বিডিআর হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পরেই পিলখানা মসজিদের পেশ ইমাম সিদ্দিকুর রহমানের মৃত্যু ঘিরে উঠেছিল গুরুতর প্রশ্ন। ২০০৯ সালের আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি সরাসরি এমন কিছু কথা ও দৃশ্যের সাক্ষী ছিলেন, যা পরবর্তীতে তদন্ত প্রতিবেদনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সেটিই তার জীবনের জন্য কাল হয়ে এসেছিল।
পিলখানা হত্যাকাণ্ড চলাকালে সেখানে উপস্থিত বিদ্রোহীদের কেউ হিন্দিতে, কেউ ইংরেজিতে কথা বলছিল—এমন তথ্য পিলখানা মসজিদের ইমাম সিদ্দিকের কাছে ছিল এবং পরবর্তী সময়ে জবানবন্দিতে তিনি এসব উল্লেখ করেছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, এ তথ্যগুলোর কারণেই পুলিশ হেফাজতে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
পিলখানায় সংঘটিত বিদ্রোহের ঘটনা তদন্তে গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গত ৩০ নভেম্বর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। সেই প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ইমাম সিদ্দিক পরিবারসহ পিলখানা ত্যাগ করেন। পহেলা মার্চ সন্ধ্যা ছয়টায় তাকে ফের পিলখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। তবে তার পরিবারকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ২০০৯ সালের ১০ মার্চ সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত তিনি ফোনে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। ওই সময় পর্যন্ত তিনি সুস্থ ছিলেন।
স্ত্রীকে তিনি জানান, তাকে নিয়মিত জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল। তিনি বলেন, পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাহহার আকন্দ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। তিনি সে সময় বিডিআর অফিসারদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাহায্য চাওয়ার বিষয়টি এবং বিদ্রোহীদের হিন্দি ও ইংরেজিতে কথা বলার বিষয়টি তাদের জানান। জবাবে তাকে বলা হয়, তার কথা বলার প্রয়োজন নেই, শুধু একটি কাগজে স্বাক্ষর করতে হবে।
তিনি আরো জানান, তাকে প্রচণ্ড ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছিল। বিশেষ করে অন্য বিডিআর সদস্যদের ওপর চালানো নির্যাতন তাকে সরাসরি দেখানো হয়। তাকে দেখানো হয় কীভাবে বিডিআর সৈনিকদের পুরুষাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হচ্ছে। তাকে বলা হয়, দেওয়া কাগজে স্বাক্ষর না করলে তার অবস্থাও এ রকমই হবে।
১০ মার্চ দুপুর ২টায় আব্দুল কাহহার আকন্দ তাকে দরবার হলে ডেকে নেন। সেখানে তাকে জবানবন্দি পরিবর্তনের পাশাপাশি রাজসাক্ষী হতে চাপ দেওয়া হয় এবং নতুন করে ভয়ভীতি দেখানো হয়। এ সময় তিনি হঠাৎ ঘামতে শুরু করেন। পরিস্থিতি দেখে আব্দুল কাহহার আকন্দ বলেন, তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং দ্রুত তাকে বিডিআর হাসপাতালে নেওয়ার নির্দেশ দেন।
ইমাম সিদ্দিক তখন টেলিফোনে স্ত্রীকে জানান, বিডিআর হাসপাতালে তাকে শুধু ইনজেকশন ও স্যালাইন দেওয়া হয়েছিল। ওই দিনই সন্ধ্যা ছয়টায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। বিষয়টি জানালে তার স্ত্রী ৩০ মিনিটের মধ্যেই ছোট ভাইকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছান এবং তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেন। সেখানে তিনি আবারও জানান, কীভাবে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে এবং আব্দুল কাহহার আকন্দ কীভাবে স্বাক্ষর নেওয়ার জন্য ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। একপর্যায়ে তিনি স্ত্রীকে বলেন, ‘আব্দুল কাহহার আকন্দ একজন ইবলিস শয়তান।’
হাসপাতালের শয্যায় শুয়েও তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, তিনি কখনো মিথ্যা সাক্ষ্য দেবেন না এবং যা দেখেননি তা বলবেন না। এর পরদিন ১১ মার্চ সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে তিনি হঠাৎ মারা যান। তার মৃত্যুর পর সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানেই ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়।
পরে তার স্ত্রী কামরুন নাহার শিরিন জানান, তাকে বলা হয়েছিল ইমাম সাহেবের ওপর কোনো শারীরিক নির্যাতন করা হয়নি। তবে তাকে রাজসাক্ষী হওয়ার জন্য এবং আব্দুল কাহহার আকন্দের নির্দেশ অনুযায়ী জবানবন্দি দিতে ক্রমাগত চাপ দেওয়া হয়েছিল।
পিলখানা মসজিদের ইমাম সিদ্দিকুর রহমানের স্ত্রী তার স্বামীর বরাতে আরো বলেন, ঘটনার সময় উত্তর দিক থেকে একটি পিকআপ এসে দরবার পশ্চিম গেটে দাঁড়ায়। সেখান থেকে বিপুল সংখ্যক সৈনিক অস্ত্রসহ নেমে আসে। তারা হিন্দি ও ইংরেজিতে কথা বলছিল। তার স্বামী সেই কথোপকথন শুনেছিলেন এবং তারা অন্য সৈনিকদের গুলি চালানোর জন্য নির্দেশ দিচ্ছিল। সৈনিকরা হিন্দি ও ইংরেজিতে ঠিক কী বলেছিল, তা তিনি তাকে জানালেও বর্তমানে তা স্মরণে নেই।
এই ঘটনায় পিলখানার পেশ ইমামের হেফাজতে মৃত্যু, তার ওপর দেওয়া চাপ, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং জবানবন্দি পরিবর্তনের চেষ্টা–সব মিলিয়ে একটি গভীর উদ্বেগজনক চিত্র সামনে এসেছে, যা আজও নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়।

