আওয়ামী সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য রাজধানীর আনন্দবাজার

মাহমুদা ডলি
প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০২৫, ১০: ২১
আপডেট : ২৫ মার্চ ২০২৫, ১৫: ৩৬

অবৈধ দখলে থাকা রাজধানীর নিমতলী আনন্দবাজার এখনো আওয়ামী সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য। অস্ত্র বেচাকেনা, চাঁদাবাজি, মাদকদ্রব্য থেকে শুরু করে স্থানীয় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা এখানে বসে বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম করে আসছে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময় তিন থানার লুটের অস্ত্র ছাড়াও পুলিশ সদর দপ্তর থেকে শুরু করে এ এলাকায় ফেলে যাওয়া অবৈধ অস্ত্রগুলো আনন্দবাজারের সন্ত্রাসীদের কাছে।

সূত্র জানিয়েছে, ফুলবাড়িয়া মার্কেট, বঙ্গবাজারসহ স্থানীয় মার্কেটগুলোতে অবৈধ দখলদার আওয়ামী সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি চলছে পূর্ণোদ্যমে। একদিকে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, অন্যদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মাঝখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; গুরুত্বপূর্ণ এসব এলাকা দীর্ঘদিন নিমতলী আনন্দবাজার সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে। সেখানে প্রকাশ্যে চলে মাদক ব্যবসা।

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ওসি খালিদ মনসুর আমার দেশকে বলেন, এ ব্যাপারে প্রশাসনের কাছেও তথ্য রয়েছে। অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারে বিভিন্ন স্থানে যৌথবাহিনীর অভিযান চলমান। ক্রমান্বয়ে সব জায়গায় অভিযান চালানো হবে। তবে আনন্দবাজারে কবে অভিযান চালানো হবে, সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি তিনি।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, যুগের পর যুগ বেদখল হওয়া আনন্দবাজারের অবৈধ দখলদার আওয়ামী লীগ নেত্রী ও সাবেক কাউন্সিলর সৈয়দা রোকসানা ইসলাম চামেলি। তিনি স্থানীয় সন্ত্রাসীদের মদত দিয়ে দিচ্ছেন। সরকারি জমি দখল করে মার্কেট ও বাড়িঘর নির্মাণ করে চামেলির পরিবার বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছে। ৫ আগস্টের পর ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আত্মগোপনে চলে গেলেও চামেলি রয়েছে প্রকাশ্যে। কিন্তু তার ব্যাপারে প্রশাসন উদাসীন।

সূত্র জানিয়েছে, গণঅভ্যুত্থানে পুলিশের লুটের অস্ত্র চামেলির দখলে। তার কাছে আছে খিলক্ষেত থানাসহ তিন থানার লুটের অস্ত্র। চামেলির সঙ্গে আওয়ামী লীগের পলাতক ডজনখানেক সন্ত্রাসী ওই এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন ওসমান আলী ওরফে ড্রাইভার ওসমান ওরফে জামাই ওসমান। তিনি রাজধানীর কাকরাইল-শান্তিনগরের ১৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা।

চামেলি বর্তমানে আওয়ামী সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বেশ তৎপর। যদিও বিভিন্ন কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকায় আওয়ামী লীগ তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে। তবুও গণঅভ্যুত্থানের পর দলের জন্য নিরাপদ ঘাঁটি হিসেবে আনন্দবাজারে তৎপরতা চালাচ্ছেন তিনি। বিশেষ করে ‘ঢাকা-৮ আসন’ নামক একটি গোপন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে চামেলির তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। ওই গ্রুপে আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড, থানা মহানগর ও কেন্দ্রীয় নেতা-নেত্রীরা যুক্ত আছেন। গ্রুপটি ব্যবহার করে তারা দেশবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ড করছেন। শেখ হাসিনার নজরে পড়তে বেশি তৎপরতা দেখাচ্ছেন চামেলি।

প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা

রাজধানীর প্রধান প্রধান স্পটগুলোর মধ্যে আনন্দবাজার বস্তি অন্যতম যেখানে নির্বিঘ্নে মাদক ব্যবসা চলছে। এখানে রয়েছে মাদক সম্রাজ্ঞী হিসেবে চিহ্নিত বানুর মাদক স্পট। তার সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে নিমতলী বস্তির সাবিনা ও পারুলের। এখানে চার ধরনের মাদকÑইয়াবা, প্যাথেড্রিন, হিরোইন ও গাজার আদান প্রদান হয় । মাদক বিক্রির স্পটগুলো হলোÑ বস্তি, বাবুপুরা, ফুলবাড়িয়া, গুলিস্তান। ‘বড়দার’ কামাল, কামালের বউ ফালানি, জলিল পাটোয়ারীর ছেলে জামান এই তিনজনের মাধ্যমে এখানে মাদক বেচাকেনা চলছে বলে কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে।

যুগের পর যুগ বেদখল আনন্দবাজার

রাজধানীর পুরান ঢাকার বঙ্গবাজারসংলগ্ন আনন্দবাজার এলাকার ৩.৯৭ একর রেলভূমি অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে একটি প্রভাবশালী মহল। জমি উদ্ধারের জন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ আইনি লড়াই চালালেও দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই এ জমিতে গত ৫০ বছরে একের পর এক বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করেছে অবৈধ্য দখলদাররা। আশ্চর্যের বিষয় হলো- সরকারি বিধি অমান্য করে এই জায়গায় অবৈধ ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের নিয়মিত ট্রেড লাইসেন্স দিচ্ছে সিটি করপোরেশন। এই কাজের সঙ্গে ডেসকো, তিতাস, ওয়াসার কিছু অসাধু কর্মকতা-কর্মচারী জড়িত।

রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই সরকারের এতগুলো প্রতিষ্ঠানের নাকের ডগায় এই চরম অনিয়ম ও নৈরাজ; অথচ কারো টনক নড়ছে নাÑ এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে। শুধু রেলবিভাগ নয়, রাজউক, সিটি করপোরেশন, ডেসকো, তিতাস ও ওয়াসা কেউই দায় এড়াতে পারে না বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, ১৯৬৮ সালে ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের কার্যক্রম কমলাপুরে স্থানান্তরিত হওয়ার পর থেকে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল আনন্দবাজারের জমি দখলের অপচেষ্টা শুরু করে। ১৯৭৪ সালে মীর্জা আশরাফ গং ভুয়া দলিল তৈরি করে ৩.৯৭ একর জমির মালিকানা দাবি করে। সে সময়ের অবৈধ দখলদারদের কেউ কেউ মারা গেলেও তাদের বংশধররা বর্তমানে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত সংরক্ষিত মহিলা কমিশনার রোখসানা ইসলাম চামেলির স্বামী, ভাই, বোন ও ভগ্নীপতি জোটবদ্ধভাবে জমিগুলো দখল করে রেখেছেন। খোদ রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে সরকারের মূল্যবান এ জমি দখল করে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, পতিতাবৃত্তিসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন তারা।

ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ফুলবাড়িয়া এখন রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা। অথচ ৫০ বছর আগেও এটি দেশের প্রধান রেলস্টেশন (ফুলবাড়িয়া) ছিল। সেই সুবাদে আনন্দবাজারে মোট ৩.৯৭ একর জমির মালিক সরকার। জমি হারানোর কারণে প্রতি বছর সরকার শত শত কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে।

নিমতলী ও পুরোনো সেক্রেটারিয়েট রোডের মধ্যে পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বী স্থানটি আনন্দবাজার। ২০১২ সালে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের ৩.৯৭ একর জমির মধ্যে ১.১০ একর জমি আনন্দবাজার বণিক সমিতির (পরবর্তী সময়ে আনন্দবাজার রেলওয়ে সুপার মার্কেট লিমিটেড) নামে লিজ প্রদান করে। বৈধভাবে রেলওয়ের লাইসেন্স গ্রহণ করে নির্দিষ্ট হারে খাজনা, ভ্যাট ও অফিস খরচাদি পরিশোধ করে তারা। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ ১.১০ একর জমি লিজ গ্রহীতাদের বুঝিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়।

বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় জারি করা রেল কর্তৃপক্ষের সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রেলের মালিকানাধীন এই জমির অংশ কারো কাছে স্ট্যাম্পের মাধ্যমে বেচাকেনা, বন্ধক ও হস্তান্তর বেআইনি এবং অকার্যকর।

স্থানীয় সচেতন মহল বলছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানপরবর্তী সময়ে সরকারি সম্পদ রক্ষার জন্য প্রশাসনের আশু হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। অন্যথায় আগামী শত বছরেও আনন্দবাজার আলোর মুখ দেখবে না।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত