ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে ধলেশ্বরী নদী থেকে অবৈধভাবে বালু ও মাটি উত্তোলন করার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রদল-যুবদল নেতাদের বিরুদ্ধে। ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু তোলার কারণে ভাঙন ঝুঁকিতে নদীর দুই পাড়ের ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী। তারা অবিলম্বে এটি বন্ধ করতে কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
স্থানীয় ভুক্তভোগীদের অভিযোগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, বালু তোলার সঙ্গে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা জেলা দক্ষিণ ছাত্রদলের সভাপতি পাভেল গোল্লা, জেলা কৃষক দলের আহ্বায়ক জুয়েল মোল্লা, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সেলিম মোল্লা, তেঘরিয়া ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ইসমাইল মোল্লা প্রমুখ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পাভেল মোল্লা, জুয়েল মোল্লা, সেলিম মোল্লা, ইসমাইল মোল্লার অবৈধ ড্রেজার চলছে ধলেশ্বরীর কৃষ্ণনগর ও তার আশপাশের এলাকায়। এ ছাড়া পাভেল মোল্লা, যুবদলের কাইয়ুম ও সেলিম মোল্লার যৌথ উদ্যোগে বসানো ড্রেজার চলছে কৃষ্ণনগর মসজিদের পাশে। কলাবাগানে চলছে মোল্লা ফ্যামিলির আরেক নেতার ড্রেজার। জুয়েল মোল্লার কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক দলের রানার মাধ্যমে চলছে আরেকটি ড্রেজার। এসব ড্রেজারের মাধ্যমে অবাধে জলাশয় ও জমি ভরাট করতে দেখা গেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার তেঘরিয়া ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর (পোরাহাটি) এলাকায় ড্রেজার দিয়ে দিন-রাত চলছে ফসলি জমি, পুকুর ও জলাশয় ভরাটের মচ্ছব। এর আগে এই প্রভাবশালী নব্য ক্ষমতাধর গোষ্ঠী কোন্ডা, রোহিতপুর, বাস্তা ইউনিয়নে রাতের আঁধারে পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় কমপক্ষে ৫০ হাজার বিঘা ফসলি জমি এবং ধলেশ্বরী তীরের সরকারি খাসজমির মাটি চুরি করে কেরানীগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের দুই শতাধিক ইটভাটায় বিক্রি করেছে। ফসলি জমি ও সরকারি জমির মাটি খাওয়া শেষ। এখন অবৈধ ড্রেজার দিয়ে বালি ও মাটি ভরাট করছে তারা। এতে ধলেশ্বরীর দুই পাড়ের ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও বসতভিটা নদীভাঙন ঝুঁকিতে পড়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কৃষিজমিও হারিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে বিভিন্ন কৃষকের ফসলি জমি দখল করে ৩ থেকে ৫ কিলোমিটার লম্বা ড্রেজারের পাইপ নেওয়ায় এলাকাবাসীর মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। বিষয়টি যেকোনো সময় দাঙ্গা-হাঙ্গামায় রূপ নিতে পারে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
এর আগে গত ৮ জুলাই ধলেশ্বরী নদীতে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করায় একটি হামলার ঘটনা ঘটেছিল। পরে হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনা হয়। এ কারণে কেরানীগঞ্জেও অবৈধ ড্রেজারের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীর হামলার আশঙ্কা রয়েছে।
এলাকাবাসী জানায়, ড্রেজারের বিকট শব্দে বিঘ্নিত হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া। তাদের অত্যাচারে কৃষকরা আতঙ্কিত। এভাবে চলতে থাকলে কেরানীগঞ্জের গ্রামীণ চরিত্র, কৃষিভিত্তিক জীবনধারা ও পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। তারা জানান, কৃষিজমি ভরাটে একদিকে যেমন রাষ্ট্রীয় আইন অমান্য করা হচ্ছে, অন্যদিকে খাল, জলাশয় ও বিলসহ কৃষিজমি ভরাটে পরিবেশের ভারসাম্য হুমকির মুখে পড়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, অননুমোদিত ড্রেজার বসিয়ে জমির মালিকদের অনুমতি না নিয়েই ভরাট করা হচ্ছে তাদের জমি। পরে জমির মালিকদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে বাড়তি টাকা। এ নিয়ে এলাকায় ক্ষোভ বাড়ছে। আবার যত্রতত্র রাস্তা কেটে ড্রেজারের পাইপ বসানোর ফলে যোগাযোগব্যবস্থাও ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
তেঘরিয়া ইউনিয়নের কৃষক আলম বলেন, ঢাকা জেলা দক্ষিণ ছাত্রদলের সভাপতি পাভেল মোল্লার নেতৃত্বে কৃষক দল, যুবদল ও বিএনপির একটি প্রভাবশালী মহল এর সঙ্গে জড়িত। গত ৪ মাস ধরে ধলেশ্বরী নদীতীরের সরকারি জমির মাটি এবং কৃষকের তিনফসলি জমির মাটি চুরি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। এখন বর্ষা মৌসুমে পানিতে সব ডুবে যাওয়া সাধারণ মানুষের জমিগুলো ভরাট করে ফেলছে। জমি ভরাটের পর জোরপূর্বক বেশি অর্থ দাবি করছে তারা। না নিতে চাইলে ভয় দেখানো হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজেন্দ্রপুরের এক মুদি ব্যবসায়ী বলেন, রাজেন্দ্রপুর স্ট্যান্ডে আগে আওয়ামী লীগের একটি অফিস ছিল। এখন পাভেল মোল্লা, জুয়েল মোল্লা, সেলিম মোল্লার নেতৃত্বে একই জায়গায় তিনটি আলাদা অফিস তৈরি করা হয়েছে। তেঘরিয়া ইউনিয়নের সব হাটবাজার, বাসস্ট্যান্ড, দোকানপাট সবকিছুই মোল্লাবাড়ির প্রভাবশালী নেতাদের দখলে। ৫ আগস্টের পর পাভেল মোল্লা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে কেরানীগঞ্জের মধ্যে তারাই এখন সবচেয়ে বড় ভূমিদস্যু।
এ ব্যাপারে ঢাকা জেলা কৃষক দলের আহ্বায়ক জুয়েল মোল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে অবৈধ ড্রেজারের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন। পরে বলেন, যারা ড্রেজার দিয়ে জমি ও পুকুর ভরাতে চায়, শুধু তাদের জায়গায় বালি ফেলানো হয়। কারো কাছ থেকে জোরপূর্বক বেশি টাকা নেওয়া হয় না।
ঢাকা জেলা দক্ষিণ ছাত্রদলের সভাপতি পাভেল মোল্লার বক্তব্য নেওয়ার জন্য তার মোবাইল, হোয়াটসঅ্যাপ ও মেসেঞ্জারে ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও তিনি জবাব দেননি।
তেঘরিয়া ইউনিয়ন যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সেলিম মোল্লার দাবি, এলাকায় কিছু অবৈধ ড্রেজার চলছে, তবে তিনি এতে জড়িত নন।
কেরানীগঞ্জ রাজস্ব সার্কেল (দক্ষিণ) সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, নদী থেকে ড্রেজারের মাধ্যমে মাটি কাটা বা বালু দিয়ে জমি ভরাট করতে হলে জেলা প্রশাসকের অনুমতি লাগে। কৃষিজমি ভরাট করার অনুমতি নেই। তারা যদি বলগেট (বাল্কহেড) দিয়ে অন্য কোথাও থেকে বালু এনে ভরাট করে, তাও দেখার বিষয় আছে ওই বালু বৈধ না অবৈধভাবে এনেছে।
ড্রেজার দিয়ে বালু বা মাটি কাটার বিষয়টি তিনি অবহিত নন জানিয়ে বলেন, ‘অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

