আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

আন্দোলনকারীদের চাকরিচ্যুতি

সচিবালয়জুড়ে কর্মচারীদের মধ্যে বরখাস্ত-ভীতি

বেলাল হোসেন

সচিবালয়জুড়ে কর্মচারীদের মধ্যে বরখাস্ত-ভীতি

প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে আইন ভেঙে বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে বিশৃঙ্খলায় জড়িত ১৪ জনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিরাজ করছে চাপা আতঙ্ক। চাকরি বাঁচাতে দায় এড়ানোর চেষ্টায় আছেন অনেকে, কেউ কেউ বলছেন-আন্দোলন করা ঠিক হয়নি। গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয় ঘুরে এমন ভীতিকর পরিবেশ দেখা যায়।

বিজ্ঞাপন

সচিবালয়ের কর্মীদের কর্মসূচিকে আন্দোলন মানতে নারাজ সরকার। নীতি-নির্ধারকরা বলছেন, কর্মকর্তা-কর্মাচারীদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর নামে এসব কর্মচারী প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করেন। কারণ, বেতন-ভাতা বাড়ানোর জন্য সরকারের নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। এটা জেনেও তারা অহেতুক আন্দোলন করছেন।

গণমাধ্যমে কথা বলার অনুমতি না থাকায় নাম প্রকাশ না করে সরকারের নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, সরকারি চাকরির বিধিমালা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকার জিরো টলারেন্স নীতিতে থাকবে। এমন একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে। কারণ, দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে এই সরকার। এটি একটি চলমান পক্রিয়া। এটা জানিয়ে দেওয়ার পরও কর্মচারীরা যেটা করেছেন, তা চাকরিবিধির স্পষ্ট লংঘন।

এর আগে চলতি মাসের শুরুর দিকে তিন দফা দাবিতে আন্দোলনরত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪২ সহকারী শিক্ষককে স্ট্যান্ড রিলিজ করে ভিন্ন জেলায় বদলি করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। কয়েকদিনের এসব ঘটনায় সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের ভয় কাজ করছে। অনেকেই বিষয়টি নিয়ে তটস্থ।

একই কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, মূলত প্রথমে আন্দোলন ছিল বেতন-ভাতা বাড়ানোর পরে সরকার বিষয়টা নিয়ে পে-কমিশন গঠন করে। এটা অনেকদূর এগিয়ে ছিল। পরে ২০ শতাংশ সচিবালয় ভাতার আন্দোলন করতে গিয়ে বিষয়টা খারাপ হয়েছে। তবে এখন আর এসব আন্দোলনের প্রতি কারো আগ্রহ নেই। বর্তমানে সবাই ভয়ের মধ্যে আছেন।

বিষয়টা নিয়ে কথা হয় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নন ক্যাডার এক কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের সচিবালয় একটা কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠান। এখানে মিছিল-মিটিং করা ঠিক না। আমার যদিও প্রথমে আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ছিল। তবে এখন বিষয়টা নিয়ে আমরা অনেকেই ভাবছি। আর আন্দোলন করা ঠিক হবে না। এ রকম অনেকেই বিষয়টা নিয়ে ভয়ের মধ্যে আছেন।

এছাড়া বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীর একাংশ সংযুক্ত পরিষদে যারা যুক্ত আছেন তারাও ভয়ের মধ্যে থেকেই সচিবালয়ে এসে অফিস করছেন। পাশাপাশি সবার মধ্যেই এক ধনের আতঙ্ক কাজ করছে।

এদিকে গতকাল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিদ্যালয় শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বদলি অর্ডার হওয়া সহকারী শিক্ষকদের নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতে হবে। এখানে মন্ত্রণালয় থেকে কোনো নমনীয়তা দেখাবে না।

বিশেষ সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক খায়রুন নাহার লিপি; বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও নোয়াখালী সদরের কৃপালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শামছুদ্দীন মাসুদ; বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার চানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল কাশেম; প্রাথমিক শিক্ষক দশম গ্রেড বাস্তবায়ন পরিষদের সমন্বয়ক ও জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার হিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহবুবার রহমান বেশ কয়েকদিন ধরেই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে গিয়ে তদবির করেও তাদের বদলির আদেশ ঠেকাতে পারেননি।

সচিবালয় ভাতার দাবিতে আন্দোলনে নেমে অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদকে তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখার ঘটনার পর গ্রেপ্তার হওয়া ১৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে চারজন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের। তারা হলেনÑ বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের একাংশের সভাপতি বাদীউল কবির, অফিস সহায়ক কামাল হোসেন, মো. আলিমুজ্জামান ও নজরুল ইসলাম। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগ মিলিয়ে সাত কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন বরখাস্তের তালিকায়। তারা হলেনÑ প্রশাসনিক কর্মকর্তা রোমান গাজী, শাহীন গোলাম রব্বানী, অফিস সহায়ক আবুল বেলাল, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা তায়েফুল ইসলাম, প্রশাসনিক কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র রায়, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ইসলামুল হক, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মহসীন আলী।

এছাড়া তথ্য মন্ত্রণালয়ের অফিস সহায়ক মিজানুর রহমান, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অফিস সহায়ক নাসিমুল হক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের অফিস সহায়ক বিপুল রানা বিপ্লবকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

গত ১০ ডিসেম্বর দুপুর আড়াইটার দিকে ‘সচিবালয় ভাতা’র দাবিতে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদকে টানা ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় অবরুদ্ধ করে রাখেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ওই দিন তারা দরজার সামনে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দেন এবং উপদেষ্টাকে বের হতে দেননি। পরে রাত ৮টা ১২ মিনিটে পুলিশি নিরাপত্তায় অর্থ উপদেষ্টা সচিবালয় ত্যাগ করেন।

পরদিন ১১ ডিসেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়ায় সচিবালয়ের অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাঝামাঝি ‘বাদামতলা’ এলাকায় কর্মচারীরা জড়ো হন। সেখানে সচিবালয় সংযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিষদের সভাপতি বাদীউল কবিরের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে কর্মচারীদের কর্মবিরতি পালনের ঘোষণা করা হয়। ওই সমাবেশ থেকেই পাঁচজনকে আটক করা হয়। সে সময় ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার সানা শামীনুর রহমান বলেছিলেন, যাদের আটক করা হয়েছে তাদের কার কী ধরনের দায় আছে সেটি যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে। যারা আইন ভেঙেছেন, তাদের মধ্য থেকে বেছে বেছে কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। এটা অব্যাহত থাকলে যতজন আইন ভাঙবেন, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর

খুঁজুন