চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে ফল জালিয়াতি

প্রোগ্রামারের স্বীকারোক্তিতে ফেঁসে যাচ্ছেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক

ওচমান জাহাঙ্গীর, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৫, ১২: ৫০

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে ভয়াবহ ফল জালিয়াতির ঘটনা তদন্তে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বীকারোক্তিতে ফেঁসে যাচ্ছেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর ড. পারভেজ সাজ্জাদ চৌধুরী ও মাধ্যমিক শাখার উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আব্দুল মান্নান। তাদের নেতৃত্বেই বোর্ডে চলে একটি জালিয়াতচক্র। যারা মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে ফল জালিয়াতি, নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া, রেজিস্ট্রেশন ও রোল নম্বর পরিবর্তন থেকে শুরু করে সব ধরনের জালিয়াতি করেন। সম্প্রতি তারা বোর্ড গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির জালে ধরা পড়েছেন। আর এতেই শাস্তির মুখে পড়তে যাচ্ছেন এ দুই কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, তদন্ত কমিটি শিগগির প্রতিবেদন জমা দেবে বোর্ড কর্তৃপক্ষকে। সে অনুযায়ী শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। পরে নির্দেশনা অনুসারে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সাবেক সচিব নারায়ণ চন্দ্র নাথ তার ছেলে নক্ষত্র দেবনাথের ফল জালিয়াতির ঘটনায় ধরা পড়ে বর্তমানে কারাগারে আছেন। তিনি চাকরিও হারিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বোর্ডে ফলসহ বিভিন্ন জালিয়াতির জন্য একটি চক্র সক্রিয়। এই চক্রে রয়েছেন কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী। এছাড়াও বাইরে বেশকিছু দালাল নিয়োগ করা আছে, যারা কন্ট্রাক্টে এসব কাজ এনে দিত চক্রকে। আর মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে কাজ সেরে ফেলতেন তারা। সবশেষ ২০২৪ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী সাদিয়ার রোল ও রেজিস্ট্রেশন জালিয়াতির পর ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী পিয়াল আশরাফ শান্ত নামে এক ছাত্রের ফল জালিয়াতি করা হয়। মূলত পিয়ালের রেজিস্ট্রেশনে সাদিয়ার রেজিস্ট্রেশন, নাম ও ব্যক্তিগত তথ্য ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। পরে সাদিয়ার ফল পিয়ালের নামে করতে তার নামটি সংশোধন করে দেওয়া হয়।

চলতি বছরের ৩ সেপ্টেম্বর নাঈম চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি অভিযোগ করলে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। এতে বলা হয়, খাগড়াছড়ির শহীদ লে. মুশফিক উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী সাদিয়া জাহান লাভলীর নাম পরিবর্তন করে পিয়াল আশরাফ শান্ত নামে ফল প্রকাশ করা হয়েছে এবং এর বিনিময়ে ১০ লাখ টাকা ঘুস লেনদেন হয়। অভিযোগে বলা হয়, সাদিয়ার রেজিস্ট্রেশন নম্বর ও ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে পিয়ালের নামে ফল তৈরি করা হয়েছে, যা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের সহায়তা ছাড়া সম্ভব নয়।

জানা যায়, এরপর এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও সময়ক্ষেপণ করা হলেও কোনো প্রতিবেদন দেয়নি ওই কমিটি। পরে তিন সদস্যের আরো একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির তদন্তেই বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর এই তথ্য।

বোর্ডের একটি সূত্র জানায়, প্রোগ্রামার মো. আব্দুল মালেকসহ দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করা কম্পিউটার শাখার অন্তত সাতজন অপারেটর ইতোমধ্যে চেয়ারম্যান বরাবর স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। এমনকি তারা তদন্ত কমিটির কাছেও জানিয়েছেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তাদের এ কাজে বাধ্য করেছেন। এ-সংক্রান্ত একাধিক কপি আমার দেশ-এর হাতে এসেছে।

বোর্ডের কম্পিউটার শাখার প্রোগ্রামার মো. আব্দুল মালেক চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছেন, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (মাধ্যমিক) তাকে নিয়মবহির্ভূতভাবে তথ্য পরিবর্তনের নির্দেশ দেন।

মালেক লিখেছেন, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আমাকে সংশোধনের জন্য বললে আমি নাম সংশোধনের বিষয়টি মিটিংয়ে পাস করিয়ে আনার কথা বলি। কদিন পর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (মাধ্যমিক) আমাকে এসে বলেন, এটি কম্পিউটার শাখার ভুল; এটি ঠিক করে দিতে হবে। এর জন্য কোনো অর্ডার লাগবে না। তারা বসে থেকে আমাকে দিয়ে ওই সংশোধন করে নিয়ে যান। এর মাধ্যমে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নিজেই অনিয়ম ঢাকতে কম্পিউটার শাখাকে ব্যবহার করেছেন বলে প্রমাণ পেয়েছে বোর্ড, যা ইতোমধ্যে শিক্ষা বোর্ড নথিতে সংরক্ষণ করেছে।

বোর্ডের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এক সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করবে।

জানা যায়, ২০২৪ সালে পিয়াল আশরাফ শান্ত এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। তখন তার প্রবেশপত্রে মেয়ের ছবি ছাপা হয়। ২০২৫ সালে কেবল গণিতে পুনঃপরীক্ষা দেওয়ার সময় প্রবেশপত্রে ছেলের ছবি থাকলেও নাম, পিতা-মাতা ও জন্মতারিখ সাদিয়া জাহানের ছিল। ওই অবস্থায় মেয়ে হিসেবেই পরীক্ষা দিয়ে দেন পিয়াল আশরাফ শান্ত।

শহীদ মুশফিক স্কুলের প্রধান শিক্ষিক কামরুন নাহার বলেন, ছবিতে ভুল হওয়ায় বোর্ডে জানিয়েছিলাম, পরে শুনি কম্পিউটার সার্ভারে নাম, রোল-রেজিস্ট্রেশনও পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমার কাছে পরীক্ষার কেন্দ্র সচিব বাবুল হোসাইন স্বীকার করেছেন, নাম ও উপস্থিতির অমিল বুঝতে পারেননি, বিষয়টি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে জানানো উচিত ছিল।

অন্যদিকে যার নাম ব্যবহার করে এসব জালিয়াতি, সেই শিক্ষার্থী সাদিয়া জাহান লাভলী বলেন, আমি ২০২৪ সালে পাস করে কলেজে অধ্যয়নরত। আমার ছবি অন্যের প্রবেশপত্রে গেল কীভাবে বুঝতে পারছি না।

বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইলিয়াছ উদ্দিন আহাম্মদ জানান, আমি এই অভিযোগের পর বিদ্যালয় পরিদর্শক অধ্যাপক আবুল কাশেমকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করি। তবে প্রাথমিক তদন্তে অসংগতি ধরা পড়লেও প্রথম রিপোর্টে অস্পষ্টতা ছিল। তাই অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দিয়ে আরেকটি কমিটি করে দিয়েছি। প্রকৃত অপরাধীদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

এ ঘটনায় শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, এটি কোনো একক ভুল নয়, বরং বোর্ডের দীর্ঘদিনের জালিয়াতির ধারাবাহিকতা। চলতি বছর পুনঃনিরীক্ষায় ১৯ শিক্ষার্থীর ৩৪টি খাতায় নম্বর বাড়ানোর প্রমাণ মিলেছে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত