রোগাক্রান্ত পশুর চামড়া তকমা দিয়ে দরপতনের কারসাজি

মঈন উদ্দিন, রাজশাহী
প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২৫, ০৯: ৩০

প্রতি বছরের মতো এবারো রাজশাহীর অধিকাংশ চামড়া ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে নানা কৌশলে বিভিন্ন তকমা লাগিয়ে কোরবানির পশুর চামড়ার দরপতন ঘটিয়েছে। পাইকার ও আড়ৎদাররা গরুর ‘ল্যাম্পি স্কিন’ ও ‘অ্যানেক্স’ রোগ আছে দাবি করে চামড়ার দাম কমানোর কারসাজি করেছেন।

এ ছাড়াও অনেক ব্যবসায়ী চামড়ার মান খারাপ বলেও ভুয়া অভিযোগ তুলেছেন। তবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা বলেছেন, অসুস্থ পশু কোরবানি করার সুযোগ নেই। এ ধরনের পশু হাট বা খামারে বিক্রি হয়নি।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, গত কয়েক বছর থেকে সক্রিয় আছে চামড়া ব্যবসায়ীদের এ সিন্ডিকেট। কোরবানির পর বিভিন্ন অজুহাতে প্রতি বছর দাম কমানো হয়েছে চামড়ার। এবার সরকার থেকে চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিলেও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া বিক্রি করে লোকসান গুনেছেন। সিন্ডিকেট এতই শক্তিশালী যে, সরকারের নির্দেশনাকেও তারা রীতিমতো বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন ব্যবসায়ী। তারা সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি করতে পারেননি। ফলে লোকসানের বোঝাটা নিতে হয়েছে তাদেরই।

এ বছর সরকার চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুটে ৫ থেকে ১০ টাকা বাড়িয়েছে। কিন্তু নির্ধারিত দামের প্রভাব বাস্তবে লক্ষ্য করা যায়নি। বরাবরের মতো সেই সিন্ডিকেটই সক্রিয় থেকে তাদের ইচ্ছামতো চামড়ার দামের পতন ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ৬০ থেকে ৬৫ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও বাস্তবে চামড়া বিক্রি হয়েছে অর্ধেক দামে। আর এতে লোকসানের মুখে পড়েছেন রাজশাহী জেলার প্রায় তিন হাজার মৌসুমি ব্যবসায়ী।

রহিদুল ইসলাম, জাকির হোসেনসহ কয়েকজন মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী জানান, গত দুই বছরের তুলনায় এবার বাজার খুব বাজে গেছে। চামড়া কেনা হয়েছে ৮০০ থেকে হাজার টাকায়। কিন্তু বিক্রি করতে গিয়ে ৫০০ টাকাও দাম পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ লবণ, শ্রমিক খরচ সব মিলিয়ে দাম ওঠেনি। উল্টো আরো লোকসান হয়। তারা বলেন, শুধু দাম নির্ধারণ করে দিলেই হবে না। দর ঠিকভাবে বাস্তবায়ন, বাজার মনিটরিং, মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব হ্রাস এবং মৌসুমি ব্যবসায়ীদের জন্য প্রণোদনা ও সহায়তার ব্যবস্থাও প্রয়োজন। না হলে প্রতি বছর চামড়ার দাম কমবে।

এ বছর রাজশাহীতে কোরবানি হয়েছে ৩ লাখ ৪১ হাজার ৪৪৬টি পশু। এই বিভাগের আট জেলার মাদরাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে এ বছর কোরবানির ২ লাখ ৮৭ হাজার ৫২৪টি গরু, মহিষ ও ছাগলের চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

নওদাপাড়া এলাকার ব্যবসায়ী নাসির ও জুয়েল বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বেশি মূল্য নির্ধারণ করায় ২৫০ পিস চামড়া কিনেছি। এগুলো নিয়েছি ৭০০ থেকে ১০০০ টাকায়। ঈদে সারাদিন ঘুরে চামড়া সংগ্রহ করে বিকেলে বাজারে তোলার পর সন্ধ্যা পর্যন্ত কেউ দাম জিজ্ঞাসাও করেনি। পরে গড়ে ৩৩০ টাকা করে সব চামড়া বিক্রি করে দেই। এতে আমরা ৬০ শতাংশ পুঁজি হারিয়েছি। তারা আরো বলেন, সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে, তাহলেই চামড়ার সুদিন ফিরবে।

পবা এলাকার নুরুল ইসলাম বলেন, আমরা কয়েকজন মিলে এবার ১২শ’ চামড়া কিনেছি। আমাদের চামড়া কেনা হয়েছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে। এগুলো সংরক্ষণ করে লবণ মাখিয়ে রাখা হয়েছে। দু-একটা রোগাক্রান্ত গরু থাকতে পারে। তবে আড়ৎদাররা একের পর এক চামড়া দেখিয়ে বলছেন এগুলো রোগাক্রান্ত পশুর চামড়া।

রাজশাহী চামড়া ব্যবসায়ী গ্রুপের সভাপতি আসাদুজ্জামান মাসুদ চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেন, আমি আপনাদের বুঝাতে পারছি না কতগুলো গরুর চামড়ায় ল্যাম্পি স্কিন আছে। তিনি বলেন, সংগৃহীত ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ চামড়াই নষ্ট। তবুও আমরা রিস্ক নিয়ে এই চামড়া কিনেছি। এবার আমি নিজে সংগ্রহ করেছি সাড়ে ৭ হাজার চামড়া। আমরাও চাই না কারও লোকসান হোক।

বায়াবাজার হোম অ্যাপ্লায়েন্স ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বকুল বলেন, যারা কোরবানির পশু ক্রয় করেন তারা খুব সচেতন। যেহেতু আল্লাহর রাস্তায় পশু কোরবানি করতে হয় তাই সবাই পশু দেখেশুনে ক্রয় করেন, কেউ রোগাক্রান্ত পশু জবেহ করেন না।

এয়ারপোর্ট থানা এলাকার জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আতোয়ার রহমান বলেন, রাজশাহীর কোনো হাটে ল্যাম্পি স্কিন রোগাক্রান্ত গরু বিক্রি হয়নি। আর এই রোগও দৃশ্যমান। যে কোনো মানুষ দেখলেই বুঝতে পারবেন গরু ল্যাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত কিনা। গরুর চামড়ায় বিশাল আকৃতির ছোপ ছোপ দাগ দেখা যাবে।

রাজশাহী বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দপ্তরের পরিচালক ডা. আনন্দ কুমার অধিকারী বলেন, চামড়া ব্যবসায়ীরা গরু ল্যাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত বলে দাবি করছেন। কিন্তু তাদের কথার সঙ্গে মিল নেই। হাট বা খামারে এ ধরনের কোনো গরু বিক্রির সুযোগ নেই। মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি পেলে আমরা পরীক্ষা করে দেখব।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত