সোহাগ কুমার বিশ্বাস, চট্টগ্রাম
প্রথমে নথি গায়েব, পরে যথাযথ প্রমাণ উপস্থাপন করতে না পারায় আদালতের রায় আসছে ভূমি দস্যুদের পক্ষে। এই রায়ের সূত্র ধরে আপিলে না গিয়ে ওই ‘জমিতে সরকারি স্বার্থ নেই’- উল্লেখ করে দায় সারছে জেলা প্রশাসন। এর পরই তড়িঘড়ি করে দেওয়া হচ্ছে নামজারি। এভাবেই বন্দরনগরী চট্টগ্রামে একের পর এক সরকারি জমি চলে যাচ্ছে ভূমি দস্যুদের কবজায়।
এই তালিকায় রয়েছে সরকারি খাস জমি, অর্পিত ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি। গত ৬ মাসে চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে কয়েক হাজার কোটি টাকা মূল্যের অন্তত ৫০ একর জমি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে আওয়ামী ভূমিদস্যুদের হাতে। শুধু ছেড়ে দেওয়াই নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে রীতিমতো জমিগুলো বুঝিয়ে দেওয়ার বিরল নজির স্থাপন করেছে জেলা প্রশাসন।
অভিযোগ রয়েছে, এসব সরকারি জমি বুঝিয়ে দিতে বাণিজ্য হয়েছে শত কোটি টাকারও বেশি, যা নিয়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়। ইতোমধ্যে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে একাধিক তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। ঘটনার অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে দুদক। এখনো কোনো কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা না দিলেও বালাম বইয়ে ঘষামাজা করে জমির শ্রেণি পরিবর্তন, নথি গায়েব, আদালতে মামলা মোকাবিলা না করা, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে ভুয়া মালিকদের কাছে জমি বুঝিয়ে দেওয়ার মতো চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
এসব ঘটনার তদন্তে নিয়োজিত বিভাগীয় কমিশনার অফিসের শীর্ষ এক কর্মকর্তা জানান, সরকারি জমি আত্মসাতে অভিনব কয়েকটি পন্থা অবলম্বন করেছে ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাদি উর রহিম জাদিদের স্বাক্ষরে এসব কাজ সম্পন্ন হলেও মূলত দীর্ঘদিন ধরে এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে জেলা প্রশাসনের চার কর্মকর্তা। এদের মধ্যে একজন সম্প্রতি অবসরে গেছেন।
সূত্র জানিয়েছে, সমুদ্র আর পাহাড়ে ঘেরা পুরাতন শহর হওয়ায় বন্দরনগরী চট্টগ্রামে খাস, পরিত্যক্ত ও অর্পিত সম্পত্তির পরিমাণ অন্য জেলার চেয়ে বেশি। আর এই সুযোগে সরকারি এসব সম্পত্তি দখল করতে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী একাধিক ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট। যার সঙ্গে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, ভূমি অফিস, সেটেলমেন্ট অফিস, কতিপয় রাজনৈতিক নেতারাও সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এসব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মাঝেমধ্যে ছোট-বড় সম্পত্তি দখল-বেদখলের ঘটনা ঘটলেও কয়েক মাসের মধ্যে শুধু শহর এলাকার ৫০ একরের বেশি জমি ভূমিদস্যুদের নামে বুঝিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা এবারই প্রথম। যদিও এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের হাত ধরে। তবে সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার আমলে।
হিলভিউ আবাসিক এলাকা
চট্টগ্রামের পাঁচলাইশের শেষ আর বায়েজিদের শুরুর এলাকাটির নাম হিলভিউ আবাসিক এলাকা। ৩৫ থেকে ৪০ বছর আগে এলাকাটি ছিল পাহাড়ি জঙ্গলে ঘেরা। যদিও এখনকার দৃশ্যপট সম্পূর্ণ আলাদা। পুরো এলাকায় গড়ে উঠেছে দুই শতাধিক বহুতল ভবন, ২ থেকে ১০ তলা পর্যন্ত যার উচ্চতা। অথচ ৫৮ দশমিক ৭৩ একর আয়তনের বড় এই এলাকাটির অন্তত ৪৬ একরই সরকারি খাস জমি, ১০ একর ত্রাণ বিভাগের।
তদন্ত কমিটির সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮০ সালের দিকে হিলভিউ আবাসিক কল্যাণ সমিতি নাম দিয়ে ভূমি দস্যুদের একটি সিন্ডিকেট দখল করে নেয় পুরো এলাকাটি। সরকারি বিপুল সম্পত্তি আত্মসাতের কারণে দুই দশক ধরে নামজারি বন্ধ রয়েছে। খাজনাও নেয় না সরকার। এ বিষয়ে সরকার ও হাউজিং কোম্পানির একাধিক পাল্টাপাল্টি মামলা বিচারাধীন।
সূত্র বলছে, পিএস (পাকিস্তান সার্ভে) রেকর্ডে পুরো জমিকে সরকারি খাস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু বিএস (বাংলাদেশ সার্ভে) রেকর্ডে এই জমি দেখানো হয় হিলভিউ হাউজিং সোসাইটির নামে। সরকারি জমি কীভাবে ব্যক্তির নামে রেকর্ড হলো সেটা অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ভয়াবহ তথ্য। সরকারি খাস জমি তালিকাবদ্ধ থাকে রেজিস্টার-৮-এ। আর সব ডকুমেন্ট সংরক্ষিত থাকে ইউনিয়ন ভূমি অফিস, তহসিল অফিস আর জেলা প্রশাসকের রেকর্ড রুমে। কিন্তু হিলভিউ এলাকার কোনো ডকুমেন্ট চট্টগ্রাম মহানগর ভূমি অফিস, চান্দগাঁও ষোলশহর তহসিল অফিস কিংবা জেলা প্রশাসকের রেকর্ড রুমে সংরক্ষিত নেই।
একসঙ্গে তিনটি অফিস থেকে মূল্যবান সরকারি সম্পত্তির ডকুমেন্ট গায়েব করে দিয়েছে ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট। ফলে উপযুক্ত প্রমাণ দেখাতে না পারায় খাস হিসেবে দেখানোর সরকারি আপিল খারিজ করে দেয় আদালত। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রায় হলেও সার্টিফাইড কপি এখনো আসেনি ডিসি অফিস বা সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা এসিল্যান্ডের কার্যালয়ে। তার আগেই তড়িঘড়ি করে শুরু হয়েছে ব্যক্তির নামে নামজারির কাজ। অথচ নিয়মানুযায়ী সরকারি খাস জমি প্রথম আপিলে হারলেও দ্বিতীয় আপিলসহ সর্বোচ্চ আপিলে আইন ও বিধি অনুযায়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে জেলা প্রশাসকের।
আর সর্বোচ্চ আপিলে সরকার হারলেও রায় ডিক্রিমূলে নামজারি করতে হলে বিধি মোতাবেক আবেদনকারীর আবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠাবেন এসিল্যান্ড। জেলা প্রশাসক বিভাগীয় কমিশনারের মতামত নেওয়ার পর ওই জমিতে সরকারি স্বার্থ না থাকলে তবেই এসিল্যান্ডকে নামজারি করার অনুমতি দেবেন। অথচ হিলভিউ আবাসিক এলাকার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার আপিল এমনকি রিভিউ করার সুযোগও নেয়নি জেলা প্রশাসন। একটি রায়, তাও আবার সার্টিফাইড কপি না পেয়েই ওই জমিতে জেলা প্রশাসনের স্বার্থ নেই উল্লেখ করে ব্যক্তি বিশেষের নামে নামজারি করতে গত ১৯ মে তারিখে সহকারী কমিশনার (ভূমি) চট্টগ্রাম সার্কেলকে চিঠি পাঠান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাদি উর রহিম জাদিদ। ওই চিঠির আলোকে গত দুই মাসে ১৭৮টি প্লটের নামজারি করেন এসিল্যান্ড।
এসিল্যান্ড চাঁন্দগাও অফিস সূত্র জানায়, নামজারি-সংক্রান্ত মামলার পাশাপাশি ওই জমি নিয়ে রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ইংজাংশন (নিষেধাজ্ঞা) রুল নিষ্পত্তি পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে দায়ের করা লিভ টু আপিল এখনো বহাল রয়েছে হিলভিউ আবাসিক এলাকায়। কিন্তু এসব মামলা সংক্রান্ত তথ্য গোপন করেই নামজারি করে দেওয়া হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাবেক এক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আমার দেশকে বলেন, হিলভিউ আবাসিক এলাকা ৪০ বছর আগে দখল করা হলেও মূলত এটিতে ভবন উঠতে থাকে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর। তখন থেকেই একটি ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট এলাকাটির বৈধতা নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। কাজের সুবিধার্থে নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মোস্তফা কামালকে সিন্ডিকেটে ভিড়িয়ে নেয়। পতিত আওয়ামী লীগের সবচেয়ে ক্ষমতাধর এই দুই সচিব হাত করেন তৎকালীন ভূমি প্রতিমন্ত্রী (পরবর্তী সময়ে মন্ত্রী) সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদকে। এই তিনজনের প্রত্যক্ষ নির্দেশে সব অফিস থেকে ডকুমেন্ট গায়েব করে দেওয়া হয়।
সাবেক ওই অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বলেন, নথি গায়েবের পর থেকেই হিলভিউতে একের পর এক বহুতল ভবন গড়ে উঠতে থাকে। নইলে নামজারি না হওয়া জমিতে বহুতল ভবন তোলার মতো ঝুঁকি কেউ নিত না। কারণ, কোনো জমির নামজারি না হলে তার মালিকানা বৈধতা পায় না। তবে অবৈধ জমিতে সিডিএ (চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) বহুতল ভবনের অনুমোদন দিল কি করেÑ সেই প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজতে হবে।
জেলা রেকর্ডরুম সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী জাবেদের তত্ত্বাবধানেই সব সরকারি জমি পাকাপাকিভাবে নিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগমুহূর্তে সাবেক মন্ত্রী জাবেদের দুর্নীতির খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশ হলে ডামি নির্বাচনের পর মন্ত্রী পরিষদে জায়গা পাননি তিনি। তাই ওই সময় এই প্রক্রিয়া অনেকটা থেমে যায়। তবে অন্তর্বর্তী সরকার আমলে এসে সেই কাজ সম্পন্ন হচ্ছে।
হিন্দু ব্যক্তিকে খ্রিষ্টান বানিয়ে ইহুদির জমি বুঝিয়ে দেয় প্রশাসন
১৮ শতকের শেষদিকে কলকাতা থেকে বেশ কয়েকটি বাগদাদী ইহুদি পরিবার বাণিজ্য করতে বাংলাদেশে আসেন। তারা ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে বসবাস শুরু করেন। তবে তাদের কেউই এখন আর বাংলাদেশে নেই। তাদেরই একজন ডেভিট ইজিক্যাল স্থায়ী হন চট্টগ্রামে। নগরীর ফিরিঙ্গীবাজারের আলকরণ এলাকায় জমি কিনে বাড়িও করেন তিনি। ১৯৩৬ সালে ডেভিড ইজিক্যাল পরিবারসহ মেলবোর্নে চলে যায়। সেখানেই তিনি মারা যান। ডেভিড ইজিক্যালের ডেথ সার্টিফিকেট দৈনিক আমার দেশ’র হাতে এসেছে।
এদিকে ইজিক্যালের মৃত্যুর পর থেকেই তার সম্পত্তি সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কয়েকজন পুরোনো ব্যবসায়ী সরকারকে ভাড়া দিয়ে ব্যবসা করছিলেন সেখানে। কিন্তু আওয়ামী লীগ আমলে শহরের প্রাণকেন্দ্র কেন্দ্রীয় পোস্ট অফিসের বিপরীতের মূল্যবান এই জমিটির ওপর নজর পড়ে নন্দনকাননকেন্দ্রিক একটি ভূমিদস্যু সিন্ডিকেটের, যার নেতৃত্ব দেন যুবলীগের কথিত নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর। হিন্দু থেকে খ্রিষ্টান হওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা জনৈক এলবার্ট সরকার নামের এক ব্যক্তিকে ডেভিড ইজিক্যালের ভুয়া ওয়ারিস সাজিয়ে মূল্যবান ওই জমি দখলের প্রক্রিয়া শুরু করে সিন্ডিকেটটি।
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ আমলে প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তা ভুয়া মালিকের কাছে এই জমি বুঝিয়ে দেওয়ার সাহস করেননি। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার আমলে পুরনো কৌশলে আদালতের একটি রায়কে কেন্দ্র করে এলবার্ট সরকারের কাছে সম্পত্তি বুঝিয়ে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এমনকি গত ৫ মার্চ জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ ভাড়াটিয়াদের বের করে জমির দখল দেয় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের। বর্তমানে সেখানে ‘এই সম্পত্তির মালিক এলবার্ট সরকার’ লেখা সাইনবোর্ড ঝুললেও এলবার্টকে কেউ দেখেনি।
ডেভিড ইজিক্যালের বাড়ির সামনের দোকান ঘর থেকে উচ্ছেদ হওয়া পবিত্র বড়ুয়া জানান, তার বাবা এখানে দোকান ভাড়া নিয়েছিলেন। ইহুদি পরিবার দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর আদালতের মাধ্যমে ভাড়া পরিশোধ করতেন তারা। এমন আরো কয়েকটি দোকান ছিল এখানে। ২০১২ সালে এলবার্ট সরকার নামের এক ব্যক্তি ইজিক্যালের ওয়ারিশ সেজে আদালতে মামলা দায়ের করেন। যদিও বিষয়টি ২০২৩ সালে তারা প্রথম জানতে পারেন। এরপর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখানে এসে মাপ-ঝোক করলেও জমি অন্যকে বুঝিয়ে দেয়নি। কিন্তু চলতি বছরের ৫ মার্চ সকালে হঠাৎ করে জেলা প্রশাসনের একজন ম্যাজিস্ট্রেট র্যাব, পুলিশ, বিজিবি নিয়ে এসে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে তাদের উচ্ছেদ করে দেয়।
পবিত্র বড়ুয়া আরো জানান, কেবল উচ্ছেদের দিনই এক ব্যক্তি নিজেকে এলবার্ট বলে পরিচয় দেন। পরে মামলার কাগজপত্র তুলে দেখা যায় এলবার্ট সরকারের ঠিকানা এই ভবনের দ্বিতীয়তলা। কিন্তু এখানে তাকে কোনোদিন কেউ দেখেনি। এমনকি জমি বুঝিয়ে দেওয়ার পরও তিনি আসেননি। কয়েকজন অপরিচিত যুবক প্রতিদিন এসে সম্পত্তিটি দেখাশোনা করেন।
শিল্পকলার পাশের ৮৭ শতাংশ জমি ভুয়া মালিকদের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সম্পন্ন
চট্টগ্রাম শহরের ঠিক মাঝখানে জেলা শিল্পকলা একাডেমির পাশেই ৮৭ শতাংশ জমির মালিক ছিলেন অবাঙালি সৈয়দ আহমদ হাশেমী। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি দেশত্যাগ করে পাকিস্তান চলে যান। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। দেশ স্বাধীনের পর কিছুদিন এই সম্পত্তি ভোগদখল করেন হাশেমীর চাচাতো ভাই আমীন আলী। কিন্তু আমিন আলী আইনত বৈধ ওয়ারিশ না হওয়ায় ১৯৮৭ সালে জেলা প্রশাসক পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেন সম্পত্তিটি। ১৯৮৮ সালে মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামসহ নয়জনের অনুকূলে একসনা ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন।
২০০৮ সালের শুরুতে ওই জমির ওপর নজর পরে ভূমিদস্যু সিন্ডিকেটের। অজ্ঞাতনামা নারগীজ আক্তার গং নামের একটি গোষ্ঠী তাদের নামে নামজারির আবেদন করে। অমর কুমার শর্মা নামের এক ব্যক্তি গ্রহীতা সেজে ঠিকানাবিহীন সৈয়দ হাশেমীকে দাতা সাজিয়ে ২০০৮ সালের ১৫ অক্টোবর তৈরি করেন। দলিলের ভিত্তিতে ইজারাভোগীদের বিরুদ্ধে মিস কেস দায়ের করেন। একই বছরের ২৩ অক্টোবর আবার বায়নানামা দলিল তৈরি করেন।
মূল সম্পত্তির মালিক হাশেমী পাকিস্তান চলে যাওয়ার পরও জনৈক নুরুল আলম আমমোক্তার সেজে ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর ভূমি সচিব বরাবর আবেদন করেন। অপর একজন আলী নুর চৌধুরী উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন করেন। ভূমিদস্যু চক্রের অপর সদস্য নাজিম উদ্দিন ২০১৫ সালের ১৯ মার্চ বায়নানামা দলিল তৈরি করেন। এভাবে ভূমিদস্যু চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন আদালতে একাধিক মিথ্যা মামলা করেন এবং নকল ব্যক্তি সেজে প্রায় ২০০ কোটি টাকার এই সম্পত্তি আত্মসাতের চেষ্টা শুরু করেন।
এই সম্পত্তির বিএস জরিপ সরকারের নামে না হয়ে রইসা আজিজের নামে হওয়ায় তা সংশোধনের জন্য ২০২৩ সালের ২ নভেম্বর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আবদুল মালেক প্রতিবেদন পেশ করেন। একই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএস জরিপ সরকারের নামে না হওয়ার সুযোগে ভূমিদস্যু জালিয়াত চক্র বিভিন্ন ধরনের জাল, ফেরেবী (প্রতারণামূলক), বানোয়াট দলিল, যোগসাজশ আম মোক্তারনামা, বায়নানামা দলিল, ভুয়া ওয়ারিশ সনদ ও এনআইডি তৈরি করে সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের চেষ্টা করছে।
সূত্র জানায়, অবাঙালি হাশমীর কোনো ওয়ারিশ এদেশে বসবাস করেন না। অথচ ভূমিদস্যু চক্র সাভারের এক ব্যক্তিকে হাশমী দাবি করে কয়েকজন ব্যক্তিকে তার ওয়ারিশ বানিয়ে এই সম্পত্তি দখলের অপচেষ্টা শুরু করেন। সেসব ভুয়া নথিতে দেখা গেছে, বাবার বয়স যখন ৭৯ বছর তখন সন্তানের জন্ম হয়েছে। অথচ এরপরও জেলা প্রশাসন ভুয়া ওই ওয়ারিশদের কাছে জমি বুঝিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে বলে জানায় তদন্ত কমিটি।
সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর বক্তব্য
চান্দগাঁও সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্লাবন বিশ্বাস বলেন, হিলভিউয়ের ঘটনা আমি এখানে যোগদান করার আগেই শেষ হয়েছে। যতটুকু জানি, জমি নিয়ে আদালতের সর্বোচ্চ রায়ের প্রয়োজন নেই। কারণ বিএস রেকর্ড হাউজিং সোসাইটির নামে হয়েছে। পিএস থেকে বিএসে কীভাবে পরিবর্তন হলো নতুন আসার কারণে সেই বিষয়টি আমার জানা নেই।
সরকারি জমি ব্যক্তির নামে নামজারি করার লিখিত নির্দেশদাতা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাদি উর রহিম জাদিদ বলেন, এলবার্ট সরকারের সম্পত্তিটি নিয়ে উচ্চ আদালতে রিভিউ পর্যন্ত হয়েছে। সব ক্ষেত্রে রায় সরকারের বিপক্ষে যাওয়ার পর আদালতের নির্দেশে জমিটি বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। হিলভিউ আবাসিক এলাকার ক্ষেত্রেও একইভাবে আদালতের রায় পালন করেছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যাচাই-বাছাই করে দেখা হয়েছে সেখানে সরকারের কোনো স্বার্থ নেই। বরং আগের প্রশাসন বছরের পর বছর ধরে সেখানকার বাসিন্দাদের হয়রানি করে গেছে। বর্তমান জেলা প্রশাসক সাহসিকতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি করেছেন। এ কারণে তাকে পুরস্কৃত করা উচিত। উল্টো তাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে।
সাদি উর রহিম জাদিদ আরো বলেন, শিল্পকলার পাশের জমিটি একটি গ্রুপ প্রতি বছর নিজের বলে দাবি করে আবেদন করে। সেই বিষয়টিও যাচাই-বাছাই চলছে। তবে সেটা ব্যক্তি মালিকানার জমি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। জেলা প্রশাসন এই জমিটিকে ঘিরে সেভাবেই প্রতিবেদন দিয়েছে।
চাঞ্চল্যকর এই বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন বলেন, কয়েক মাসের ব্যবধানে বিপুল পরিমাণ সরকারি সম্পত্তি হাতছাড়া হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিক তদন্তে জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে ডকুমেন্ট পাঠাতে বলা হয়েছে। কিন্তু গত ১৫ দিনে কোনো ডকুমেন্ট আসেনি। আর কয়েক দিন অপেক্ষা করে তদন্তের পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ড. মো. জিয়াউদ্দীন বলেন, ভূমিদস্যুদের একটি সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরও যোগসাজশ রয়েছে। তদন্তে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিত করা গেলেও সিন্ডিকেটের হোতারা সাধারণত ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকে। আর এ কারণেই ভূমি নিয়ে জালিয়াতি বন্ধ করা যায় না। তবে এবার সরকার আন্তরিক। চক্রের গোড়া পর্যন্ত পৌঁছানোর ব্যাপারে প্রশাসনের আন্তরিকতা রয়েছে।
প্রথমে নথি গায়েব, পরে যথাযথ প্রমাণ উপস্থাপন করতে না পারায় আদালতের রায় আসছে ভূমি দস্যুদের পক্ষে। এই রায়ের সূত্র ধরে আপিলে না গিয়ে ওই ‘জমিতে সরকারি স্বার্থ নেই’- উল্লেখ করে দায় সারছে জেলা প্রশাসন। এর পরই তড়িঘড়ি করে দেওয়া হচ্ছে নামজারি। এভাবেই বন্দরনগরী চট্টগ্রামে একের পর এক সরকারি জমি চলে যাচ্ছে ভূমি দস্যুদের কবজায়।
এই তালিকায় রয়েছে সরকারি খাস জমি, অর্পিত ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি। গত ৬ মাসে চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে কয়েক হাজার কোটি টাকা মূল্যের অন্তত ৫০ একর জমি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে আওয়ামী ভূমিদস্যুদের হাতে। শুধু ছেড়ে দেওয়াই নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে রীতিমতো জমিগুলো বুঝিয়ে দেওয়ার বিরল নজির স্থাপন করেছে জেলা প্রশাসন।
