বগুড়ায় তিন বছর ধরে কঙ্গোর নাগরিক ভিটো বলি বোঙ্গেঙ্গে জিম্মি হয়ে আছেন—এমন খবর সম্প্রতি গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে প্রশাসনের নড়েচড়ে বসে। তবে তদন্তে বেরিয়ে আসছে ভিন্ন চিত্র। পুলিশ ও স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, জিম্মি নয়, বরং ভিসা জটিলতা এবং পাখি ব্যবসা সংক্রান্ত আর্থিক লেনদেনের কারণেই তিনি বগুড়ায় আটকে আছেন।
বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসান বাসির জানান, জিম্মি করে রাখার অভিযোগটি সত্য নয়। মূলত ভিসা জটিলতা ও আর্থিক লেনদেনের কারণে কঙ্গো নাগরিক ভিটো আটকে আছেন।
ভিটো যে বাড়িতে অবস্থান করছেন, সেই বাড়ির প্রতিবেশী এবং তাকে নিয়মিত খাবার সরবরাহকারীরাও একই কথা জানিয়েছেন। তারা জানান, তিনি স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করছেন এবং স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
স্থানীয় দোকানি ও অটোরিকশা চালক আবু সাইদ জানান, ভিটো বলি এলাকায় বেশ পরিচিত। এলাকার সবাই জানেন, তিনি পলাশের কাছে ব্যবসায়িক কাজে এসেছেন। তিনি নিয়মিত ভিটোকে দেখেন এবং তার রিকশায় ভিটোকে গোকুল মেধ, মহাস্থান গড়, মমইন ও শহরে ঘুরে বেড়াতেও দেখেছেন। কখনও মনে হয়নি ভিটো জিম্মি আছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, সদর উপজেলার গোকুল পশ্চিমপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আতিকুর রহমান পলাশ ‘মায়ের দোয়া’ নামে একটি পাখি আমদানিকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা করেন। ভিটো বলি কঙ্গো থেকে পাখি রপ্তানি করেন, সেই সূত্রেই তাদের পরিচয়। কঙ্গোর এভিগামার কিউ-ইলোসুড কালামু কিনসাশা গ্রামের বাসিন্দা ভিটো।
পলাশের দাবি, ভিটো ২০২২ সালের নভেম্বরে এক মাসের টুরিস্ট ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তিনি কঙ্গো থেকে পাখি আমদানির চুক্তি করেন। চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে ভিটো বলি তাদের প্রতিষ্ঠানকে বারবার ঠকিয়েছেন।
প্রথমবার ১০ হাজার ডলারের বিনিময়ে ২০০ বিদেশি পাখি পাঠানোর কথা থাকলেও পাঠিয়েছেন মাত্র ৬০টি জার্ডিন প্যারোট ও ১৫টি গ্রেড বুল টরাকো।
২০২৩ সালের জুনে আরও ২০০ পাখির জন্য ১৫ হাজার ডলার পাঠানো হলেও পাঠিয়েছেন মাত্র ৯০টি পাখি।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে নতুন করে ২০০ পাখির জন্য আরও ১২ হাজার ডলার পাঠানো হলেও একটি পাখিও আমদানি করেননি।
পলাশের স্ত্রী জান্নাতি আক্তার বলেন, ভিটোকে জিম্মি করা দূরের কথা, বরং তাকে আলাদা পাকা বাড়িতে থাকতে দেওয়ার পাশাপাশি তার বিলাসিতাপূর্ণ জীবনের খরচ বহন করতে গিয়ে তারা হিমশিম খাচ্ছেন।
তিনি অভিযোগ করেন, ভিটো সাধারণ মানের খাবার খান না। তার জন্য তিন বেলা গরুর মাংস, দামি মুরগি, মাছের পাশাপাশি দৈনিক ৮ থেকে ১০টি ডিম ও প্রায় দুই লিটার দুধ রান্না করতে হয়। নিয়মিত হাটবাজার, দর্শনীয় স্থান যেমন—গোকুল মেধ, মহাস্থান গড়, মমইন ঘুরে বেড়ান এবং প্রচুর কেনাকাটা করেন, যার সব খরচ পলাশকেই বহন করতে হয়।
পলাশের চাচাতো ভাই শফিক আহমেদ জানান, ভিটো দুই বছরের বেশি সময় ধরে তাদের সঙ্গেই চলাফেরা ও খাওয়া-দাওয়া করছেন। মাঝে মাঝে নিজেই রান্না করেন এবং বাজার থেকে মুরগি কেনেন। তাকে কখনও বন্দি অবস্থায় রাখা হয়নি।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর বগুড়া সদর থানায় ভিটো বলি লিখিত অভিযোগ করলে ঘটনাটি ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। অভিযোগে ভিটো দাবি করেন, পলাশ তার পাসপোর্টসহ কাগজপত্র আটকে রেখে তাকে জিম্মি করে রেখেছেন। তবে স্থানীয় ও পুলিশের তদন্তে এই দাবি ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হয়।
কঙ্গো নাগরিকের জিম্মির বিষয়টি ভুয়া দাবি করে বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) হুসেইন মোহাম্মদ রায়হান জানান, পাখি ব্যবসায়ী ভিটো বলির ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় তিনি এখন অবৈধ অভিবাসী। ব্যবসায়ী পলাশের সঙ্গে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব থেকেই এসব ঘটনা ঘটছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরও জানান, পুলিশ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। ভিটোকে সেফহোমে নেওয়ার পর রাষ্ট্রীয়ভাবে নিজ দেশ কঙ্গোতে ফেরত পাঠানো হবে।
তবে সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র)-এর সম্পাদক কেজিএম ফারুক মন্তব্য করেন, দেশের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে ভিটোকে পুলিশের জিম্মায় নিয়ে চিকিৎসা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।

