চারটি নির্বাচনী আসন নিয়ে গঠিত বাণিজ্যিক রাজধানীখ্যাত চট্টগ্রাম মহানগর। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ এই আসনগুলো নিজেদের করে নিতে মাঠে থাকা সব রাজনৈতিক দলই সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকা রাজনৈতিক দলগুলো এখন মাঠে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।
তবে এখন পর্যন্ত প্রচারণা ও আনুষঙ্গিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কিছুটা এগিয়ে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী। কারণ, জুলাই বিপ্লবের কিছু দিন পরই সব আসনে একক প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাচনি বোর্ড। প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত হওয়ায় আগেভাগেই মাঠ গোছাতে শুরু করেছে দলটি। ইতোমধ্যে এলাকাভিত্তিক পরিচিতি সভা, কর্মিসভা ও পাড়া-মহল্লাভিত্তিক গণসংযোগ শুরু করেছেন জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীরা।
অন্যদিকে আসনগুলোতে বিএনপির একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী সক্রিয়। কোথাও আবার প্রার্থী বাছাই নিয়ে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের অপেক্ষা। এ অবস্থায় মাঠে সংগঠন থাকলেও আগামী নির্বাচনে দলের কান্ডাড়ি কে হবেন- সেটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এর ওপর সম্প্রতি চলমান ওয়ার্ড কমিটি ও মহানগরীর কাউন্সিল নিয়ে তৈরি হয়েছে বিভক্তি। জুলাই আন্দোলনের শুরুতে হঠাৎ করে নগর বিএনপির কমিটি ভেঙে আহবায়ক কমিটি গঠন করে বিএনপি।
নতুন আহবায়ক কমিটি বিভিন্ন ওয়ার্ড ও মহল্লা কমিটি ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করলেও তাতে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে বিক্ষোভ চলছে প্রতিদিনই। নির্বাচনের আগে এসব ছোট-খাটো বিরোধ না মেটাতে পারলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ফলাফলে। তবে বিএনপি নেতাদের দাবি, বড় দলে প্রতিযোগিতা থাকাটা স্বাভাবিক। ১৬ বছর ধরে নির্বাচনী আমেজ উপভোগ করতে পারেননি দলটির নেতাকর্মীরা। নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা হলে সবকিছু ভুলে দলীয় মনোনীত প্রার্থীর পক্ষেই তারা ঐক্যবদ্ধ থাকবেন বলে মনে করে দলটি।
চট্টগ্রামের আসনগুলোতে এনসিপির তেমন শক্ত প্রার্থী নেই। কেন্দ্র থেকে কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় এখনো কেউ মাঠে নেই। মূলত মাঠ গোছাতে এখনো প্রাণপণ চেষ্টায় জুলাই বিপ্লবীদের রাজনৈতিক দলটি।
চট্টগ্রাম মহানগরীর আসনগুলো হলো চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও), চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বোয়ালখালী), চট্টগ্রাম-১০ (ডাবলমুরিং), চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা)। আসনগুলোতে ভোটারের সংখ্যা ২০ লাখের বেশি।

চট্টগ্রাম-৮ : মাঠে বিএনপির তিন ও জামায়াতের একক প্রার্থী
চান্দগাঁও, বোয়ালখালী ও পাঁচলাইশের আংশিক এলাকা নিয়ে চট্টগ্রাম-৮ আসন। এই আসনে জামায়াতের চূড়ান্ত প্রার্থী ডা. আবু নাসের। তিনি গত দুই মাস ধরে বোয়ালখালী, চান্দগাঁও ও কলসীদিঘির পাড় এলাকায় পরিচিতি সভা করেছেন।
অন্যদিকে আসটিতে তৎপর বিএনপির তিন মনোনয়নপ্রত্যাশী। এর মধ্যে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহবায়ক আবু সুফিয়ান, মহানগর বিএনপির আহবায়ক এরশাদ উল্লাহ শক্ত প্রার্থী। এর মধ্যে আবু সুফিয়ান ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন ও পরে একটি উপনির্বাচনে বিএনপির মনোনয়নে নির্বাচন করেছেন।
আসনটির বড় সমস্যা যাতায়াত ও জলাবদ্ধতা। কালুরঘাট সেতু না হওয়া বোয়ালখালীবাসীর জন্য অভিশাপ। আর চান্দগাঁও পাচলাইশের বড় এলাকাটিতে বর্ষাকালীন জলাবদ্ধতায় নাকাল বাসিন্দারা। প্রতিবারের নির্বাচনে প্রার্থীরা এসব সমস্যা সমাধানে প্রতিশ্রুতি দিলেও ভোটের পর সব ভুলে যান বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। তবে এবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রাম সফরে এসে কালুরঘাট সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেছেন। ভোটারদের প্রত্যাশা, এবার এমন একজন জনপ্রতিনিধি আসুক, যিনি জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকৃত উদ্যোগ নেবেন এবং কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবেন।
চান্দগাঁওয়ের ব্যবসায়ী আবদুল কাদের মিয়া বলেন, প্রতিবারই শুধু উন্নয়নের কথা শোনা যায়, কিন্তু চান্দগাঁওর জলাবদ্ধতা তো আগের চেয়েও ভয়াবহ হচ্ছে। আমরা এমন এমপি চাই, যিনি ফাইল ঠেলে নয়, বাস্তবে কাজ করে দেখাবেন।
বোয়ালখালী খিতারপুল এলাকার গৃহিণী সুলতানা রহমান বলেন, বোয়ালখালীতে একটা ভালো হাসপাতাল চাই। শুধু নির্বাচনের সময় মানুষ দেখা যায়, এরপর আর কেউ আসে না।
চট্টগ্রাম-৯ : অভিজ্ঞতা বনাম অবস্থান, এগিয়ে জামায়াত
কোতোয়ালী ও বাকলিয়া এলাকা নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম-৯ আসন। বিএনপিতে আসনটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডাক্তার শাহাদাৎ হোসেনের বলে পরিচিত। এই আসন থেকেই ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন ডা. শাহাদাৎ হোসেন। মনোনয়ন দৌড়ে এবার তার প্রতিদ্বন্দ্বী বয়সের ভারে ন্যুব্জ সাবেক মন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন ও নগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বকর। এছাড়া বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় তারুণ্যের সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবাল। সরাসরি রাজনীতিতে এলে তিনি এই আসনের ধানের শীষের কান্ডারি হতে পারেন বলে মনে করছেন কর্মীরা।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবুল হাসেম বকর মাঠে সক্রিয় আছেন। সিটি মেয়র ডা. শাহাদাৎ হোসেনের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে আসনটিকেই প্রাধান্য পাচ্ছে। তিনি জানান, গত ২৮ বছর ধরে এই আসনের এমপি হওয়ার স্বপ্ন বুনছেন তিনি। দল চাইলে মেয়র পদ ছেড়ে দিয়ে হলেও নির্বাচন করতে আগ্রহী। এছাড়া প্রচারণার মাঠে আছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শিল্পপতি শামসুল আলম।
তবে একক প্রার্থী হিসেবে আগে ভাগেই মাঠে নেমেছেন জামায়াত নেতা ডা. ফজলুল হক। স্থানীয় মসজিদ-মাদরাসা ও ওয়ার্ডভিত্তিক সভা করছেন তিনি। ঈদুল আজহার আগেই একদফা গণসংযোগ শেষ করেছেন ভোটারদের সঙ্গে।
ভোটাররা জানান, চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্র এই আসন। এখানে অপরাধ, ট্র্যাফিক জট ও ছিনতাই বড় সমস্যা। কোতোয়ালীর পুরোনো এলাকা ও বাকলিয়ার ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ফুটপাত দখল ও অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ জনদুর্ভোগ বাড়াচ্ছে। সাধারণ ভোটাররা একজন কর্মঠ ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির প্রার্থী চান, যিনি দুর্নীতিমুক্ত থেকে শহরের আইনশৃঙ্খলা ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবেন।
বাকলিয়া নতুন ব্রিজ এলাকার রিকশাচালক সাইফুল ইসলাম রিপন বলেন, আমরা ফুটপাতে দাঁড়ালেই পুলিশ উঠিয়ে দেয়। আবার ছিনতাই হলে কাউকে পাওয়া যায় না। যে নেতা আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারবে, তাকেই ভোট দেব।
চট্টগ্রাম-১০ : একই আসনে খসরু ও সাঈদ আল নোমান
ডবলমুরিং, পাহাড়তলী, হালিশহর ও খুলশী এলাকা নিয়ে চট্টগ্রাম-১০ আসন। আসনটিতে গার্মেন্টস শ্রমিক, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও ভাসমান ভোটার বেশি। প্রধান সমস্যা হচ্ছে শিল্পাঞ্চলের পরিবেশ দূষণ, শ্রমিক অধিকার হরণ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সংকট। পাহাড়তলীর নিচু এলাকায় পানি জমে থাকে, এতে ছড়িয়ে পড়ে ডেঙ্গু ও পানিবাহিত রোগ। শ্রমজীবী মানুষ চায় ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ আবাসন ও ন্যূনতম চিকিৎসা সুবিধা। তরুণ ভোটাররা চান কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন।
এখানে বিএনপির প্রয়াত ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমানের নির্বাচনি এলাকা। তার মৃত্যুর পর এই আসনের কান্ডারি হতে চান আব্দুল্লাহ আল নোমানের ছেলে সাঈদ আল নোমান। তিনি ইতোমধ্যে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন। বাবার অনুসারীদের নিয়ে বেশ আগে থেকেই মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন সাঈদ। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হওয়ায় শিক্ষিত-মার্জিত প্রার্থী হিসেবে ইতোমধ্যে ভোটারদের নজর কেড়েছেন তিনি।
এদিকে চট্টগ্রাম-১১ নিজের মূল আসন হলেও চট্টগ্রাম-১০ থেকেও নির্বাচন করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। খসরুর ছেলে ইসরাফিল খসরুও হালে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হয়েছেন। কর্মীদের ধারণাÑ নিজে নির্বাচনের কথা বলে মাঠ গুছিয়ে শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন দৌড়ে সাঈদ আল নোমানের সামনে ইসরাফিল খসরুকেই দাঁড় করিয়ে দেবেন আমির খসরু।
এদিকে এই আসনে জামায়াতের চূড়ান্ত প্রার্থী চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর অধ্যক্ষ শামসুজ্জামান হেলালী। খুলশী ও মুরাদপুর এলাকায় তার গণসংযোগ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
চট্টগ্রাম-১১ : দুই দলেই একক প্রার্থী
বন্দর, পতেঙ্গা, ইপিজেড, সদরঘাট নিয়ে চট্টগ্রাম-১১ আসন। বিএনপির পক্ষে এখানে আমীর খসরুকে একক প্রার্থী ধরা হলেও, তিনি একসঙ্গে চট্টগ্রাম-১০ আসনেও সক্রিয়। ফলে শেষ পর্যন্ত কোনো আসনে মনোনয়ন পাবেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে বিএনপির অন্যতম নীতিনির্ধারক আমীর খসরু শেষ পর্যন্ত এই আসন থেকেই নির্বাচনে অংশ নেবেন বলেই নেতা-কর্মীদের ধারণা। কারণ ২০১৮ সালের রাতের ভোটেও এই আসন থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন তিনি। তাই বিকল্প কোনো নেতা এই আসন থেকে মনোনয়ন চাওয়ার আগ্রহ এখনো দেখাননি।
অন্যদিকে আসনটিতে জামায়াত প্রার্থী শফিউল আলম। বন্দর থানা জামায়াতের সাবেক এই নেতা গত কয়েক মাস ধরে এলাকায় কাজ করছেন।
এই আসনের বড় চ্যালেঞ্জ হলো অবৈধ বসতি ও বিশুদ্ধ পানি। হালিশহরের জনবহুল এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট ও গ্যাস-বিদ্যুৎ সমস্যাও প্রকট। এখানকার ভোটাররা বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে এখানকার এমপি ছিলেন এমএ লতিফ। সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেয়ে চেম্বারকেন্দ্রিক রাজনীতিতেই বেশি সক্রিয় ছিলেন তিনি। তাই এবারে সুযোগ এলে এমন প্রার্থীকে তারা ভোট দিতে চান, যিনি পাহাড় রক্ষা, অবৈধ দখলমুক্ত নগর গড়া এবং নাগরিক সেবা নিশ্চিত করবেন।
পূর্ব-মাদারবাড়ী ওয়ার্ড এলাকার বেসরকারি চাকরিজীবী মাহফুজা খানম বলেন, বাসায় নিয়মিত পানি আসে না, গ্যাস থাকলেও চাপ নেই। অথচ এই এলাকায় বড় বড় নেতা থাকেন। তারাও যদি সমস্যার সমাধান না করেন, তাহলে সাধারণ মানুষের কী হবে?

