ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জয়পুরহাটের দুটি আসনে জমে উঠেছে নির্বাচনি পরিবেশ। দীর্ঘদিন সুষ্ঠু ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ায় সাধারণ ভোটারদের মধ্যে তৈরি হয়েছে নতুন প্রত্যাশা।
বিশেষ করে যুবসমাজের বড় একটি অংশ বহু বছর ভোট দিতে না পারায় এবারের নির্বাচনের প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়ছে। এদিকে প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তি—বিএনপি ও জামায়াত উভয়ই নির্বাচনি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ না থাকায় এবার নির্বাচনে বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াত। উভয় আসনে জামায়াত একক প্রার্থী দিয়ে নির্ভার থাকলেও বিএনপিতে মনোনয়ন নিয়ে বড় ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে। দলের দুই আসনে প্রার্থী ঘোষণার পর থেকে মনোনয়ন বঞ্চিতরা তা বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ করছেন। এছাড়া জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) দুই আসনেই তাদের প্রার্থী দিয়েছে।
জয়পুরহাট-১ (সদর-পাঁচবিবি)
গত ৩ নভেম্বর জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুদ রানা প্রধানকে এই আসনে আনুষ্ঠানিকভাবে মনোনয়ন দেয় দল। এরপর থেকেই মনোনয়নবঞ্চিত অপর দুই প্রার্থী-দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ফয়সল আলিম এবং পাঁচবিবির সাবেক সভাপতি আব্দুল গফুর মণ্ডল বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছেন। তাদের অনুসারীরা পৃথকভাবে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে বিক্ষোভ, শোডাউন ও গণমিছিল করছেন। এর অংশ হিসেবে গত ১৪ ও ১৯ নভেম্বর ফয়সল আলিমের অনুসারীরা শহরজুড়ে শোডাউন ও গণমিছিল করেন। ওই গণমিছিলে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রব বুলু বলেন, আমরা এমন একজনকে চাই যাকে ভোটাররা গ্রহণ করবে। ভুল মনোনয়ন দিলে এই ঘাঁটি ঝুঁকির মুখে পড়বে। অন্যদিকে গফুর মণ্ডলের অনুসারীরা তাকে প্রার্থী করার দাবিতে পাঁচবিবিতে গণমিছিল করেন। বঞ্চিত প্রার্থীদের অনুসারীদের বিশ্বাস—শেষ মুহূর্তে পরিবর্তন আসতে পারে। তবে মাসুদ রানা প্রধানের সমর্থকরা এটাকে মরীচিকা বলছেন। এমন অবস্থায় বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন—অভ্যন্তরীণ বিভাজন বিএনপির জন্য বিপজ্জনক ফল বয়ে অনতে পারে এই আসনে।
মনোনয়ন বঞ্চিত ফয়সল আলিম বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দল চূড়ান্তভাবে আমাকেই মনোনয়ন দেবে। মানুষ ধানের শীষের পক্ষে ক্লিন ইমেজের প্রার্থী চায়। আমি মনে করি দল সে বিষয়টি বিবেচনা করবে এবং সবশেষে আমাকেই মনোনীত করবে। মনোনয়ন না দিলেও দল ছেড়ে যাব না। মৃত্যু পর্যন্ত ধানের শীষের পক্ষেই থাকব। আমার অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হবে না।
অন্যদিকে এই আসনে জামায়াত একক প্রার্থী হিসেবে প্রায় আট মাস আগে জেলা আমির ফজলুর রহমান সাঈদকে মনোনীত করেছে। মাঠপর্যায়ে সুসংগঠিতভাবে কাজ করায় তাদের অবস্থান দিন দিন শক্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সাধারণ ভোটাররা । তারা দাবি করছেন—৫ আগস্টের পর জামায়াতের সামাজিক কার্যক্রম ভোটারদের আস্থা বাড়িয়েছে।
জামায়াত নেতা ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল বাতেন বলেন, ক্ষমতা পেলে এলাকায় দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও মাদক নির্মূল করা হবে। ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করে ন্যায়ভিত্তিক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠাই আমাদের লক্ষ্য। তিনি আরো জানান, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতায় মানুষ বিকল্প খুঁজছে, আর সেই সুযোগটাই নিতে চায় জামায়াত। এছাড়া এ আসনে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গোলাম কিবরিয়াকে মনোনয়ন দিয়েছে। এই আসনে মোট ভোটার প্রায় সাড়ে চার লাখ।
জয়পুরহাট-২ (কালাই-ক্ষেতলাল-আক্কেলপুর)
অন্যদিকে আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জয়পুরহাট-২ (কালাই–ক্ষেতলাল–আক্কেলপুর) আসনেও বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। প্রায় অর্ধডজন মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকায় তৃণমূলের বিভাজন এখন স্পষ্ট। এই আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেনÑসাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোস্তফা, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ওবায়দুর রহমান চন্দন, সাবেক সচিব আব্দুল বারী, কৃষকদলের কেন্দ্রীয় নেতা লায়ন সিরাজুল ইসলাম বিদ্যুৎসহ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা।
জানা যায়, ১৯৯১ ও ২০০৮ সালে এই আসনটি বিএনপির দখলে ছিল। দীর্ঘ দেড় যুগের রাজনৈতিক দমন-পীড়নের পর আসনটি পুনরুদ্ধারে তৎপর হয় বিএনপি। এরই প্রেক্ষিতে গত তিন নভেম্বর সাবেক সচিব আব্দুল বারীকে মনোনয়ন দেয় দল। এরপর থেকেই মনোনয়নবঞ্চিতরা তা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছেন। ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোস্তফার অনুসারীরা অভিযোগ করেন—রাজপথে কঠিন সময়ে যারা দলকে আগলে রেখেছেন, মামলা-হামলা মোকাবিলা করেছেন, তাদের মূল্যায়ন করা হয়নি। এরপর থেকেই মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে এলাকায় বিক্ষোভ ও অবরোধের মতো কর্মসূচি পালন করে তারা। গত ২৩ নভেম্বর কালাই বাসস্ট্যান্ডে এলাকায় বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করে মোস্তফাপন্থিরা।
তবে মাঠপর্যায়ে মনোনয়নপ্রাপ্ত আব্দুল বারীর পক্ষে দলীয় বেশিরভাগ নেতা, যেমন জেলা বিএনপি, উপজেলা ও পৌর ইউনিটের দায়িত্বশীলরা নিয়মিত গণসংযোগ করছেন তার পক্ষে। অন্যদিকে উপজেলা বিএনপি পাল্টা শক্তি প্রদর্শন করে কালাইয়ে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল করেন। জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলজার হোসেন সেখানে ঘোষণা দেন—বারী স্যার ও রানা প্রধানের মনোনয়ন পরিবর্তন হবে না। বিভেদ ভুলে
ঐক্যবদ্ধভাবে ধানের শীষের পক্ষে কাজ করুন।
এ ব্যাপারে সাবেক সচিব আব্দুল বারী বলেন, হাইকমান্ডের নির্দেশ ছিল যাকেই মনোনয়ন দেওয়া হোক, ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। বিক্ষোভে বিএনপির কোনো পদধারী নেই। কয়েকজন দলছুট ও ভাড়াটিয়া নেতা পরিস্থিতি ঘোলাটে করছেন। মানুষ এসব পছন্দ করছে না। রাস্তায় বিক্ষোভ করে মনোনয়ন বদলায় না।
অন্যদিকে এ আসনে প্রায় সাত মাস আগে জামায়াত এস এম রাশেদুল আলম সবুজকে একক প্রার্থী ঘোষণা করে। এরপর থেকেই তারা গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। মাঠপর্যায়ে তাদের প্রস্তুতি সুসংগঠিত ও পরিকল্পিত বলে ভোটারদের মধ্যে আলোচনা রয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি কালাই ও ক্ষেতলাল এলাকার কয়েকশ বিএনপি কর্মী জামায়াতে যোগ দিয়েছেন। যোগদানকারীরা বলেন—দলে বিভাজন, বিশৃঙ্খলা, চাঁদাবাজির অভিযোগের কারণে তারা বিএনপি থেকে সরে এসেছেন।
দীর্ঘদিন বিএনপির রাজনীতি করা মোস্তাফিজুর রহমান দুলু বলেন, অনেক ভেবে দেখি জামায়াতের নেতাকর্মীদের আচরণ ভালো। কোনো চাঁদাবাজি নেই, বিভাজন নেই। তাই যোগ দিয়েছি। এই আসনে আব্দুল ওহাব দেওয়ান কাজলকে মনোনয়ন দিয়েছে এনসিপি।
তবে এই আসনে ভোটারদের অনেকে এখনো ঠিক করতে পারেনি তারা কাকে ভোট দেবে। এছাড়া বিএনপির বিপরীতে ইসলামী ধারার আট দল একক প্রার্থী দিলে ভোটে তার প্রভাব থাকবে। সব মিলিয়ে এই আসনে ভোটের হিসাব কোনদিকে যাবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। এই আসনের মোট ভোটার প্রায় তিন লাখ।

