সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে মুন্সীগঞ্জের সবজির চারার খ্যাতি। সবজির চারা উৎপাদন করে এখানকার চাষিরা বছরে আয় করেন চার কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, এখানকার সবজির চারা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে দেশজুড়ে। সবজির চারা উৎপাদন করে স্বাবলস্বী হচ্ছেন এখানকার শতশত কৃষক ।
জানা গেছে, যথোপযুক্ত পরিচর্যা, উন্নত মানের বীজ থেকে উৎপাদিত চারা মুন্সীগঞ্জের চাষিদের এ সফলতা এনে দিয়েছে । চারা বিক্রি করে সফলতা পেয়ে এখন সবজির চারা উৎপাদনে ব্যস্ত সময় পার করছেন মুন্সীগঞ্জ সদর ও টঙ্গীবাড়ী উপজেলার প্রান্তিক কৃষকরা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শীতকালীন চারা সংগ্রহে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসছেন কৃষক ও চারা ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী চলতি মৌসুমে চারা বিক্রি করে কমপক্ষে চার কোটি টাকা আয়ের আশা কৃষকদের। অধিকাংশ কৃষকের মতে বর্তমানে সবজি উৎপাদনের চেয়ে সবজি চারা উৎপাদন বেশি লাভজনক হওয়ায় অনেকে সবজি চারা উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
সরেজমিন মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার রামপাল, রতনপুর, মহাকালী, বজ্রযোগিনী এবং টঙ্গীবাড়ী উপজেলার ধামারণ, আলদী, কাঠাদিয়া, আব্দুল্লাপুর, বেতকা গ্রামসহ আশপাশের গ্রাম ঘুরে দেখা যায় বীজতলার কাছে কেউ ক্রেতাদের সঙ্গে দরকষাকষি করছেন, কেউ আবার চারা তুলে ক্রেতাদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন, কেউ পরম যত্নে চারার বীজতলায় পানি দিচ্ছেন। মাঠজুড়ে এক অন্যরকম ব্যস্ততা।
চারা উৎপাদনকারী একাধিক কৃষকের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, মুন্সীগঞ্জ সদর ও টঙ্গীবাড়ী উপজেলায় শীতকালীন সবজি চারা উৎপাদন ও বিক্রি দীর্ঘদিনের ব্যবসা। নিজ জমিতে আবাদের আগে আগস্ট মাস থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত চার দফা বীজতলায় ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, টমেটো, ব্রোকলি, কুমড়া, বেগুন, মরিচ, প্রভৃতি সবজির চারা বিক্রি করে থাকেন। চারা উৎপাদনে রয়েছে বিভিন্ন ধাপ অপেক্ষাকৃত উঁচু উর্বর জমিকে ১২ ফুট বাই ৪ ফুট অংশে ভাগ করা হয়। একে বিট বলে। প্রতিটি বিটে খৈল ও জৈবসার প্রয়োগ করে উর্বরতা বাড়ানো হয়। একেকটি বিটে তিন থেকে চার হাজার বীজ ছিটিয়ে দেওয়া হয়। বীজ ছিটানোর পর চারা গজায়, গজানো এসব চারা ২০ দিনের মধ্যে বিক্রির উপযুক্ত হয়ে যায়। চারা গুণগত মান ধরে রাখতে ওষুধ ও ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করা হয়। রৌদ্র, বৃষ্টি ও মাত্রাতিরিক্ত কুয়াশার প্রকোপ থেকে চারা রক্ষায় মাচার ওপর বাঁশের তৈরি চাটাই দিয়ে দিনে কমপক্ষে দুবার ঢাকা ও খোলা হয়। সবজির প্রকারভেদে প্রতি হাজার চারা বিক্রি হয় এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকায়। তবে বাজারের চাহিদা ও মান অনুযায়ী এ দাম হেরফের হয়ে থাকে।
রতনপুর এলাকার কৃষক আরমান জানান, এ বছর ৫০ শতাংশ জমিতে তিন দফায় চারা উৎপাদনে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করেছেন। এ পর্যন্ত যে বিক্রি হয়েছে ভালোই লাভ হয়েছে। এ বছর অতিবৃষ্টিতে বীজতলার চারা কিছু নষ্ট হওয়ায় অধিকাংশ কৃষক কিছুটা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এছাড়া বীজের দামও এবার কিছুটা বাড়তি বলে তিনি জানান।
সদর উপজেলার পঞ্চসার ইউনিয়নের ভট্টাচার্যেরবাগ গ্রামের দুলাল শিকদার চলতি মৌসুমে ৪২ শতাংশ জমিতে বীজতলা করেছেন। খরচ হয়েছে প্রায় আট লাখ টাকা। তিনি জানান, চারা উৎপাদনে বীজতলার যত্ন নিতে হয় বেশ। এতে বিনিয়োগ করে অর্ধেক পরিমাণ লাভ হয়। একই ইউনিয়নের বণিক্যপাড়া গ্রামের কৃষক হারুন মিয়া বলেন, এখানকার বীজতলার চারা উৎকৃষ্ট মানের। এতে দেশের বিভিন্ন জেলার কৃষকের কাছে এর চাহিদা বেশি। তাই কখনো বীজতলা করে লোকসান হয়নি। ইতোমধ্যে চারা উত্তোলন করে বিক্রিও করেছেন। আর এতে সব খরচ বাদে তিনি লাভের আশা দেখছেন।
চাঁদপুর থেকে আসা ক্রেতা বসির আহমেদ বলেন, মুন্সীগঞ্জের চারার মান ভালো। এছাড়া যোগাযোগ সহজতর হওয়ায় প্রতিবছর মুন্সীগঞ্জ থেকে চারা সংগ্রহ করি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, চলতি বছর জেলায় চার হাজার ৯০৭ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ৪২৩ টন সবজি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কর্মকর্তা রনি দাস জানান, শীতকালীন সবজি চারা উৎপাদন এ অঞ্চলে লাভজনক পেশা। জেলার দুই উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের কৃষক বীজতলায় চারা উৎপাদন পেশা হিসেবে নিয়েছেন। চারা উৎপাদনে জৈবসার ও খৈল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ কারণে এখানকার চারার গুণগতমান ভালো। তিনি আরো জানান, স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পর এখানকার সবজি চারা কেরানীগঞ্জ, সাভার, মানিকগঞ্জ, সিলেট, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, চাঁদপুর ও বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকারদের কাছে বিক্রি হয়ে থাকে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. হাবিবুর রহমান জানান, এ জেলায় শীতকালীন সবজি আবাদ শুরু হয়ে গেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে চারা উৎপাদনে বীজতলা করে উৎপাদিত চারা বিক্রি করে বাড়তি আয় করছেন কৃষকরা। উৎপাদিত চারা জেলার স্থানীয় কৃষকের চাহিদা পূরণ করে দেশের ২৫টি জেলায় বিক্রি হচ্ছে। এসব চারার গুণগতমান ভালো।

