪ ধারায় জনপ্রশাসন, ৬৫ ধারায় স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন, ৬৪-৮৪ ধারায় দুর্নীতি দমন কমিশনের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে।

এরমধ্যে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পাশাপাশি দেশের অন্য নাগরিকদের ভাষাকে প্রচলিত ভাষার স্বীকৃতি, বাংলাদেশের নাগরিকদের ‘বাংলাদেশি’ পরিচয়, সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতির কথা উল্লেখ আছে, যাতে আপত্তি আছে সিপিবি, বাসদ, জেএসডি, বাংলাদেশ জাসদ, বাসদ-মার্কসবাদী, গণফোরামসহ কয়েকটি দলের।

দ্বিকক্ষের আইনসভার উচ্চকক্ষের ১০০ সদস্য সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের (পিআর) ভিত্তিতে নির্বাচনের কথা থাকছে জুলাই সনদে। দলগুলোকে নিম্নকক্ষের নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রার্থী প্রকাশের সঙ্গে উচ্চকক্ষের প্রার্থিতার পাশাপাশি ১০ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনীত করার বাধ্যবাধকতার কথা বলা হচ্ছে। তবে বিএনপিসহ তার সমমনারা পিআরের উচ্চকক্ষের বিপক্ষে আর সিপিবি, বাসদ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং আমজনতার দল উচ্চকক্ষের বিরুদ্ধে।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে অর্থবিল ও আস্থাভোট ছাড়া সব বিষয়ে দলের বিপক্ষে ভোটের সুযোগের কথা আছে। তবে বিএনপিসহ তার সমমনারা দুটির সঙ্গে সংবিধান সংশোধন ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যোগ করার পক্ষে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে সাবেক বিচারপতিদের জন্য পালনীয় আচরণবিধি প্রণয়ন ও প্রকাশ এবং শৃঙ্খলা ব্যবস্থা হিসেবে সতর্ক করার পাশাপাশি ‘বিচারপতি’ পদবি ব্যবহার না করার বিষয়টিও থাকবে। আদালত প্রাঙ্গণে দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের পাশাপাশি আইনজীবীদের সংগঠনকে রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতি দেওয়া যাবে না।

নির্বাচন কমিশন, স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন, ন্যায়পাল, সরকারি কর্ম কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের নিয়োগে বাছাই কমিটি করার বিধান সংবিধানে যুক্ত করার বিষয়ে একমত দলগুলো। তবে সাংবিধানিক সংস্থায় নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে আপত্তি আছে বিএনপিসহ সমমনাদের। স্থানীয় সরকার নির্বাচনব্যবস্থা নির্বাচন কমিশনের কাছে হস্তান্তরের কথা আছে।

শেষ ভাগে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ৯ দফা অঙ্গীকারনামায় জুলাই সনদের ব্যাখ্যা, প্রয়োগ ও বৈধতাসংক্রান্ত বিষয়গুলোর এখতিয়ার আপিল বিভাগের ওপর ন্যস্ত থাকা এবং সনদকে সম্পূর্ণ আইনগতভাবে কার্যকর হিসেবে গণ্য করা এবং এর বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা কিংবা জারির কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে আদালতেও প্রশ্ন তোলা যাবে না বলে উল্লেখ রাখা হয়েছে। সনদের কোনো শব্দ, বাক্য ও নীতিমালা সংবিধান বা অন্য কোনো আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে সনদকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা থাকছে অঙ্গীকারনামায়। অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে বিবেচিত এ সনদের সুপারিশগুলো কালক্ষেপণ না করে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর জাতীয় নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়নের যথাযথ ও কার্যকর পদক্ষেপের কথা আছে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারে ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে তা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে সরকার। প্রথম ধাপে ১৬৬ প্রস্তাব নিয়ে ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে সংলাপ করে কমিশন। সেখানে ৬২টি প্রস্তাবের বিষয়ে ঐকমত্য হয়। এরপর দ্বিতীয় ধাপের সংলাপে ২০টি বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয় কমিশন। এ সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত