বিএনপি ও জামায়াতের ৪০ নেতাকর্মী খুন-গুম

জমির উদ্দিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৮: ৫৪

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে শুধু চট্টগ্রাম মহানগরীতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর অন্তত ৪০ নেতাকর্মী গুম-খুনের শিকার হয়েছেন। এই দেড় দশকে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, গ্রেপ্তারের নামে পুলিশি হয়রানি, এমনকি বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে।

নিহতদের মধ্যে কাউকে বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয়, কাউকে নিজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেই খুন করা হয়। আবার কাউকে রাজনৈতিক কর্মসূচি চলাকালীন গুলি করে হত্যা করা হয়। পরিবার, দলীয় সূত্র ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী ওইসব হত্যাকাণ্ড ও গুমের শিকার ব্যক্তিরা সবাই আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী ছিলেন। তাদের মধ্যে ২৫ জনই ছিলেন জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের। বাকিরা বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের নেতাকর্মী।

বিজ্ঞাপন

মহানগর জামায়াত দপ্তরের দায়িত্ব পালন করা এম আবদুল্লাহ আমার দেশকে বলেন, তাদের ২৫ নেতাকর্মী শেখ হাসিনার দুঃশাসনের সময় হত্যা ও গুমের শিকার হয়েছেন। আর নগর বিএনপির দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী আমলে বিএনপি-যুবদল-ছাত্রদলের ১৫ নেতাকর্মী হত্যার শিকার হয়েছেন।

দুই চোখ উপড়ে শিবিরকর্মীকে হত্যা

২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ের প্রতিবাদে অলঙ্কার মোড়ে জামায়াত-শিবিরের শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে জামায়াত-শিবিরের তিনজন নিহত হন। একইদিন নগরের পাহাড়তলী এলাকার ছাত্রশিবিরের তরুণ নেতা ইমরান খান পুলিশের বুলেটে প্রাণ হারান। সেদিন আরো দুজন আগ্রাবাদের শফিক ও দেওয়ানহাটে আফজাল নিহত হন। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন অন্তত ৩৫ জন। নিহত ইমরানের লাশ দুই ঘণ্টা রাস্তায় পড়ে থাকলেও কাউকে উদ্ধার করতে দেয়নি পুলিশ।

একই দিন আগ্রাবাদ এলাকায় বিক্ষোভে অংশ নেন ছাত্রশিবির নেতা আবিদ বিন ইসলাম। রাতে পুলিশ তাকে আটক করে। পরিবারের দাবি, এরপরই তার ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। দুই চোখ উপড়ে বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যার পর মরদেহ ফেলে দেওয়া হয় নালায়।

আবিদ পড়তেন চট্টগ্রাম সিটি কলেজে। তিনি ওই সময় এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। স্থানীয় তরুণদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তার কম্পিউটার ল্যাব, উন্মুক্ত গ্রন্থাগার আর সহজ-সরল মিশুক আচরণের জন্য।

২০১৫ সালের জানুয়ারিতে চট্টগ্রামের এক মেধাবী তরুণের জীবন থেমে যায় রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের নিষ্ঠুরতায়। মাত্র ২০ বছর বয়সে প্রাণ হারান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী, ছাত্রশিবিরের দক্ষিণ শাখার সদস্য প্রার্থী মুহাম্মদ সাকিবুল ইসলাম। পরিবারের সাত সন্তানের মধ্যে একমাত্র ছেলে ছিলেন তিনি।

চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানার পুটিবিলা গ্রামের সন্তান সাকিবুল। স্থানীয় বাইতুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদরাসার ছাত্র ছিলেন তিনি; পাশাপাশি চবিতে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছিলেন।

পরিবারে একমাত্র ছেলে সন্তান হিসেবে বাবা-মা ও বড় বোনদের অশেষ স্নেহের পাত্র ছিলেন। ছিলেন চট্টগ্রাম নগর দক্ষিণ শাখার সদস্য প্রার্থী এবং ক্যাম্পাস বি-ওয়ার্ড সেক্রেটারি।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন চলছিল টানা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে। সেই প্রেক্ষাপটে ২০১৫ সালের ২০ জানুয়ারি বোনের বাসা থেকে রিকশাযোগে ক্যাম্পাসে ফিরছিলেন শিবির নেতা সাকিবুল। কদমতলী মোড়ে দুর্বৃত্তদের ছোড়া বোমার আঘাতে আহত হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন তিনি। সেখান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। অভিযোগ আছে, থানায় নিয়ে তাকে ঠাণ্ডা মাথায় বন্দুকের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়। পরে গুরুতর অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে।

পরিবার ও সংগঠনের নেতারা উন্নত চিকিৎসার আবেদন করলেও দীর্ঘ সময় অনুমতি দেওয়া হয়নি। অবশেষে ২৬ জানুয়ারি ঢাকায় নেওয়ার অনুমতি মেলে। ২৭ জানুয়ারি ভোরে তাকে অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু দুদিনের মাথায় তার মৃত্যু হয়।

সব শেষে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বিকালে চট্টগ্রামের মুরাদপুর মোড়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিক্ষোভে পুলিশের উপস্থিতিতে ছাত্রলীগের হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ওমরগণি এমইএস কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ শান্ত। তিনি চট্টগ্রাম মহানগর দক্ষিণ শাখার সাথী এবং স্কুল পশ্চিম ওয়ার্ডের সভাপতি ছিলেন। সহপাঠীদের ভাষ্য অনুযায়ী, শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেওয়ার কিছুক্ষণ পরই ছাত্রলীগ অতর্কিত হামলা চালায়। এক পর্যায়ে গুলি ছুড়লে শান্ত বুকের ডান পাশে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশি বাধাবিপত্তি মাড়িয়ে লাশ গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জে নিয়ে দাফন করা হয়।

বিএনপি নেতাকর্মী হত্যা

শুধু হত্যা নয়, হাসিনার আমলে নগরে বহু বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীকে গুম করে নির্যাতনের মাধ্যমে পঙ্গু করে দেওয়া হয়। তাদেরই একজন নগর ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক সাইফুল ইসলাম সাইফ। ২০২১ সালের ১৬ জুন পুলিশের সোর্স আকাশ তাকে ফোন করে অক্সিজেন মোড়ে ডেকে নেয়। সেখান থেকে বায়েজিদ থানা পুলিশের একদল সদস্য তাকে ধরে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়।

এরপর বায়েজিদ লিংক রোড এলাকায় গহীন পাহাড়ে নিয়ে তার কাছে ১৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে স্থানীয় থানার তৎকালীন ওসি কামরুজ্জামানসহ অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তা। চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় পাহাড়ের নির্জন স্থানে নিয়ে তাকে গুলি করা হয়। আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পর একটি পা কেটে ফেলতে হয় তার। এখানেই ক্ষান্ত হয়নি পুলিশ বাহিনী। সাজানো অস্ত্র মামলায় তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর দীর্ঘ ৯ মাস পর জামিনে বের হন সাইফুল। সেই থেকে পা-বিহীন দুঃসহ যন্ত্রণায় জীবন পার করছেন সাইফুল ইসলাম সাইফ।

নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রায় দুই ঘণ্টা চোখ-মুখ বাঁধা অবস্থায় গাড়িতে ঘুরিয়ে আমাকে বায়েজিদ লিংক রোডে গাড়ি থেকে নামিয়ে উপপরিদর্শক মেহের অসীম দাশ ওসি কামরুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলে আমাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘ওপর থেকে তোমার ক্রসফায়ারের অর্ডার আছে, ১৫ লাখ টাকা দিলে আমরা ছেড়ে দেব। আমি অনেক আকুতি-মিনতি করি। এরপরও তাদের হৃদয়ে দয়া হয়নি। আমাকে বলা হয়Ñতোকে কোনো ক্ষমা নয়, তুই ছাত্রদল করিস। অতঃপর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আমাকে কৃত্রিম পা লাগাতে সহযোগিতা করেছেন। এ ঘটনায় আমি ছয় পুলিশ সদস্য ও এক সোর্সের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছি।

২০১৩ সালের ১৯ মে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতকর্মীদের সংঘর্ষে আহত হন যুবদল নেতা হুমায়ুন কবীর। পরদিন তার মৃত্যু হয়। তিনি শুলকবহর ওয়ার্ড যুবদলের সহসভাপতি ছিলেন।

চট্টগ্রামের কদমতলী এলাকার পরিবহন ব্যবসায়ী ও সদরঘাট থানা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক হারুন চৌধুরী ছিলেন পরিবারের একমাত্র ভরসা। রাজনৈতিক পরিচয়ের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে তিনি ছিলেন সবার আস্থার জায়গা। কিন্তু ২০১৭ সালের ৩ ডিসেম্বর কদমতলীর অফিসে বসা অবস্থায় দুর্বৃত্তরা গুলি চালিয়ে তাকে হত্যা করে। ফলে স্ত্রী-সন্তানদের ভবিষ্যৎ মুহূর্তেই অন্ধকারে ঢেকে যায়।

চট্টগ্রামের কদমতলী এলাকার চন্দনপুরার বাসা থেকে ২০১৭ সালের ২৯ মার্চ রাতে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের তৎকালীন সহ-সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলমকে। পরদিন ৩০ মার্চ রাউজানের বাগোয়ান ইউনিয়নের কর্ণফুলী নদীর তীর থেকে হাত-পা ও মুখ বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করা হয় তার লাশ।

ঘটনার সাত বছর পর ২০২৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রাতে নিহত ছাত্রদল নেতার স্ত্রী সুমি আকতার চকবাজার থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলার প্রধান আসামি করা হয়েছে রাউজানের সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীকে। আসামির তালিকায় আছেন নোয়াপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন এসআই শেখ মুহাম্মদ জাবেদ এবং নোয়াপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান বাবুল মিয়াসহ ১৭ জন। অজ্ঞাত পরিচয়ের আরো ৩০-৪০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

নিহতের স্ত্রী সুমি আকতার বলেন, আমার সামনে বিছানা থেকে ঘুমন্ত অবস্থায় নুরুল আলমকে তুলে নেওয়া হয়। এরপর মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। সাত বছর আমি শুধু অপেক্ষা করেছি। এখন আর কিছু চাই না, শুধু হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই। নিহত নুরুল আলমের দুই মেয়ে ও এক ছেলে লেখাপড়া করছে। বাবাকে হারানোর বেদনা বয়ে বেড়ালেও বিচার না পাওয়ায় তারা হতাশ। সরকার পরিবর্তনের পর নতুন করে আশায় বুক বেঁধেছে পরিবারটি।

শেখ হাসিনার আমলে চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের পাঁচ নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়। তারা হলেন খুলশী থানা যুবদলের মো. সেলিম, মহানগর যুবদলের হুমায়ুন কবির, পাহাড়তলী থানা যুবদলের সাইদুল ইসলাম, আগ্রাবাদের হাজীপাড়া এলাকার যুবদলকর্মী মো. নাছির ও কদমতলীর যুগ্ম আহ্বায়ক হারুন চৌধুরী।

মহানগর যুবদলের সভাপতি মোশাররফ হোসেন দীপ্তি বলেন, শেখ হাসিনার দুঃশাসনে বিএনপি-যুবদল-ছাত্রদলের অসংখ্য নেতাকর্মী হত্যা ও গুমের শিকার হয়েছেন। কদমতলীতে পরিবহন ব্যবসায়ী ও যুবদল নেতা হারুন চৌধুরীকে দিনের আলোয় গুলি করে হত্যার ঘটনা সেই দুঃশাসনের জ্বলন্ত প্রমাণ। আওয়ামী সরকার ভিন্নমতকে দমন করতে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের রক্ত ঝরিয়েছে। অসংখ্য মানুষকে গুম করে হত্যা করা হয়েছে।

পুলিশের জঙ্গি নাটক

চট্টগ্রাম নগরের লালখান বাজারে জামেয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়া মাদরাসা। ২০১৩ সালের ৭ অক্টোবর বিকালের দিকে হঠাৎ করে সেখানে ঘটে এক বিস্ফোরণ। একটি কক্ষে থাকা ল্যাপটপ হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়েছিল। মাদরাসা কর্তৃপক্ষের দাবি, কেরোসিনচালিত চুলার আগুনে ল্যাপটপের ব্যাটারি বিস্ফোরণ হয়েছিল। এতে আগুন ধরে যায় কক্ষে, আহত হয় কয়েক ছাত্র।

কিন্তু ওই দুর্ঘটনাই পরিণত হয় এক নাটকীয় মোড় নেওয়া ঘটনায়। শেখ হাসিনা সরকারের প্রশাসন এটিকে ‘বোমা বিস্ফোরণ’ বলে প্রচার করতে শুরু করে। পরদিন সংবাদমাধ্যমে পুলিশ দাবি করে, মাদরাসা থেকে তিনটি হাতবোমা, ১৮ বোতল এসিড ও বিপুল পরিমাণ বোমা তৈরির সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে।

ঘটনার পরপরই আহত চারজনসহ মোট ৯ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। যারা চিকিৎসাধীন ছিলেন, তাদেরও হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে অভিযোগ আছে। পরদিন পুলিশ বিস্ফোরণ ও এসিড নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা করে। আসামির তালিকায় নাম আসে মাদরাসার পরিচালক মুফতি ইজহারুল ইসলাম ও তার ছেলে হারুন ইজহারের।

রহিম উল্লাহ নামে মাদরাসার এক শিক্ষক বলেন, আমরা তো দুর্ঘটনার শিকার হয়েছি। যেসব ছেলে পুড়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, তাদের সঙ্গেও যে এমন আচরণ হতে পারেÑতা ভাবতে পারিনি। শেখ হাসিনার প্রশাসন একটি দুর্ঘটনাকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ বলে চালিয়ে দিল।

তিনি আরো বলেন, এ ঘটনায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়। পরদিন থেকেই যুবলীগ ও ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা মাদরাসার সামনে বিক্ষোভ শুরু করে। তাদের অভিযোগ ছিল, মাদরাসায় ‘বোমার কারখানা’ চালানো হচ্ছিল। ওই সময় পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারাও গণমাধ্যমে একই বক্তব্য দিতে থাকেন। এর সবই ছিল সাজানো নাটক।

এরপর থেকে শুরু হয় মুফতি ইজহার ও তার পরিবারের ওপর দমন-পীড়ন। ২০১৫ সালে হারুন ইজহারকে তিন দফায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আবার ২০২১ সালে তাকে আটক করা হয়। মাদরাসার শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, পুলিশের অভিযানে অনেক কোমলমতি শিশুকেও ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।

হারুন ইজহার বলেন, লালখান বাজার মাদরাসার দুর্ঘটনাকে শেখ হাসিনা প্রশাসন জঙ্গি নাটক বানিয়েছেÑএটা দেশের মানুষ জানে। ২০১৩ সালের ওই বিস্ফোরণ ছিল নিছকই একটি দুর্ঘটনা। ল্যাপটপ ও কেরোসিনচালিত চুলার আগুনে যে দুর্ঘটনা ঘটল, তা মানবিকভাবে সহায়তা করার বদলে শেখ হাসিনার সরকার সুযোগ নিয়ে মাদরাসাকে জঙ্গি ঘাঁটি প্রমাণের চেষ্টা করল।

তৎকালীন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত কমিশনার বনজ কুমার মজুমদার, উপকমিশনার কুসুম দেওয়ান ও অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. শহীদুল্লাহ এ ঘটনার মূল ভূমিকায় ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। তাদের নির্দেশেই বিস্ফোরণকে কেন্দ্র করে মঞ্চস্থ হয় ‘জঙ্গি নাটক’।

মাদরাসার এক প্রাক্তন ছাত্র বলেন, সেদিন যদি শেখ হাসিনার প্রশাসন মানবিক আচরণ করত, তাহলে আহত ছাত্ররা চিকিৎসা পেত। কিন্তু উল্টো গ্রেপ্তার ও মামলার শিকার হতে হয়েছে তাদের। আমরা দেখেছি একটি দুর্ঘটনাকে কীভাবে নাটকে পরিণত করা যায়।

জুলাই আন্দোলনে বাবর-রনির

তাণ্ডবে ছয় তরুণ নিহত

গত বছরের ১৬ জুলাই চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর ও ১৮ জুলাই নগরের বহদ্দারহাটে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ ক্যাডারদের সংঘর্ষ হয়। এতে নেতৃত্ব দেন যুবলীগ সন্ত্রাসী হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর, ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী নুরুল আজিম রনি। তাদের নেতৃত্বে অন্তত অর্ধশতাধিক ছাত্রলীগ-যুবলীগ সন্ত্রাসী ছাত্রদের ওপর গুলি চালায়। ওই সময় ঘটনাস্থলে পাঁচজন, পরে একজনসহ মোট ছয়জন নিহত হন। এসব ঘটনায় আহত হন দুই শতাধিক মানুষ। যাদের মধ্যে ৮০ শতাংশই গুলিবিদ্ধ। ১৬ জুলাই নগরের মুরাদপুরে মারা যাওয়া তিনজন হলেন চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ওয়াসিম আকরাম। অপরজন ফারুক-যিনি পথচারী ছিলেন। আরেকজন চট্টগ্রাম নগরের ওমরগণি এমইএস কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ শান্ত।

১৮ জুলাই বহদ্দারহাটে সংঘর্ষে তিনজন নিহত হন। তারা হলেন চবির ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র হৃদয় চন্দ্র তরুয়া, তানভীর আহমেদ ও সাইমন হোসেন। সারা দেশে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে ১৬ জুলাই বেলা ৩টার দিকে চট্টগ্রামের মুরাদপুরে জড়ো হন কোটা আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের ক্যাডাররা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়। এ সময় সংঘর্ষের মধ্যে শিক্ষার্থীদের মিছিল লক্ষ্য করে চার ব্যক্তিকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। তাতে তিনজন নিহত হন। আহত হন অন্তত ৩০ জন।

এছাড়া ৩ আগস্ট সকালে নগরীর নিউমার্কেট এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা পূর্বনির্ধারিত বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু করলে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীরা তাদের ওপর একাট্টা হয়ে হামলা চালায়। এক পর্যায়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে কয়েকটি এলাকায়। হাসিনার আমলের শেষ সময়ে এই সংঘর্ষ চলে দিনভর। এতে কয়েকশ ছাত্র-জনতা গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন।

চসিক মেয়র ও তৎকালীন নগর বিএনপি সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন আমার দেশকে বলেন, শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের সময় চট্টগ্রাম নগরজুড়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর একের পর এক দমন-পীড়ন চলে। পুলিশ, প্রশাসন ও আওয়ামী বাহিনী মিলে যারাই গণতন্ত্রের কথা বলেছে, তাদের ঘরে ঢুকে, রাস্তায় ধরে কিংবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গুলি করে হত্যা করেছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের লাশে তখন ভরে উঠেছিল হাসপাতাল মর্গ। এ সময় চট্টগ্রাম হয়ে উঠেছিল মরণফাঁদ, যেখানে বিরোধী রাজনীতি মানেই ছিল জীবন বাজি রাখা।

তিনি আরো বলেন, আজও সেসব পরিবার বিচার পায়নি। যারা সন্তান হারিয়েছেন, তারা আজও প্রতিদিন কবরের পাশে ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকেন। শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের মুখোশ পরে যে বর্বরতা চালিয়েছে, ইতিহাস তাকে ক্ষমা করবে না কখনো। আমরা বিশ্বাস করি, ওইসব শহীদের হত্যাকারীদের বিচার হবেই।

তৎকালীন নগর জামায়াতের আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, শেখ হাসিনার সরকার জামায়াত-শিবিরের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, তা ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস অধ্যায়। চট্টগ্রামে আমাদের অন্তত ২৫ নেতাকর্মীকে হত্যা বা গুম করা হয়েছে। কেউ পুলিশের গুলিতে, কেউ তুলে নেওয়ার পর আর ফেরেননি। অনেককে কাছে থেকে গুলি করে, এমনকি চোখ উপড়ে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। এমন বর্বরতা পাকিস্তান আমলেও দেখা যায়নি।

তিনি আরো বলেন, শেখ হাসিনা চেয়েছিল ইসলামী আন্দোলন ও জামায়াতকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করতে; কিন্তু পারেনি। শহীদ ভাইদের রক্ত বৃথা যাবে না। আমরা আল্লাহর ওপর ভরসা রাখি; এই অন্যায়ের বিচার হবেই।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত