অর্ধশত নেতাকর্মীকে হত্যা, পঙ্গুত্বের শিকার ২৩

এস এম ইউসুফ আলী, ফেনী
প্রকাশ : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮: ৫৩
আপডেট : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯: ১৯

স্বাধীনতার পর থেকে বরাবরই সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে খ্যাত ছিল ফেনী। আয়তনে ছোট হলেও দেশজুড়ে এই জেলা সব সময় থাকে আলোচনা-সমালোচনায়। স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে সাবেক মন্ত্রী জাফর ইমামের নেতৃত্বে টাইগার বাহিনী, ৯৬-এর পর জয়নাল হাজারীর স্টিয়ারিং বাহিনী; সর্বশেষ ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছর দাপিয়ে বেড়িয়েছে হাজারী বাহিনীর সন্ত্রাসীরা। তাদের অস্ত্রের ঝনঝনানিতে তটস্থ থাকত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও জেলাবাসী।

ফেনী ছিল জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থিদের উর্বর ভূমি। এখানে জন্মগ্রহণ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং জামায়াতে ইসলামীর প্রয়াত আমির মকবুল আহমেদ। নাস্তিক-কমিউনিস্টদের ভিত্তি না থাকায় আওয়ামী লীগেরও তেমন জনসমর্থন নেই এখানে।

বিজ্ঞাপন

এ কারণে আধিপত্য বিস্তারের জন্য সব সময় অস্ত্রবাজ ক্যাডার বাহিনী ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করেছে ফ্যাসিবাদী দলটি। এভাবে কুক্ষিগত করে রেখেছে ক্ষমতা।

প্রবাসী অধ্যুষিত ও ঢাকা-চট্টগ্রামের লাইফলাইন খ্যাত ফেনীর রাজনীতিতে ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিরোধী মত দমনে অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে। বিএনপি-জামায়াত সমর্থিতদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দলীয় কার্যালয়ে হামলা, নেতাকর্মীদের গুম-খুনসহ মিছিল-সমাবেশে আক্রমণ করে হতাহতের ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

আওয়ামী গুণ্ডাবাহিনীর সঙ্গে মিলে গিয়েছিল ফ্যাসিবাদী সরকারের দলবাজ কর্মকর্তারা। তাদের যোগসাজশে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নগ্ন হস্তক্ষেপের পাশাপাশি চলে কথায় কথায় হত্যাকাণ্ড, গুম ও মামলা-হামলার ঘটনা। এতে সাড়ে ১৫ বছর এই জেলার পরিচিতি ছিল আতঙ্কের জনপদ হিসেবে।

আওয়ামী দুঃশাসনে ফেনীর বাসিন্দা বিশেষ করে বিরোধী মতের লোকদের ওপর অত্যাচারের খড়গ চালিয়েছে দলটির নেতারা। তাদের মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম হাজারী, শেখ রেহানার ‘ক্যাশিয়ার’খ্যাত আলাউদ্দিন নাসিম, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সুশেন চন্দ্র শীল, জেলা যুবলীগ সভাপতি দিদারুল কবির রতন, ছাগলনাইয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেজবাউল হায়দার চৌধুরী সোহেল, ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুন মজুমদার, পরশুরাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন চৌধুরী সাজেল, সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম খোকন, দাগনভূঞা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন মামুন, ফেনী পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মামুনুর রশীদ মিলন উল্লেখযোগ্য। তাদের নিয়ে গঠিত বিশেষ বাহিনী গঠন করে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম করা হয়। এসব নিয়ন্ত্রণ করতেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

ক্ষমতার লোভে জোট বেঁধে বিনা ভোটের এমপি হয়ে এ অপকর্মের সঙ্গী হন জাসদ (ইনু) কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শিরিন আক্তার এবং ১/১১-এর খলনায়ক জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ৪০ নেতাকর্মী খুন হন। গুমের শিকার হয়ে এখনো এক যুবদল নেতা নিখোঁজ আছেন। পঙ্গুত্ব বরণ করেন ২০ জন। আহত হয়েছেন পাঁচ সহস্রাধিক নেতাকর্মী।

এছাড়া জামায়াত-শিবিরের ১০ নেতাকর্মী নিহত হন। পঙ্গুত্ব বরণ করছেন তিনজন। আহত হয়েছেন তিন সহস্রাধিক নেতাকর্মী। হামলা থেকে বাদ পড়েনি বিএনপি চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুর গাড়িবহর। মামলা থেকে বাদ যাননি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও। আক্রোশের শিকার হয়েছেন সাংবাদিকরাও। বছরের পর বছর সিলগালা ছিল ফেনী প্রেস ক্লাব।

এসব হতাহতের অধিকাংশ ঘটনায় উল্টো বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। বেশিরভাগ মামলার বাদীই পুলিশ অথবা আওয়ামী লীগ ক্যাডাররা। এছাড়া নাশকতাসহ আট শতাধিক গায়েবি মামলায় দুদলের ৩০ সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। বহু নেতাকর্মীর ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়েছে। অনেকে বাড়িতে ঘুমাতে পারেননি শত শত রাত। ফেরারি হয়ে রাত কাটিয়েছেন ক্ষেতখামার-নদীনালার পাড় বা ঝোপঝাড়ে। এর মধ্যে জেলা বিএনপি সভাপতি অ্যাডভোকেট আবু তাহের ও জেলা জামায়াতের আমির লে. কর্নেল (অব.) নাজেম ওসমানী নাশতার মিথ্যা মামলা মাথায় নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।

গায়েবি মামলায় আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা জিয়াউদ্দিন মিস্টার, মেজবাহ উদ্দিন খান, জেলার শীর্ষ নেতা শেখ ফরিদ বাহার, আলাল উদ্দিন আলাল, গাজী হাবিব উল্যাহ মানিক, আনোয়ার হোসেন পাটোয়ারী, জেলা জামায়াতের শীর্ষ নেতা সামছুউদ্দিন, মুফতি আবদুল হান্নান, আ ন ম আবদুর রহিম ও মো. ইলিয়াস। এর মধ্যে জেলা বিএনপির শীর্ষ নেতা গাজী হাবিব উল্যাহ মানিক শতাধিক মামলায় ১১ বার গ্রেপ্তার হয়ে সাড়ে তিন বছর কারাগারে ছিলেন।

গুলি করে প্রকাশ্যে হত্যা

২০১৩ সালে ফেনী শহরের এসএসকে সড়কে বিএনপির বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালালে ফরহাদনগর ইউনিয়ন যুবদলের সহসভাপতি হারুনুর রশিদ ঘটনাস্থলেই নিহত হন। সদর উপজেলার বালিগাঁও ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মনিরকে ২০১৩ সালের ৫ আগস্ট বিয়ের দাওয়াত খেয়ে বাড়ি ফেরার পথে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে পিটিয়ে ও কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।

২০১৫ সালের ৮ ডিসেম্বর রাতে শহরের খেজুরিয়া রাস্তার মাথায় তৎকালীন ফেনী মডেল থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বে মিছিলে গুলি চালিয়ে হাফেজ আবদুল্লাহ আল সালমান নামে এক শিবির নেতাকে প্রকাশ্যে হত্যা করে পুলিশ। একইভাবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের দিন গুলি করে সোনাগাজীতে জমশেদুল ইসলাম ও শহিদ নামে দুই যুবদল কর্মীকে হত্যা করে পুলিশ।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে খুন

২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি সদর উপজেলার ফাজিলপুর ইউনিয়ন যুবদলের সিনিয়র সহসভাপতি গোলাম সরওয়ারকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তার বুকে গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় পুলিশ মামলা দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদেরই আসামি করে। একইভাবে ২০১৩ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে সোনাগাজীর চরচান্দিয়া ইউনিয়ন যুবদলের সদস্য মাহফুজুল হককে হত্যা করা হয়।

একই বছর সোনাগাজী যুবদলের আবদুর রহমান সন্দীপি মানিককে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে স্থানীয় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা তুলে নিয়ে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। ২০১৮ সালে সোনাগাজী উপজেলার চরদরবেশ ইউনিয়ন যুবদলের সহসভাপতি ভাগিনা কালামকে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়। এছাড়া ২০১০ সালে সোনাগাজীর চরচান্দিয়া ইউনিয়ন যুবদলকর্মী আবুল কালামকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৯ সালে রাতের আঁধারে র‌্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয় সোনাগাজীর চরচান্দিয়া যুবদলের মোহাম্মদ মাসুদকে।

খোঁজ মেলেনি যুবদল নেতা রিপনের

২০১৪ সালের ২০ মার্চ রাতে স্ত্রী-কন্যাদের সঙ্গে পাঠানবাড়ি এলাকার বাসায় ঘুমিয়ে ছিলেন ফেনী শহর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহবুবুর রহমান রিপন। মধ্যরাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তার মা রৌশন আরা, স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান স্থানীয় র‌্যাব ক্যাম্পসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন দপ্তরে ধরনা দিয়েও তার হদিস পাননি। এক পর্যায়ে সংবাদ সম্মেলন করেও সন্ধান চাওয়া হয়। তবে মামলা করতে গেলে গ্রহণ করেনি ফেনী মডেল থানা পুলিশ।

সন্তানের স্মৃতি নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি প্রায় শুকিয়ে ফেলেছেন নিখোঁজ নেতার মা রৌশন আরা। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ছেলে নিখোঁজ হওয়ার ১০ বছর পেরিয়ে গেছে। এখনো প্রতীক্ষায় আছি। বুকের ধন রিপন ফিরে আসবে আমার কোলে, ‘মা’ বলে জড়িয়ে ধরবেÑএই স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছি। এছাড়া বাবার জন্য প্রতি রাতে অপেক্ষায় থাকে তার মেয়ে নিশাত ও ফারিয়া।

আরো যাদের হত্যা করা হয়

জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আলাল উদ্দিন আলাল আমার দেশকে জানান, হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনে ফেনীতে বিএনপি, যুবদল ও সহযোগী সংগঠনের অন্তত ৪০ নেতাকর্মী আওয়ামী সন্ত্রাসী এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে আরো আছেনÑসোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের আবুল কাশেম, উত্তর চরমজলিসপুরের সফিকুর রহমান, মতিগঞ্জের রফিকুল ইসলাম, রহিম উল্যাহ, সদর ইউনিয়নের ইকবাল হোসেন ও আমিরাবাদের আবদুল হাই।

নিহতের তালিকায় যুক্ত হয়েছেন ফেনী সদর উপজেলার শর্শদী ইউনিয়নের মফিজুর রহমান ও মো. রিপন, কালিদহ ইউনিয়নের নুরুল আলম সোহাগ, ফরহাদনগর ইউনিয়নের যুবদল নেতা নজরুল ইসলাম, ধলিয়া ইউনিয়নের আবুল কাশেম, দেলোয়ার হোসেন, বালিগাঁও ইউনিয়নের সাইফুদ্দিন মানিক, হাবিব উল্যাহ, বাচ্চু মিয়া, ফাজিলপুর ইউনিয়নের সাইফুল ইসলাম, পৌর এলাকার সুলতানপুরের যুবদল নেতা সাইফুল ইসলাম প্রমুখ।

দাগনভূঞা পৌর এলাকার খুরশিদ আলম, মিয়াধন, সিন্দুরপুর ইউনিয়নের মো. ইস্রাফিল, রাজাপুর ইউনিয়নের মো. সিফন, রামনগর ইউনিয়নের শেখ আহমদ, ফুলগাজী উপজেলার দরবারপুর ইউনিয়নের আবুল কাশেম, ছাগলনাইয়া উপজেলার ঘোপাল ইউনিয়নের সাহিনুর রহমান সুমন, পাঠাননগর ইউনিয়ন যুবদলের সহসভাপতি আলমগীর হোসেন ভূইয়া সাইফুল ইসলাম ও সাংগঠনিক সম্পাদক সৌরভ হোসেন। তবে ২০২১ সালের ১৬ অক্টোবর ফেনী সদর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সুশেন চন্দ্র শীলের নেতৃত্বে ফেনী বড় জামে মসজিদে হামলা চালিয়ে এমদাদুল হক কাউসারকে হত্যার ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, শুধু ২০১২ সালেই ফেনীতে অর্ধশতাধিক অজ্ঞাত পরিচয়ের লাশ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া জেলার ছয় থানায় বিভিন্ন ঘটনায় এক হাজার ৬৭৪টি মামলা হয়।

খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা

২০১৭ সালের ২৮ অক্টোবর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শরণার্থীদের মাঝে ত্রাণ বিতরণের জন্য যাওয়ার পথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনীর ফতেহপুর স্টারলাইন পাম্পের সামনে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০টি গাড়ি ভাঙচুর করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। এতে বিএনপির ৪০ নেতাকর্মী আহত হন। এছাড়া ২০২৩ সালে দাগনভূঞায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুর গাড়িবহরে হামলা চালায় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। ওই সময় তার বহরে থাকা বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী আহত এবং একাধিক গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ বিষয়ে কোনো মামলা নেয়নি পুলিশ।

তারেক রহমানের নামেও মামলা

২০১৪ সালে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে নিয়ে মন্তব্য করায় ২৩ ডিসেম্বর ফেনীর আদালতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। শেখ হাসিনার এক হাজার কোটি টাকার মানহানি হয়েছে দাবি করে মামলাটি করেন ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক গাজী তারেক আজিজ।

সংখ্যালঘু ও সাংবাদিক নির্যাতন

২০১৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর সোনাগাজীতে আওয়ামী লীগের হামলায় ধানের শীষের প্রার্থী আকবর হোসেনসহ অন্তত ২০ জন আহত হন। এরপর বিএনপি-জামায়াতকে ফাঁসাতে ওই উপজেলার আলামপুরে সংখ্যালঘুদের চারটি বসতঘরে অগ্নিসংযোগে পুড়িয়ে দেয় আওয়ামী ক্যাডাররা।

২০১৯ সালে বর্বরোচিত নুসরাত হত্যা রহস্য উদঘাটনে সক্রিয় ভূমিকা রাখাসহ পুলিশের দানবীয় ভূমিকা নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর তৎকালীন এসপি জাহাঙ্গীর আলম নিজের আক্রোশ মেটাতে ফেনীর চার সাংবাদিককে প্রায় দুই ডজন গায়েবি মামলায় জড়ান। তাদের একজনকে গভীর রাতে বাসা থেকে তুলে নিয়ে পরদিন কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে হাজির করা হয়।

এছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা ফারুককে নিজাম হাজারীর ‘ডামি প্রার্থী’ লেখায় দৈনিক ফেনীর সময় সম্পাদকের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর আদালতে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। একই বছর সোনাগাজী উপজেলার উত্তর চরচান্দিয়ায় বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব এম আবদুল্লাহ ও তার বোন-ভাগনি, আত্মীয়-স্বজনসহ অন্তত ২০ জনকে বিনা কারণে আটক করে পুলিশ। পরে পারিবারিক লাইব্রেরিতে থাকা কিছু ইসলামি বই জব্দ দেখিয়ে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়।

এমনকি ২০১৫ সালে তুচ্ছ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিজাম হাজারীর নির্দেশে ফেনী প্রেস ক্লাব সিলগালা করে দেয় ফ্যাসিস্ট হাসিনার প্রশাসন। দীর্ঘ প্রায় সাত বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালের শেষদিকে জেলায় কর্মরত সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে তালা ভেঙে ফেনী প্রেস ক্লাব রাহুমুক্ত করেন।

জুলাই আন্দোলনে ১২ খুন

গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ১২ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০ জনের নাম গণঅভ্যুত্থানে ফেনীর শহীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তারা হলেনÑফুলগাজীর ইশতিয়াক আহম্মেদ শ্রাবণ, দাগনভূঞার সারওয়ার জাহান মাসুদ, আবু বকর সিদ্দিক শিবলু, সাইফুল ইসলাম আরিফ, সোনাগাজীর মাহবুবুল হাসান, জাকির হোসেন শাকিব, আবদুল গণি বোরহান, সদর উপজেলার সাইদুল ইসলাম, ওয়াকিল আহম্মেদ শিহাব ও পরশুরামের ইকরাম হোসেন কাওছার।

অপর দুজনের মধ্যে একজন মোহাম্মদ সবুজ। তিনি লক্ষ্মীপুরের রামগতির বাসিন্দা হওয়ায় তার নাম ওই জেলার শহীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে সাতজন জেলার মহিপালে ছাত্র-জনতার অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে আওয়ামী সন্ত্রাসী ও পুলিশের নির্বিচার গুলিতে এবং তিনজন রাজধানীতে এবং একজন বন্দরনগরী চট্টগ্রামে জুলাই আন্দোলন চলাকালে শহীদ হন। অপরজন জেলার সদর উপজেলার শর্শদী ইউনিয়নের টমটমচালক জাফর আহম্মেদ। তিনিও ৪ আগস্ট দুপুরের পর ফেনী পৌরসভা সংলগ্ন সড়কে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হাতে শহীদ হন। এ ১২ জনের মধ্যে আট শহীদকেই নিজেদের দলীয় লোক দাবি করছে জামায়াত। অন্যদিকে টমটমচালক জাফর আহম্মেদসহ ছয়জনকে নিজদের দলীয় কর্মী দাবি করছে বিএনপি।

এদিকে জুলাই ঘটনায় ফেনীতে সাত হত্যাসহ মোট ২২ মামলা দায়ের করা হয়েছে।

ফেনীর পিপি অ্যাডভোকেট মেজবাহ উদ্দিন খান আমার দেশকে জানান, ওই সময় আট শতাধিক গায়েবি ও রাজনৈতিক মামলায় বিএনপি-জামায়াতের প্রায় ৩০ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। যার অধিকাংশই ভিত্তিহীন এবং বাদী পুলিশ কিংবা আওয়ামী লীগের লোকজন। এর মধ্যে কিছু মামলা বিচারক আদালতে নিষ্পত্তি করেন এবং কিছু মামলা খারিজ হয়ে গেছে। বাকি ৫১৩ মামলা প্রত্যাহারের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ২২০টি প্রত্যাহারের চিঠি এসেছে। তার মধ্যে ১০০টি প্রত্যাহার করা হয়েছে।

পিপি আরো বলেন, তিনি নিজেও ২০২৩ সালের ১৮ জানুয়ারি ফেনী শহরের ট্রাংক রোডে বিএনপির কেন্দ্রঘোষিত বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিয়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হন। ওই সময় পায়ে দুটি গুলি বিদ্ধ হয়ে তিনিসহ বিএনপির বহু নেতাকর্মী আহত হন। অথচ ওই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে উল্টো দুটি মামলা দায়ের করে তাকেসহ বিএনপির প্রায় সাড়ে চার হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করে।

পুলিশ সুপার কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১১ বছরে ফেনীতে ৪০৪টি খুনের মামলা ও ১০৮টি বিস্ফোরক মামলার পরিসংখ্যান মিলেছে।

জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক গাজী হাবিব উল্যাহ মানিক আমার দেশকে বলেন, শতাধিক মামলায় তিনি নিজেও ১১ বার গ্রেপ্তার ও সাড়ে তিন বছর কারাগারে ছিলেন। এছাড়া বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে না পেয়ে ছোট ভাই গাজী আতাউরকে গ্রেপ্তার, ব্যবস্যাপ্রতিষ্ঠানে তাকে না পেয়ে হামলা, ভাঙচুর ও তালা ঝুলিয়ে ম্যানেজারকে ধরে নিয়ে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়।

জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আলাল উদ্দিন আলাল আমার দেশকে বলেন, ‘পুলিশের পাঁচ শতাধিক মামলায় তাদের অন্তত ২০ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। ২০১৪ সালে আলাউদ্দিন নাসিমের হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে স্টারলাইনের আলাউদ্দিন জাপা থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার পর থেকেই মূলত আমাদের ওপর নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে।’

জেলা জামায়াতের সাবেক আমির সামছুদ্দিন আমার দেশকে বলেন, হাসিনার দুঃশাসনামলে তিনি ডজনখানেক মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে অন্তত ২৪০ দিন কারাগারে ছিলেন। তার বড় ছেলে হামীমকেও যৌথবাহিনী পরিচয়ে তুলে নিয়ে দীর্ঘদিন গুম করে রেখে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। এছাড়া জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীর নামে পুলিশ ও আওয়ামী ফ্যাসিস্টরা প্রায় ৩০০টি মামলা করে। এসব মামলায় অন্তত ১০ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়।

জেলা জামায়াতের আমির মুফতি আবদুল হান্নান আমার দেশকে বলেন, শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনে ফেনীতে ব্যাপক নিপীড়ন চলে। জুলাইয়ের আট শহীদসহ জামায়াতের অন্তত ১০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশ তো দূরের কথা, বাড়িতেই থাকতে দিত না। যখন যাকে হুমকি মনে করেছে, পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করেছে। এছাড়া তিন সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে আহত ও অন্তত তিনজনকে পঙ্গু করা হয়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন বলেন, ওই সময় বিরোধী মত দমনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সমানতালে কাজ করেছে। আন্দোলন দমাতে তখন প্রতিনিয়ত হত্যা, গুম-খুন, হামলা-মামলাসহ বিরোধীদের ওপর সব ধরনের নির্যাতন চালানো হতো। আবার এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের নামে উল্টো মিথ্যে মামলা দিয়ে আসামি করা হতো। সব মিলিয়ে শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছর আতঙ্কের জনপদ ছিল ফেনী।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত