চট্টগ্রাম বন্দরে একের পর এক কন্টেইনারে তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত হচ্ছে। গত এক বছরে এমন অন্তত ৫টি কন্টেইনার শনাক্ত করা হয়েছে। সবশেষ গত বুধবার ব্রাজিল থেকে আসা স্ক্র্যাপ বোঝাই কন্টেইনারে তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত করেছে কাস্টম হাউস।
এ ছাড়া ২০১৪ সাল থেকে বিভিন্ন সময় আটক ১৪ কন্টেইনার বন্দরে তেজস্ক্রিয়তা ছড়াচ্ছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এসব কন্টেইনার স্থানান্তর করা যাচ্ছে না। ফলে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ‘ফুসফুস’খ্যাত এই বন্দর ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।
বন্দর সূত্র জানায়, ঢাকার ডেমরার রড তৈরির কারখানা আল আকসা স্টিল মিলস লিমিটেড ব্রাজিল থেকে পাঁচটি কনটেইনারে ১৩৫ টন স্ক্র্যাপ আমদানি করে। গত ৩ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরের জিসিবি টার্মিনালের ৯ নম্বর জেটিতে ‘এমভি মাউন্ট ক্যামেরন’ নামের একটি জাহাজ থেকে কনটেইনারগুলো বন্দরের ইয়ার্ডে নামানো হয়। দাপ্তরিক কাজ শেষে বুধবার কন্টেইনারগুলো খালাস নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন আমদানিকারক।
বন্দরের ৪ নম্বর ফটক দিয়ে বের হওয়ার সময় একটি কন্টেইনারে মেগাপোর্টের যন্ত্রে তেজস্ক্রিয়তা থাকার সংকেত বেজে ওঠে। তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া কনটেইনারটি স্ক্র্যাপ বা পুরোনো লোহার টুকরায় ভর্তি। তেজস্ক্রিয়তা শনাক্তকরণ যন্ত্রে প্রাথমিক ও দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায় কনটেইনারের অভ্যন্তরে তিনটি রেডিওনিউক্লাইড আইসোটোপের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই তিনটি হলো থোরিয়াম ২৩২, রেডিয়াম ২২৬ ও ইরিডিয়াম ১৯২।
বন্দরের ট্রাফিক বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে মাত্রাতিরিক্ত তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানো ১৪টি কন্টেইনার রয়েছে। যার মধ্যে ৫টি কন্টেইনার আমদানি করা আর ৯টি রপ্তানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। আমদানি কন্টেইনারগুলোর মালিক বিভিন্ন রি-রোলিং মিল কর্তৃপক্ষ। আর রপ্তানি পণ্যবাহী কন্টেইনারগুলোর মধ্যে রয়েছে পুরোনো জাহাজের বিভিন্ন অংশ। ব্রাজিল থেকে আসা তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানো কন্টেইনারটি আটক হওয়ার পর পুরোনো কন্টেইনারগুলো নিয়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়। বন্দরের পক্ষ থেকে এসব কন্টেইনার দ্রুত অপসারণ করার তাগাদা দিয়ে কাস্টমসকে চিঠিও দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ মারুফুর রহমান জানান, প্রাথমিক পরীক্ষায় কন্টেইনারটিতে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা পাওয়া গেছে এক মাইক্রোসিয়েভার্টস। এটি উচ্চমাত্রার নয়। তবে লোহার টুকরোভিত্তিক কন্টেইনার ভেদ করে আসা তেজস্ক্রিয়তার এই মাত্রা সঠিক নয়। তাই বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা করার আগে কিছু বলা যাবে না। প্রাথমিকভাবে কন্টেইনারটির খালাস প্রক্রিয়া স্থগিত করে বন্দরের বিশেষায়িত এলাকায় সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে। এখন পরমাণু শক্তি কমিশনকে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে। তাদের বিশেষজ্ঞ দল বন্দরে এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত জানালে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পরমাণু শক্তি কেন্দ্র চট্টগ্রামের পরিচালক শাহাদাৎ হোসেন জানান, এমন তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানো কন্টেইনার হরহামেশাই শনাক্ত করা হচ্ছে। গত এক বছরে এমন অন্তত ৫-৬টি কন্টেইনারে তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত হয়েছে। তবে তা বেশিরভাগই সহনীয় পর্যায়ে ছিল। পরমাণু শক্তি কমিশনের বিশেষজ্ঞ দল কন্টেইনার খুলে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানো বস্তু আলাদা করে ডাম্পিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। সর্বশেষ যে কন্টেইনারে তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া গেছে, সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বন্দর সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে সর্বপ্রথম তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানো কন্টেইনার শনাক্ত হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। পরে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তেজস্ক্রিয়তাসম্পন্ন আরো একটি করে কন্টেইনার শনাক্ত করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। সেই কন্টেইনারগুলোও আলাদা করে রাখা হয়েছে তখন থেকেই। ২০১৮ সালের পর থেকে তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানো কন্টেইনার শনাক্তের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের ডেনজারাস কার্গো পয়েন্টে কন্টেইনারগুলো আলাদা করে রাখা হয়েছে। ২০২০ সালের ৪ আগস্ট লেবাননের বৈরুত বন্দরে বিস্ফোরণের পর ঝুঁকিপূর্ণ কন্টেইনারগুলো সরানোর উদ্যোগ নেয় বন্দর ও কাস্টমস। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তা সফল হয়নি এখনো।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক জানান, তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানো কন্টেইনারগুলোসহ সব ধরনের নিলামযোগ্য কন্টেইনার সরিয়ে নিতে বারবার তাগাদা দেওয়া হচ্ছে কাস্টমসকে। কিন্তু অশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানো কন্টেইনারগুলোর কারণে বন্দরের ঝুঁকি বাড়ছে কি না—এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ফয়সাল ইসলাম চৌধুরী জানান, এ ধরনের কন্টেইনার বিশেষ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করতে হয়। নইলে এগুলো থেকে ছড়ানো তেজস্ক্রিয়তা মানবদেহের জন্য ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারে। এ ছাড়া যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটাতে পারে। তাই এমন কন্টেইনার শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যথাযথ প্রটোকল অনুসরণ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার করণে যদি এমন ঝুঁকিপূর্ণ কন্টেইনার বন্দরের মতো এলাকায় ফেলে রাখা হয়, সেটা ওই এলাকার মানুষের পাশাপাশি বন্দরের জন্যই বড় ধরনের ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ মারুফুর রহমান জানান, ঝুঁকিপূর্ণ কন্টেইনারগুলো ধ্বংস করার প্রক্রিয়া শেষের পথে। ইতোমধ্যে কন্টেইনারগুলোর ইনভেন্টরি হয়ে গেছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে নিলামের মাধ্যমে উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানকে এগুলো ধ্বংস করার দায়িত্ব দেওয়া হবে।