অভিযোগ রয়েছে, এসব সরকারি জমি বুঝিয়ে দিতে বাণিজ্য হয়েছে শত কোটি টাকারও বেশি, যা নিয়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়। ইতোমধ্যে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে একাধিক তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। ঘটনার অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে দুদক। এখনো কোনো কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা না দিলেও বালাম বইয়ে ঘষামাজা করে জমির শ্রেণি পরিবর্তন, নথি গায়েব, আদালতে মামলা মোকাবিলা না করা, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে ভুয়া মালিকদের কাছে জমি বুঝিয়ে দেওয়ার মতো চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
এসব ঘটনার তদন্তে নিয়োজিত বিভাগীয় কমিশনার অফিসের শীর্ষ এক কর্মকর্তা জানান, সরকারি জমি আত্মসাতে অভিনব কয়েকটি পন্থা অবলম্বন করেছে ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাদি উর রহিম জাদিদের স্বাক্ষরে এসব কাজ সম্পন্ন হলেও মূলত দীর্ঘদিন ধরে এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে জেলা প্রশাসনের চার কর্মকর্তা। এদের মধ্যে একজন সম্প্রতি অবসরে গেছেন।
সূত্র জানিয়েছে, সমুদ্র আর পাহাড়ে ঘেরা পুরাতন শহর হওয়ায় বন্দরনগরী চট্টগ্রামে খাস, পরিত্যক্ত ও অর্পিত সম্পত্তির পরিমাণ অন্য জেলার চেয়ে বেশি। আর এই সুযোগে সরকারি এসব সম্পত্তি দখল করতে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী একাধিক ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট। যার সঙ্গে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, ভূমি অফিস, সেটেলমেন্ট অফিস, কতিপয় রাজনৈতিক নেতারাও সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এসব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মাঝেমধ্যে ছোট-বড় সম্পত্তি দখল-বেদখলের ঘটনা ঘটলেও কয়েক মাসের মধ্যে শুধু শহর এলাকার ৫০ একরের বেশি জমি ভূমিদস্যুদের নামে বুঝিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা এবারই প্রথম। যদিও এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের হাত ধরে। তবে সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার আমলে।
হিলভিউ আবাসিক এলাকা
চট্টগ্রামের পাঁচলাইশের শেষ আর বায়েজিদের শুরুর এলাকাটির নাম হিলভিউ আবাসিক এলাকা। ৩৫ থেকে ৪০ বছর আগে এলাকাটি ছিল পাহাড়ি জঙ্গলে ঘেরা। যদিও এখনকার দৃশ্যপট সম্পূর্ণ আলাদা। পুরো এলাকায় গড়ে উঠেছে দুই শতাধিক বহুতল ভবন, ২ থেকে ১০ তলা পর্যন্ত যার উচ্চতা। অথচ ৫৮ দশমিক ৭৩ একর আয়তনের বড় এই এলাকাটির অন্তত ৪৬ একরই সরকারি খাস জমি, ১০ একর ত্রাণ বিভাগের।
তদন্ত কমিটির সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮০ সালের দিকে হিলভিউ আবাসিক কল্যাণ সমিতি নাম দিয়ে ভূমি দস্যুদের একটি সিন্ডিকেট দখল করে নেয় পুরো এলাকাটি। সরকারি বিপুল সম্পত্তি আত্মসাতের কারণে দুই দশক ধরে নামজারি বন্ধ রয়েছে। খাজনাও নেয় না সরকার। এ বিষয়ে সরকার ও হাউজিং কোম্পানির একাধিক পাল্টাপাল্টি মামলা বিচারাধীন।
সূত্র বলছে, পিএস (পাকিস্তান সার্ভে) রেকর্ডে পুরো জমিকে সরকারি খাস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু বিএস (বাংলাদেশ সার্ভে) রেকর্ডে এই জমি দেখানো হয় হিলভিউ হাউজিং সোসাইটির নামে। সরকারি জমি কীভাবে ব্যক্তির নামে রেকর্ড হলো সেটা অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ভয়াবহ তথ্য। সরকারি খাস জমি তালিকাবদ্ধ থাকে রেজিস্টার-৮-এ। আর সব ডকুমেন্ট সংরক্ষিত থাকে ইউনিয়ন ভূমি অফিস, তহসিল অফিস আর জেলা প্রশাসকের রেকর্ড রুমে। কিন্তু হিলভিউ এলাকার কোনো ডকুমেন্ট চট্টগ্রাম মহানগর ভূমি অফিস, চান্দগাঁও ষোলশহর তহসিল অফিস কিংবা জেলা প্রশাসকের রেকর্ড রুমে সংরক্ষিত নেই।
একসঙ্গে তিনটি অফিস থেকে মূল্যবান সরকারি সম্পত্তির ডকুমেন্ট গায়েব করে দিয়েছে ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট। ফলে উপযুক্ত প্রমাণ দেখাতে না পারায় খাস হিসেবে দেখানোর সরকারি আপিল খারিজ করে দেয় আদালত। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রায় হলেও সার্টিফাইড কপি এখনো আসেনি ডিসি অফিস বা সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা এসিল্যান্ডের কার্যালয়ে। তার আগেই তড়িঘড়ি করে শুরু হয়েছে ব্যক্তির নামে নামজারির কাজ। অথচ নিয়মানুযায়ী সরকারি খাস জমি প্রথম আপিলে হারলেও দ্বিতীয় আপিলসহ সর্বোচ্চ আপিলে আইন ও বিধি অনুযায়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে জেলা প্রশাসকের।
আর সর্বোচ্চ আপিলে সরকার হারলেও রায় ডিক্রিমূলে নামজারি করতে হলে বিধি মোতাবেক আবেদনকারীর আবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠাবেন এসিল্যান্ড। জেলা প্রশাসক বিভাগীয় কমিশনারের মতামত নেওয়ার পর ওই জমিতে সরকারি স্বার্থ না থাকলে তবেই এসিল্যান্ডকে নামজারি করার অনুমতি দেবেন। অথচ হিলভিউ আবাসিক এলাকার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার আপিল এমনকি রিভিউ করার সুযোগও নেয়নি জেলা প্রশাসন। একটি রায়, তাও আবার সার্টিফাইড কপি না পেয়েই ওই জমিতে জেলা প্রশাসনের স্বার্থ নেই উল্লেখ করে ব্যক্তি বিশেষের নামে নামজারি করতে গত ১৯ মে তারিখে সহকারী কমিশনার (ভূমি) চট্টগ্রাম সার্কেলকে চিঠি পাঠান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাদি উর রহিম জাদিদ। ওই চিঠির আলোকে গত দুই মাসে ১৭৮টি প্লটের নামজারি করেন এসিল্যান্ড।
এসিল্যান্ড চাঁন্দগাও অফিস সূত্র জানায়, নামজারি-সংক্রান্ত মামলার পাশাপাশি ওই জমি নিয়ে রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ইংজাংশন (নিষেধাজ্ঞা) রুল নিষ্পত্তি পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে দায়ের করা লিভ টু আপিল এখনো বহাল রয়েছে হিলভিউ আবাসিক এলাকায়। কিন্তু এসব মামলা সংক্রান্ত তথ্য গোপন করেই নামজারি করে দেওয়া হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাবেক এক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আমার দেশকে বলেন, হিলভিউ আবাসিক এলাকা ৪০ বছর আগে দখল করা হলেও মূলত এটিতে ভবন উঠতে থাকে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর। তখন থেকেই একটি ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট এলাকাটির বৈধতা নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। কাজের সুবিধার্থে নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মোস্তফা কামালকে সিন্ডিকেটে ভিড়িয়ে নেয়। পতিত আওয়ামী লীগের সবচেয়ে ক্ষমতাধর এই দুই সচিব হাত করেন তৎকালীন ভূমি প্রতিমন্ত্রী (পরবর্তী সময়ে মন্ত্রী) সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদকে। এই তিনজনের প্রত্যক্ষ নির্দেশে সব অফিস থেকে ডকুমেন্ট গায়েব করে দেওয়া হয়।
সাবেক ওই অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বলেন, নথি গায়েবের পর থেকেই হিলভিউতে একের পর এক বহুতল ভবন গড়ে উঠতে থাকে। নইলে নামজারি না হওয়া জমিতে বহুতল ভবন তোলার মতো ঝুঁকি কেউ নিত না। কারণ, কোনো জমির নামজারি না হলে তার মালিকানা বৈধতা পায় না। তবে অবৈধ জমিতে সিডিএ (চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) বহুতল ভবনের অনুমোদন দিল কি করেÑ সেই প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজতে হবে।
জেলা রেকর্ডরুম সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী জাবেদের তত্ত্বাবধানেই সব সরকারি জমি পাকাপাকিভাবে নিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগমুহূর্তে সাবেক মন্ত্রী জাবেদের দুর্নীতির খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশ হলে ডামি নির্বাচনের পর মন্ত্রী পরিষদে জায়গা পাননি তিনি। তাই ওই সময় এই প্রক্রিয়া অনেকটা থেমে যায়। তবে অন্তর্বর্তী সরকার আমলে এসে সেই কাজ সম্পন্ন হচ্ছে।
হিন্দু ব্যক্তিকে খ্রিষ্টান বানিয়ে ইহুদির জমি বুঝিয়ে দেয় প্রশাসন
১৮ শতকের শেষদিকে কলকাতা থেকে বেশ কয়েকটি বাগদাদী ইহুদি পরিবার বাণিজ্য করতে বাংলাদেশে আসেন। তারা ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে বসবাস শুরু করেন। তবে তাদের কেউই এখন আর বাংলাদেশে নেই। তাদেরই একজন ডেভিট ইজিক্যাল স্থায়ী হন চট্টগ্রামে। নগরীর ফিরিঙ্গীবাজারের আলকরণ এলাকায় জমি কিনে বাড়িও করেন তিনি। ১৯৩৬ সালে ডেভিড ইজিক্যাল পরিবারসহ মেলবোর্নে চলে যায়। সেখানেই তিনি মারা যান। ডেভিড ইজিক্যালের ডেথ সার্টিফিকেট দৈনিক আমার দেশ’র হাতে এসেছে।
এদিকে ইজিক্যালের মৃত্যুর পর থেকেই তার সম্পত্তি সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কয়েকজন পুরোনো ব্যবসায়ী সরকারকে ভাড়া দিয়ে ব্যবসা করছিলেন সেখানে। কিন্তু আওয়ামী লীগ আমলে শহরের প্রাণকেন্দ্র কেন্দ্রীয় পোস্ট অফিসের বিপরীতের মূল্যবান এই জমিটির ওপর নজর পড়ে নন্দনকাননকেন্দ্রিক একটি ভূমিদস্যু সিন্ডিকেটের, যার নেতৃত্ব দেন যুবলীগের কথিত নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর। হিন্দু থেকে খ্রিষ্টান হওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা জনৈক এলবার্ট সরকার নামের এক ব্যক্তিকে ডেভিড ইজিক্যালের ভুয়া ওয়ারিস সাজিয়ে মূল্যবান ওই জমি দখলের প্রক্রিয়া শুরু করে সিন্ডিকেটটি।
সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ আমলে প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তা ভুয়া মালিকের কাছে এই জমি বুঝিয়ে দেওয়ার সাহস করেননি। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার আমলে পুরনো কৌশলে আদালতের একটি রায়কে কেন্দ্র করে এলবার্ট সরকারের কাছে সম্পত্তি বুঝিয়ে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এমনকি গত ৫ মার্চ জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ ভাড়াটিয়াদের বের করে জমির দখল দেয় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের। বর্তমানে সেখানে ‘এই সম্পত্তির মালিক এলবার্ট সরকার’ লেখা সাইনবোর্ড ঝুললেও এলবার্টকে কেউ দেখেনি।
ডেভিড ইজিক্যালের বাড়ির সামনের দোকান ঘর থেকে উচ্ছেদ হওয়া পবিত্র বড়ুয়া জানান, তার বাবা এখানে দোকান ভাড়া নিয়েছিলেন। ইহুদি পরিবার দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর আদালতের মাধ্যমে ভাড়া পরিশোধ করতেন তারা। এমন আরো কয়েকটি দোকান ছিল এখানে। ২০১২ সালে এলবার্ট সরকার নামের এক ব্যক্তি ইজিক্যালের ওয়ারিশ সেজে আদালতে মামলা দায়ের করেন। যদিও বিষয়টি ২০২৩ সালে তারা প্রথম জানতে পারেন। এরপর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখানে এসে মাপ-ঝোক করলেও জমি অন্যকে বুঝিয়ে দেয়নি। কিন্তু চলতি বছরের ৫ মার্চ সকালে হঠাৎ করে জেলা প্রশাসনের একজন ম্যাজিস্ট্রেট র্যাব, পুলিশ, বিজিবি নিয়ে এসে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে তাদের উচ্ছেদ করে দেয়।
পবিত্র বড়ুয়া আরো জানান, কেবল উচ্ছেদের দিনই এক ব্যক্তি নিজেকে এলবার্ট বলে পরিচয় দেন। পরে মামলার কাগজপত্র তুলে দেখা যায় এলবার্ট সরকারের ঠিকানা এই ভবনের দ্বিতীয়তলা। কিন্তু এখানে তাকে কোনোদিন কেউ দেখেনি। এমনকি জমি বুঝিয়ে দেওয়ার পরও তিনি আসেননি। কয়েকজন অপরিচিত যুবক প্রতিদিন এসে সম্পত্তিটি দেখাশোনা করেন।
শিল্পকলার পাশের ৮৭ শতাংশ জমি ভুয়া মালিকদের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সম্পন্ন
চট্টগ্রাম শহরের ঠিক মাঝখানে জেলা শিল্পকলা একাডেমির পাশেই ৮৭ শতাংশ জমির মালিক ছিলেন অবাঙালি সৈয়দ আহমদ হাশেমী। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি দেশত্যাগ করে পাকিস্তান চলে যান। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। দেশ স্বাধীনের পর কিছুদিন এই সম্পত্তি ভোগদখল করেন হাশেমীর চাচাতো ভাই আমীন আলী। কিন্তু আমিন আলী আইনত বৈধ ওয়ারিশ না হওয়ায় ১৯৮৭ সালে জেলা প্রশাসক পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেন সম্পত্তিটি। ১৯৮৮ সালে মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামসহ নয়জনের অনুকূলে একসনা ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন।
২০০৮ সালের শুরুতে ওই জমির ওপর নজর পরে ভূমিদস্যু সিন্ডিকেটের। অজ্ঞাতনামা নারগীজ আক্তার গং নামের একটি গোষ্ঠী তাদের নামে নামজারির আবেদন করে। অমর কুমার শর্মা নামের এক ব্যক্তি গ্রহীতা সেজে ঠিকানাবিহীন সৈয়দ হাশেমীকে দাতা সাজিয়ে ২০০৮ সালের ১৫ অক্টোবর তৈরি করেন। দলিলের ভিত্তিতে ইজারাভোগীদের বিরুদ্ধে মিস কেস দায়ের করেন। একই বছরের ২৩ অক্টোবর আবার বায়নানামা দলিল তৈরি করেন।
মূল সম্পত্তির মালিক হাশেমী পাকিস্তান চলে যাওয়ার পরও জনৈক নুরুল আলম আমমোক্তার সেজে ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর ভূমি সচিব বরাবর আবেদন করেন। অপর একজন আলী নুর চৌধুরী উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন করেন। ভূমিদস্যু চক্রের অপর সদস্য নাজিম উদ্দিন ২০১৫ সালের ১৯ মার্চ বায়নানামা দলিল তৈরি করেন। এভাবে ভূমিদস্যু চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন আদালতে একাধিক মিথ্যা মামলা করেন এবং নকল ব্যক্তি সেজে প্রায় ২০০ কোটি টাকার এই সম্পত্তি আত্মসাতের চেষ্টা শুরু করেন।
এই সম্পত্তির বিএস জরিপ সরকারের নামে না হয়ে রইসা আজিজের নামে হওয়ায় তা সংশোধনের জন্য ২০২৩ সালের ২ নভেম্বর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আবদুল মালেক প্রতিবেদন পেশ করেন। একই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএস জরিপ সরকারের নামে না হওয়ার সুযোগে ভূমিদস্যু জালিয়াত চক্র বিভিন্ন ধরনের জাল, ফেরেবী (প্রতারণামূলক), বানোয়াট দলিল, যোগসাজশ আম মোক্তারনামা, বায়নানামা দলিল, ভুয়া ওয়ারিশ সনদ ও এনআইডি তৈরি করে সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের চেষ্টা করছে।
সূত্র জানায়, অবাঙালি হাশমীর কোনো ওয়ারিশ এদেশে বসবাস করেন না। অথচ ভূমিদস্যু চক্র সাভারের এক ব্যক্তিকে হাশমী দাবি করে কয়েকজন ব্যক্তিকে তার ওয়ারিশ বানিয়ে এই সম্পত্তি দখলের অপচেষ্টা শুরু করেন। সেসব ভুয়া নথিতে দেখা গেছে, বাবার বয়স যখন ৭৯ বছর তখন সন্তানের জন্ম হয়েছে। অথচ এরপরও জেলা প্রশাসন ভুয়া ওই ওয়ারিশদের কাছে জমি বুঝিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে বলে জানায় তদন্ত কমিটি।
সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর বক্তব্য
চান্দগাঁও সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্লাবন বিশ্বাস বলেন, হিলভিউয়ের ঘটনা আমি এখানে যোগদান করার আগেই শেষ হয়েছে। যতটুকু জানি, জমি নিয়ে আদালতের সর্বোচ্চ রায়ের প্রয়োজন নেই। কারণ বিএস রেকর্ড হাউজিং সোসাইটির নামে হয়েছে। পিএস থেকে বিএসে কীভাবে পরিবর্তন হলো নতুন আসার কারণে সেই বিষয়টি আমার জানা নেই।
সরকারি জমি ব্যক্তির নামে নামজারি করার লিখিত নির্দেশদাতা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাদি উর রহিম জাদিদ বলেন, এলবার্ট সরকারের সম্পত্তিটি নিয়ে উচ্চ আদালতে রিভিউ পর্যন্ত হয়েছে। সব ক্ষেত্রে রায় সরকারের বিপক্ষে যাওয়ার পর আদালতের নির্দেশে জমিটি বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। হিলভিউ আবাসিক এলাকার ক্ষেত্রেও একইভাবে আদালতের রায় পালন করেছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যাচাই-বাছাই করে দেখা হয়েছে সেখানে সরকারের কোনো স্বার্থ নেই। বরং আগের প্রশাসন বছরের পর বছর ধরে সেখানকার বাসিন্দাদের হয়রানি করে গেছে। বর্তমান জেলা প্রশাসক সাহসিকতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি করেছেন। এ কারণে তাকে পুরস্কৃত করা উচিত। উল্টো তাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে।
সাদি উর রহিম জাদিদ আরো বলেন, শিল্পকলার পাশের জমিটি একটি গ্রুপ প্রতি বছর নিজের বলে দাবি করে আবেদন করে। সেই বিষয়টিও যাচাই-বাছাই চলছে। তবে সেটা ব্যক্তি মালিকানার জমি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। জেলা প্রশাসন এই জমিটিকে ঘিরে সেভাবেই প্রতিবেদন দিয়েছে।
চাঞ্চল্যকর এই বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন বলেন, কয়েক মাসের ব্যবধানে বিপুল পরিমাণ সরকারি সম্পত্তি হাতছাড়া হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিক তদন্তে জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে ডকুমেন্ট পাঠাতে বলা হয়েছে। কিন্তু গত ১৫ দিনে কোনো ডকুমেন্ট আসেনি। আর কয়েক দিন অপেক্ষা করে তদন্তের পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ড. মো. জিয়াউদ্দীন বলেন, ভূমিদস্যুদের একটি সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরও যোগসাজশ রয়েছে। তদন্তে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিত করা গেলেও সিন্ডিকেটের হোতারা সাধারণত ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকে। আর এ কারণেই ভূমি নিয়ে জালিয়াতি বন্ধ করা যায় না। তবে এবার সরকার আন্তরিক। চক্রের গোড়া পর্যন্ত পৌঁছানোর ব্যাপারে প্রশাসনের আন্তরিকতা রয়েছে।
চলতি বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা হলে বর্তমান সরকার আর কোনো প্রকল্পের উদ্বোধন করতে পারবে না। সে কারণে দ্রুত পিডি নিয়োগ করে নভেম্বরেই কাজ শুরু করতে হবে। সেটি করা না হলে সারা দেশে এই আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়া হবে। প্রয়োজনে চীন টাকা না দিলেও নিজের টাকা দিয়ে কাজ শুরুর দাবি জানান তারা।
১ ঘণ্টা আগেময়মনসিংহের গৌরীপুরে জহিরুল ইসলাম মিঠু হত্যা মামলায় পলাতক দুই ভাইকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
২ ঘণ্টা আগেপরিবারের পক্ষ থেকে জানা গেছে, ১১ বছর বয়সে ১৯৩৫ সালে শামসুদ্দিন ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান আর্মিতে যোগ দিয়েছিলেন। তার সৈনিক নম্বর ছিল ৬৪১৪৬০। ১৯৩৯ থেকে শুরু করে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত পুরো ছয় বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ময়দানে ছিলেন এ যোদ্ধা।
২ ঘণ্টা আগেচট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার ভেতরে পুলিশের ওপর চড়াও হয়েছেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের এক সাবেক নেতা। ঘটনার পর তাকে আটক করেছে পুলিশ। বুধবার দুপুর ২টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। আটক মো. রায়হান হাটহাজারি কলেজ শিবিরের সাবেক সভাপতি।
২ ঘণ্টা আগে