চট্টগ্রামের কালুরঘাট রেলসেতুতে ট্রেনের ধাক্কায় সিএনজি অটোরিকশায় থাকা দুই বছরের শিশু আয়েশাসহ ৩ জনের মৃত্যু কেবল একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা নয়- এটি যেন বারবার ঘটে যাওয়া ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে রেলপথে অন্তত হাজারও নিহত হয়েছেন, তদন্ত কমিটি হয়েছে শতাধিক, কিন্তু দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তির নজির খুবই বিরল।
২০১৫ সাল থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত রেলওয়ের নিজস্ব পরিসংখ্যান, সংবাদ প্রতিবেদন এবং যাত্রী সংগঠনগুলোর নথি ঘেঁটে দেখা যায়, দেশে রেলপথে মোট ১ হাজার ১১৬টি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত হাজারও, আহত হয়েছেন ১,৩০২ জনের বেশি। প্রতিটি বড় দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রায় ৮৭ শতাংশ ঘটনায় দায়ী করা হয়েছে চালক, সহকারী চালক, গার্ড, সিগন্যাল অপারেটর বা স্টেশন মাস্টারের গাফিলতিকে। তবে এসব তদন্তের ফলাফল গোপনই থেকে যায়। খুব কম ক্ষেত্রেই দোষীদের বিরুদ্ধে সাময়িক বরখাস্ত ছাড়া বড় কোনো শাস্তি কার্যকর হয়। কয়েক মাস পরে আবারও সেই ব্যক্তিরাই কর্মস্থলে ফিরে যান। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দবাগে আন্তঃনগর দুটি ট্রেনের সংঘর্ষে ১৬ জন নিহত হন। তদন্তে চালকের ভুল পাওয়া গেলেও কিছুদিন পরই তাঁকে অন্য স্টেশনে বদলি করা হয়।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘রেলওয়ে যতটা না অবকাঠামোগত সমস্যায় ভোগে, তার চেয়ে বেশি ভোগে জবাবদিহির অভাবে। ট্রেন চালিয়ে মানুষ মারলেও কেউ শাস্তি পায় না- এ ধারণা চালকদের মধ্যে বদ্ধমূল।’
সুরক্ষা নেই, প্রযুক্তি নেই, আছে অবহেলা ও অব্যবস্থা
বাংলাদেশ রেলওয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের ২৭৮৯টি রেল লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে প্রায় ২৩০০টিই অরক্ষিত। এসব স্থানে নেই গেট, গেটম্যান বা অ্যালার্ম ব্যবস্থা। আবার, দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ রেলপথই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বা তারও আগে নির্মিত। এসব লাইনে এখনও চলাচল করছে আধুনিক ট্রেন।
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল বিভাগের একজন প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘পাহাড়তলী থেকে কমলাপুর পর্যন্ত কিছু স্টেশনে এখনো ব্রিটিশ আমলের সিগন্যালিং ব্যবস্থা চালু আছে। ফলে চালকদের চোখের ওপর ভরসা করে চলতে হয়।’
চট্টগ্রামের কালুরঘাটে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাও এরই প্রতিফলন। ঈদের আগে রাতে পরিবার নিয়ে শহরে আসছিলেন সাজ্জাদ ও জুবাইদা দম্পতি। সিএনজিতে ছিল তাদের দুই বছরের কন্যাশিশু আয়েশা। গেটম্যানের লাল পতাকা, সিগন্যাল ও ডেড স্টপেজ উপেক্ষা করে পর্যটক এক্সপ্রেস ট্রেনটি ব্রিজে উঠে পড়ে এবং সিএনজিটিকে ধাক্কা দেয়। ঘটনাস্থলেই মারা যায় আয়েশা।
ঘটনার পর আয়েশার বাবা সাজ্জাদ নিথর শিশুটিকে কাঁধে নিয়ে বলতে থাকেন, ‘আল্লাহর জিম্মায় দিলাম আমার আয়েশারে… আমার মেয়েরে কই নিয়া গেল ট্রেনটা…’
চারদিকে তখন কান্না, চিৎকার আর স্তব্ধতা
রেল দুর্ঘটনার সংখ্যা এবং তাতে প্রাণহানির ঘটনা প্রতি বছর ক্রমশ বেড়েই চলেছে। গত দশক ধরে বিভিন্ন বড় দুর্ঘটনায় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং আরও অনেকেই আহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনার পেছনে মূলত রেলপথের নাজুক অবস্থা, সংকেত বিভ্রাট, দ্রুতগতিতে চলাচল, এবং মানবিক ভুল দোষী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটে যাওয়া এসব দুর্ঘটনা যাত্রীদের মাঝে নিরাপত্তাহীনতার ভাব সৃষ্টি করেছে।
বড় আলোচিত রেল দুর্ঘটনা
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনাটি ঘটে ১৯৮৯ সালের ১৫ জানুয়ারি, গাজীপুরের টঙ্গীর মাজুখানে। একটি আন্তঃনগর এবং একটি মেইল ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রাণ হারান অন্তত ১৭০ জন যাত্রী, আহত হন আরও প্রায় ৪০০ জন। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হয় সিগন্যাল ব্যবস্থার ব্যর্থতা ও দায়িত্বহীনতা। দীর্ঘ সময় ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে ওই পথে। এত প্রাণহানির পরও কারও বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে পাঁচ মাস পর, ১৯৭২ সালের ২ জুন যশোরে ঘটে যায় একটি বড় রেল দুর্ঘটনা। লাইনচ্যুত হয়ে একটি যাত্রীবাহী ট্রেন দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এতে ৭৬ জনের প্রাণহানি ঘটে, আহত হন প্রায় ৫০০ যাত্রী। যুদ্ধবিধ্বস্ত রেলপথ, নজরদারির ঘাটতি ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে তৎকালীন তদন্তে উঠে আসে।
১৯৭৯ সালের ২৬ জানুয়ারি চুয়াডাঙ্গার কাছে চলন্ত একটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয়। নিহত হন অন্তত ৭০ জন যাত্রী, আহত হন আরও ৩০০ জন। দুর্ঘটনার পর প্রাথমিকভাবে জানানো হয়, লাইনের ধারে সংস্কারকাজ চলছিল এবং সেখানেই ভারসাম্য হারিয়ে ট্রেনটি উল্টে পড়ে। এর পরদিন জাতীয় সংসদে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও দোষীদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা দেখা যায়নি।
১৯৮৩ সালের ২২ মার্চ ঈশ্বরদীর কাছে একটি রেলসেতু ভেঙে পড়লে সেটি দিয়ে চলন্ত একটি ট্রেন নিচে পড়ে যায়। দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই মারা যান প্রায় ৬০ জন যাত্রী। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, রেলসেতুটির কাঠামো দীর্ঘদিন ধরেই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, কিন্তু সময়মতো সংস্কার হয়নি। পরবর্তীতে রেল মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করলেও কোনো শাস্তির খবর প্রকাশ্যে আসেনি।
২০১৯ সালের ২৩ জুন রাতে সিলেট থেকে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস কুলাউড়ার মনছড়া রেলসেতুতে দুর্ঘটনার শিকার হয়। ট্রেনটির বেশ কয়েকটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে নিচে পড়ে যায়। দুর্ঘটনায় ৫ জন যাত্রী নিহত হন, আহত হন শতাধিক। স্থানীয়দের অভিযোগ, সেতুটি বহুদিন ধরে জরাজীর্ণ ছিল। তদন্তে ত্রুটির তথ্য মিললেও আজও কেউ শাস্তি পায়নি।

