জমে উঠেছে নৌকার হাট

আতাউর রহমান, মধ্যনগর (সুনামগঞ্জ)
প্রকাশ : ১০ জুলাই ২০২৫, ০৫: ৫৫

হাওরাঞ্চলের মানুষের মুখে প্রচলিত প্রবাদ ‘শুকনায় পাও, বর্ষায় নাও’—এই কথাটি যেন আজও হাওরের বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি। বর্ষা এলেই সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওরজুড়ে নেমে আসে টইটম্বুর পানি। তখন চারদিকজুড়ে থাকে শুধু পানি আর পানি। এই পানিপ্রবাহে একমাত্র ভরসা হয়ে ওঠে নৌকা—জীবনের চলার বাহন, জীবিকার সহযাত্রী।

বর্ষা এলেই হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা সম্পূর্ণরূপে পাল্টে যায়। যাতায়াত, মাছ ধরা, ব্যবসা-বাণিজ্য, গবাদি পশুর খাদ্য সংগ্রহ, কৃষিকাজের উপকরণ আনা-নেওয়া—সবকিছুতেই নৌকার বিকল্প নেই। তাই এই মৌসুমে নৌকার চাহিদা থাকে তুঙ্গে। সেই চাহিদা পূরণে শতবর্ষ ধরে হাওরের প্রাণকেন্দ্র সুনামগঞ্জের মধ্যনগরে গড়ে উঠেছে একটি ঐতিহ্যবাহী নৌকার হাট। প্রায় শত বছর আগে গড়ে ওঠা এই হাটটি বসে মধ্যনগর বাজারের কাচারিসংলগ্ন এলাকায়।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয় প্রবীণরা জানান, ১৯২০ কিংবা ১৯২২ সালের দিকে গৌরীপুরের পঞ্চম জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় মধ্যনগর বাজারে একটি পুকুর খনন করেন স্থানীয় মানুষের পানীয় জলের চাহিদা পূরণের জন্য। বিশাল এ পুকুরের খননকৃত মাটি দিয়ে গড়ে তোলা হয় বর্তমান মধ্যনগর বাজার। পুকুর খননের কিছুদিন পর থেকেই সেখানে শুরু হয় নৌকার বেচাকেনা। এভাবেই প্রতি সপ্তাহের শনিবার দিনভর বসে নৌকার হাট। হাটটি বর্তমানে শুধু একটি বাজার নয়, বরং হাওরাঞ্চলের মানুষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি জীবন্ত নিদর্শন।

এই হাটে ছোট-বড়, সরু-মোটা, হাতে বাওয়া বা ইঞ্জিনচালিত নানা রকমের নৌকা পাওয়া যায়। চাহিদা ও ব্যবহার অনুযায়ী পাওয়া যায় খিলুয়া, চডানাও, খুশি, সরঙ্গা, চাচতলী ও বারকি নামের ভিন্নধর্মী নৌকা। কেউ কিনে মাছ ধরার জন্য, কেউবা পরিবারের চলাফেরা বা পণ্য পরিবহনের কাজে। নৌকা হাটের ইজারাদাররা জানান, প্রতিটি হাটবারে কয়েকশ নৌকা বেচাকেনা হয়, যার দাম শুরু হয় পাঁচ-ছয় হাজার টাকা থেকে, কখনোবা ২০-২৫ হাজার টাকাও ছাড়িয়ে যায়।

বর্ষা এলেই নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন কারিগররা। উত্তর নোয়াগাঁও, চামরদানী, মনকাইন্দা, কলমাকান্দা-সহ আশেপাশের গ্রামের নৌকার কারিগররাই মূলত এই হাটের প্রাণ। তারা বলেন, ‘সারা সপ্তাহ নৌকা তৈরি করি, আর শনিবারে হাটে এনে বিক্রি করি। এই কাজ করেই পরিবার-পরিজন নিয়ে জীবন চলে।’

নৌকা কিনতে আসা নূর ইসলাম নামে একজন ক্রেতা জানান, ‘আমি প্রতিবছর বর্ষার শুরুতে এই হাট থেকে একটি নৌকা কিনে নিই। বর্ষা শেষে আবার এই হাটেই বিক্রি করি। আজ একটি চলাফেরার জন্য নৌকা কিনেছি ৫ হাজার ৫০০ টাকায়। দাম খুব বেশি নয়, নাগালের মধ্যেই।’

মধ্যনগরের প্রবীণ সমাজকর্মীরা বলেন, ‘এই নৌকার হাট শুধু একটি বাজার নয়, হাওরবাসীর জীবনযাত্রার অংশ। এই হাটকে ঘিরে একসময় গ্রামীণ সংস্কৃতি ও মজার গল্পও জড়িয়ে ছিল। এখন কিছুটা হারিয়ে গেলেও এখনো তা টিকে আছে।’ তারা মনে করেন, এই হাটকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষণ করতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত