পাহাড়ে সেনা উপস্থিতি বাড়ানোর তাগিদ

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৯: ৩৫
সেনাদের চলাচলে বাধা দিতে খাগড়াছড়ির বর্মাছড়ি এলাকায় গাছের গুঁড়ি ফেলা হয়। ছবি: আমার দেশ

পার্বত্য অঞ্চলে শক্তি বাড়াচ্ছে আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। সম্প্রতি সংগঠনটি খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ির বর্মাছড়ি এলাকায় নতুন ঘাঁটি গড়ে তুলেছে। নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতা কম থাকায় সন্ত্রাসীদের উপস্থিতিও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এতে স্থানীয়দের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন সাধারণ পাহাড়ি ও বাঙালিরা।

বর্মাছড়ি এলাকাটি খাগড়াছড়ি সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত; চারদিকে ঘেরা ঘন বন ও পাহাড়। ইউনিয়নটি জুড়ে ৯ সহস্রাধিক চাকমা, মারমা, সাঁওতাল ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বসবাস। এখানেই ইউপিডিএফ দীর্ঘদিন ধরে তাদের সশস্ত্র তৎপরতা চালাচ্ছে। এলাকাটি রাঙামাটির নানিয়ারচর ও কাউখালী এবং চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ায় সীমান্তপথে অস্ত্র চোরাচালান ও সন্ত্রাসীদের আসা-যাওয়া বেড়েছে।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয় সূত্র জানায়, ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে অবৈধ অস্ত্র এ এলাকায় প্রবেশ করে এবং বর্মাছড়িতে মজুত রাখা হয়। এখান থেকেই সেই অস্ত্র পার্বত্য সশস্ত্র গোষ্ঠী ও সমতলের অপরাধীদের কাছে বিক্রি করা হয়। এসব অস্ত্র দিয়ে সংঘটিত হচ্ছে অপহরণ, চাঁদাবাজি ও খুনের ঘটনা। সন্ত্রাসীরা পাহাড়ি জনপদের সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের এলাকায় প্রভাব বিস্তার করছে। বছরজুড়ে নিরাপত্তা বাহিনী বর্মাছড়ি এলাকায় অন্তত আটটি বিশেষ অভিযান চালিয়েছে। তবে দুর্গম পাহাড়ি পথ ও যাতায়াতের সীমাবদ্ধতায় এসব অভিযানে স্থায়ী ফল মেলেনি। সেনাবাহিনীর ক্যাম্প থাকলেও তা মূল কেন্দ্র থেকে দূরে; এতে তাৎক্ষণিক অভিযান বা গ্রেপ্তার অভিযান পরিচালনা প্রায় অসম্ভব।

নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা মনে করছেন, ইউপিডিএফের এই অপতৎপরতা দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলোকে আবার অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। সংগঠনটি আবারও সশস্ত্রভাবে পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে। তারা যেন কোনোভাবে জনগণের নিরাপত্তা বিপন্ন না করতে পারে, সে জন্য সেনা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি বাড়ানো প্রয়োজন।

অন্যদিকে, ইউপিডিএফের সাইবার শাখা সামাজিকমাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়ে বলছে, সেনাবাহিনী বর্মাছড়ি এলাকায় ‘বিহারের জমিতে’ নতুন ক্যাম্প নির্মাণ করছে। কিন্তু প্রশাসন বলছে, এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল আমার দেশকে বলেন, ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে স্থানীয়দের উসকে দিয়ে একটি পক্ষ ফের বিশৃঙ্খলা তৈরির অপচেষ্টা করছে।

অস্থায়ী সেনাক্যাম্প ঠেকাতে অপপ্রচার

যৌথবাহিনীর নতুন ক্যাম্প স্থাপনের খবর ছড়িয়ে পড়তেই ইউপিডিএফ তাদের সাইবার ইউনিটের মাধ্যমে এলাকায় অপপ্রচার শুরু করে। তারা সাধারণ মানুষকে ‘বনবিহারের জায়গা দখল করা হচ্ছে’ বলে বিভ্রান্ত করছে। অথচ প্রশাসনের দাবি, স্থানটি সরকারি খাসজমি এবং সেখানে আগে কোনো বনবিহার ছিল না। ইউপিডিএফ কৌশলে সাধারণ পাহাড়িদের ব্যবহার করে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চায়, যাতে তাদের অস্ত্র ব্যবসা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত না হয়।

ছাত্র-জনতা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি উষাতন চাকমা বর্মাছড়ি ইউনিয়নে সেনাক্যাম্প স্থাপনের বিরুদ্ধে জনসংহতি সমিতিকে (জেএসএস) প্রকাশ্যে অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানান। সম্প্রতি নিজের ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, আমি সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতিকে আহ্বান জানাচ্ছি খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ির বর্মাছড়ি ইউনিয়নে আর্য কল্যাণ বনবিহারের জমি বেদখল করে সেনাক্যাম্প নির্মাণের বিরুদ্ধে একটি বিবৃতি দেওয়ার জন্য। শুধু উষাতন চাকমা নয়, বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে শতাধিক পোস্টে গুজব ছড়ানো হয় এবং স্থানীয়দের উসকে দেওয়া হয়।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বর্মাছড়ি ইউনিয়নের আর্য কল্যাণ বনবিহার এলাকায় সেনাবাহিনীর অস্থায়ী উপস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি সামাজিকমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা চলছে। সেনাবাহিনী জানায়, সেখানে কোনো নতুন ক্যাম্প নির্মাণ নয়, বরং নিরাপত্তা টহল ও পাহাড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার অংশ হিসেবেই অস্থায়ী অবস্থান নেওয়া হয়েছে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইউপিডিএফ একটি নির্বাচিত স্থানকে ধরে পরিকল্পিতভাবে ‘বিহারের জমি’ বলে দাবি করে দ্রুত জনমত তৈরির চেষ্টা করছে। প্রস্তাবিত অস্থায়ী যৌথবাহিনীর ক্যাম্প প্রান্ত বাস্তবে কোনো পুরোনো বিহার বা ধর্মীয় স্থান নয়; বরং সেটি সরকারি খাসজমি। প্রকৃত বিহার বসতঘর ও চলাচলের স্থান থেকে প্রায় চার কিমি দূরে পাহাড়ের ওপরে।

বিশ্লেষক ও নিরাপত্তা কর্মকর্তারা মনে করেন, এরকম অপপ্রচারের লক্ষ্য স্রেফ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অপসারণ করাই নয়; বরং স্থানীয় জনগণের পূর্বাভাস ও ভীতি তৈরি করে সশস্ত্র গোষ্ঠীর অসম্পৃক্ত দখল বজায় রাখা। তারা বলছেন, যখনই অভিযান বা টহল দেওয়া হয়, তখনই ইউপিডিএফ ভিন্ন কৌশলে সামাজিক বিভ্রাট তৈরি করতে গুজব ছড়ায় বিহার, মাজার বা বনবিহার ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে। এতে সশস্ত্র ঘাঁটিতে তাদের চক্র অবাধে কাজ চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

এদিকে নিরাপত্তা বাহিনীর অভ্যন্তরীণ এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্মাছড়িতে সেনা ও যৌথবাহিনীর স্থায়ী টহলকেন্দ্র স্থাপন করা গেলে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে আসবে। এলাকাটি ভৌগোলিকভাবে কৌশলগত। এখান থেকেই সন্ত্রাসীরা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও চট্টগ্রামের সংযোগপথে পালিয়ে যায়। তাছাড়া আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ইউপিডিএফ নতুন করে অস্ত্র মজুত করছেÑএমন শঙ্কাও রয়েছে।

স্থানীয় প্রশাসন মনে করছে, বর্মাছড়িতে অস্থায়ী যৌথবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন এখন অপরিহার্য। এতে পাহাড়ে সশস্ত্র সংগঠনগুলোর চলাচল ও অস্ত্র চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে, প্রশাসনিক তৎপরতা বাড়বে, নির্বাচনি কর্মকর্তা ও ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এবং যেকোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে দ্রুত অভিযান চালানো যাবে।

সেনা নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হলে বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি

বিশ্বের ইতিহাসে একাধিক উদাহরণ আছেÑযেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের সেনা নিয়ন্ত্রণ দুর্বল, সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো ক্রমে শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামেও যদি সেনা উপস্থিতি শিথিল হয়, তবে পূর্ব তিমুর বা দক্ষিণ সুদানের মতো পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে।

বিশ্লেষকরা বলেন, ১৯৯৯ সালে ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুরে সেনা নিয়ন্ত্রণ কমানোর সিদ্ধান্তই শেষ পর্যন্ত অঞ্চলটির স্বাধীনতার পথ সুগম করে। দীর্ঘদিন সেনা উপস্থিতির কারণে যেসব সশস্ত্র গোষ্ঠী কোণঠাসা ছিল, সেনা প্রত্যাহারের পর তারা সংগঠিত হয়। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত গণভোটে জনসমর্থন পেয়ে পূর্ব তিমুর ইন্দোনেশিয়া থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তেমনি সুদানের দক্ষিণাঞ্চলে ২০০৫ সালের শান্তিচুক্তির পর যখন সরকার সেনা প্রত্যাহার করে নেয়, তখন ‘সুদান পিপলস লিবারেশন আর্মি’ (এসপিএলএ) নতুন করে সংগঠিত হয়, শক্তি অর্জন করে। পরে ২০১১ সালে গণভোটে দক্ষিণ সুদান স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, সেনা নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হওয়াই সে সময় বিচ্ছিন্নতার সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সার্বিয়ার কসোভো প্রদেশেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে। ১৯৯৯ সালে ন্যাটোর হামলার পর সার্বীয় সেনারা পিছু হটে গেলে আলবেনীয় গেরিলারা পুরো অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ২০০৮ সালে কসোভো একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে, যা আজও সার্বিয়া স্বীকার করে না। সেনা নিয়ন্ত্রণ হারানোই সেখানে বিচ্ছিন্নতার সূচনা ঘটায়।

ইথিওপিয়ার ইরিত্রিয়া প্রদেশে ১৯৮০-এর দশকে যখন সেনা অভিযান সীমিত করা হয়, তখন ইরিত্রিয়ান মুক্তিসেনারা পুরো উত্তরাঞ্চল দখল করে নেয়। ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত গণভোটে ইরিত্রিয়া স্বাধীনতা লাভ করে।

বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, যেখানেই কেন্দ্রীয় সেনা উপস্থিতি দুর্বল হয়েছে, সেখানেই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ভেঙে পড়েছে। তাদের মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো ভূরাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল এলাকায় সামরিক উপস্থিতি কমানো মানেই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর জন্য সুযোগ তৈরি করে দেওয়া।

তারা বলছেন, ওই এলাকায় এখনই যৌথবাহিনীর উপস্থিতি বাড়ানো দরকার। তা না হলে সেনা নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হওয়ার সুযোগে বিশ্বের অনেক দেশের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামকেও হারাতে হবে।

সন্ত্রাসীদের ঘাঁটিতে ভারী অস্ত্র ব্যবহার চান এম শাহীদুজ্জামান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান বলেন, পাহাড়ে বর্তমানে সেনা তৎপরতা বাড়ার পেছনে সশস্ত্র বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা আছে। তার ভাষায়, অপারেশনগুলো থেকে সেনা যখনই টহল দিচ্ছে, তখনই মাঠে এক ধরনের কৌশল দেখা যাচ্ছে, আর তা হলো সন্ত্রাসীদের পক্ষ থেকে নারী ও শিশুদের সামনে রেখে অবস্থান নেওয়া। সামনের সারিতে তারা রাখছে নারী-শিশুকে, পেছন থেকে উসকে দিয়ে টহল বন্ধ করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা কৌশলগত প্রতিবন্ধকতা নয়, বরং কাপুরুষতার লক্ষণ।

অধ্যাপক শাহীদুজ্জামান এই পদ্ধতিকে মানুষকে সরাসরি ফাঁদে ফেলার চেষ্টা হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন এবং সতর্ক করেছেন যে, যদি এর বিরুদ্ধে যথাযথ গোয়েন্দা ও পরিকল্পনামূলক ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে পরিস্থিতি দ্রুত সংকটময় রূপ নিতে পারে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে ভারী অস্ত্র ব্যবহার করতে হবে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত