তফসিল ঘোষণার পর সারা দেশের মতো রাজশাহীতেও বাড়ছে নির্বাচনি উত্তাপ। জেলার ৯ উপজেলা নিয়ে গঠিত ছয়টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীরা নির্বাচনের মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। এর মধ্যে চারটি আসনে বিএনপির মনোনয়নবঞ্চিতদের তীব্র প্রতিবাদ-বিক্ষোভে উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বিপরীতে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতে ইসলামী ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নেমে ধারাবাহিক গণসংযোগ চালাচ্ছে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাসদ, গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ একাধিক দলও সক্রিয় রয়েছে। নতুন করে ছয়টি আসনে প্রার্থী দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। ফলে পুরো জেলায় তৈরি হয়েছে নির্বাচনি উৎসবের আবহ।
স্থানীয় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এবারের নির্বাচনে রাজশাহীর ছয় আসনেই বিএনপি ও জামায়াত ‘অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই’য়ে নেমেছে। ভোটারদের মধ্যেও তৈরি হয়েছে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রত্যাশা।
রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর)
বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন তিনবারের এমপি ও সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হকের ভাই, দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) শরীফ উদ্দিন। তবুও শরীফ উদ্দিনকে ‘চাই না’ আন্দোলনে মাঠে নেমেছেন মনোনয়নপ্রত্যাশী সুলতানুল ইসলাম তারেকের অনুসারীরা। এ দাবিতে বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধÑসবই চলছে। তাদের আশা, শেষ পর্যন্ত এখানে প্রার্থী বদল করা হবে।
এ আসনে একক প্রার্থী নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে প্রচার চালাচ্ছে জামায়াত। দলের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির অধ্যাপক মজিবুর রহমান এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।তিনি ১৯৮৬ সালে একবার এ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবারো তিনি জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। এ ছাড়া গণঅধিকার পরিষদের মীর মো. শাহজাহান, এবি পার্টির আব্দুর রহমান মুহসেনী, বাসদের আফজাল হোসেন ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আরিফুল ইসলাম এই আসনে দলের মনোনীত প্রার্থী। এনসিপির মহানগর সদস্য সচিব আতিকুর রহমানও এই আসনে প্রার্থী হতে পারেন।
রাজশাহী-২ (সদর)
রাজশাহীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই আসনকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক উত্তাপ। এলাকাটি বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত। স্বাধীনতার পর বেশ কয়েকবার দলটির প্রার্থীরা এ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। এ আসনে বিএনপির একটি অংশ দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে প্রার্থী হিসেবে চেয়েছিল। তবে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনুকে মনোনয়ন ঘোষণার পর এ আসনে আপাতত বিএনপির কোনো অনৈক্য নেই। গত ২০ নভেম্বর হযরত শাহ মখদুম (র.)-এর মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে মিনু আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচার শুরু করেন।
এখানে জামায়াতের মহানগর শাখার নায়েবে আমির ডা. জাহাঙ্গীরকে প্রার্থী করা হয়েছে। তিনি নেতাকর্মীদের নিয়ে থানা, ওয়ার্ড ও মহল্লা পর্যায়ে নিয়মিত গণসংযোগ করছেন। এছাড়া গণসংহতি আন্দোলনের জেলা সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট মুরাদ মোর্শেদ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ফায়সাল হোসেন মনি, খেলাফত মজলিসের মোহাম্মাদ উল্লাহ শাহীন, বাসদের জেলা সদস্য সচিব সামছুল আবেদীন প্রার্থী হয়েছেন।
রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর)
আসনটির সীমানা মহানগরীর চারপাশে হওয়ায় সব দলের কাছেই এটি ভিন্ন গুরুত্ব পাচ্ছে। এখানে বিএনপি ও জামায়াত উভয় দলের আধিপত্য চোখে পড়ার মতো। এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন কেন্দ্রীয় কমিটির ত্রাণ ও পুনর্বাসনবিষয়ক সহসম্পাদক এবং রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শফিকুল হক মিলন। তবে তাকে ‘বহিরাগত’ উল্লেখ করে প্রার্থী বদলের দাবিতে মাঠে আছেন দুই মনোনয়নপ্রত্যাশী রায়হানুল আলম রায়হান ও নাসির হোসেনের অনুসারীরা। অন্যদিকে জামায়াতের একক প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ ইউনিয়ন পরিষদের পাঁচবারের চেয়ারম্যান; ফলে তার জনপ্রিয়তাও অনেক।
এছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ থেকে ফজলুর রহমান, এবি পার্টি থেকে আফজাল হোসেন, খেলাফত মজলিস থেকে গোলাম মোস্তফা, গণসংহতি আন্দোলন থেকে জুয়েল রানা ও গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে শফিকুর রহমান বাবর মনোনয়ন পেয়েছেন এবং জেলা এনসিপির সাংগঠনিক সম্পাদক নাহিদুল ইসলাম সাজু ভোট করবেন বলে জানা গেছে। তবে তাদের ভোটের মাঠে দেখা যাচ্ছে না।
রাজশাহী-৪ (বাগমারা)
এই আসনের রাজনৈতিক মাঠে বেশ গরম আবহ বিরাজ করছে। বিএনপির প্রার্থী ডিএম জিয়াউর রহমান জিয়াকে নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ দলের একাংশের। উপজেলা বিএনপির ৩৭ জন নেতা সরাসরি চেয়ারপারসনের কাছে তার ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। নেতারা অভিযোগ করেন, মনোনয়ন পাওয়ার পরও জিয়া ও তার অনুসারীরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। বাগমারাজুড়ে ভয়ভীতি সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে তিনি কর্মী সংকটে পড়েছেন এবং বড় সমাবেশ করতে পারছেন না।
এই আসনেও জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ডা. আবদুল বারি সরদারের নাম ঘোষণা করার পরই এলাকায় ব্যাপক সাড়া পড়ে। এর আগেই তিনি চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে এলাকায় বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। তাকে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী বলেই মনে করছেন অন্য দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ থেকে আবু মুসা, বাসদ থেকে ফিরোজ আলম, খেলাফত মজলিস থেকে ফেরদাউসুর রহমান ও গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে ভাসানী জনশক্তি পার্টির আবু ইউসুফ সেলিম, এনসিপি থেকে মীর ফারুক হোসেন এ আসনে প্রার্থী হবেন।
রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর)
এবারের সবচেয়ে উত্তপ্ত আসনগুলোর একটি রাজশাহী-৫। এখানে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন প্রবীণ নেতা নজরুল ইসলাম মণ্ডল। তবে এই মনোনয়নের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছেন মনোনয়নপ্রত্যাশী আবু বকর সিদ্দিক, ইশফা খায়রুল হক ও নাঈম মোস্তফার অনুসারীরা। নিয়মিতভাবে মহাসড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ চলছেই। অপরদিকে জামায়াতের একক প্রার্থী হিসেবে প্রচার চালাচ্ছেন জেলা শাখার সহকারী সেক্রেটারি নূরুজ্জামান লিটন। এছাড়া এই আসনে ইসলামী আন্দোলনের রুহুল আমিন, খেলাফত মজলিসের মুফতি আব্দুল হামিদ ও এলডিপির জহুরা শারমিন এবং জেলা এনসিপির সদস্য আবির চৌধুরী মাঠে আছেন।
রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট)
পদ্মাপাড়ের গুরুত্বপূর্ণ এই আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন জনপ্রিয় নেতা আবু সাঈদ চাঁদ। এখানে বিএনপির একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকলেও আবু সাঈদ চাঁদকে মনোনয়ন দেওয়ার পর তারা কেউ এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে বিরোধিতা করে মাঠে নামেননি।
এদিকে জামায়াতের মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি অধ্যক্ষ নাজমুল হক। প্রার্থী হিসেবে তার নাম ঘোষণা হওয়ার পরই তিনি সামাজিক ও ধর্মীয় সভা-সমাবেশের মাধ্যমে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করতে শুরু করেন। এছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমিনুল ইসলাম ও খেলাফত মজলিসের তোফায়েল আহমেদ ভোটের মাঠে আছেন। এ ছাড়া আসনটিতে প্রার্থী হতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন এনসিপির বিভাগীয় সংগঠক ইমরান ইমন।
সব মিলিয়ে রাজশাহীর ছয়টি আসনেই এখন দ্বন্দ্ব ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার উত্তাপ, অভ্যন্তরীণ সংকট, মাঠ পর্যায়ের সংগঠনের শক্তি ও ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাÑসব মিলিয়ে জেলাজুড়ে একটি ভালো ভোটযুদ্ধের আভাস দিচ্ছে। আসন্ন নির্বাচন রাজশাহীর রাজনৈতিক মানচিত্রে বড় পরিবর্তনও আনতে পারেÑএমনটাই মনে করছেন স্থানীয় ভোটার ও বিশ্লেষকরা।
মোহনপুর উপজেলার কৃষক জিয়াউর রহমান বলেন, আগে একটা বাতাস বোঝা যেত, এবার কোনদিকে বাতাস বইছে বোঝা যাচ্ছে না। সবাই মাঠে আছে, কিন্তু বিএনপির ভেতরের ঝামেলাটা ভোটে প্রভাব ফেলতে পারে।
গোদাগাড়ীর কলেজছাত্রী রুমানা আক্তার জানান, জামায়াত এবার খুব ভালোভাবে নির্বাচনি প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। আগে এতটা ধারাবাহিক দেখা যায়নি। তবে বিএনপির শক্ত ভোট ব্যাংক এখনো আছে। প্রধান লড়াই মূলত এ দুদলের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হবে।
বাগমারার ব্যবসায়ী রাজ্জাকুল ইসলাম বলেন, জামায়াতে ইসলামী যে এভাবে এগিয়ে আসবে, এটা ভাবা যায়নি। তবে ভোটটা খুব জমজমাট হবে। কে জিতবেÑসে নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যাচ্ছে না।
পবা উপজেলার গৃহিণী মমতাজ বেগম বললেন, আমরা এবার নতুন নেতৃত্ব চাই, যিনি এলাকার উন্নয়ন করবেনÑতিনি বিএনপির হোক বা জামায়াতের।
রাজশাহী মহানগরীর তরুণ ভোটার শাকিল আহমেদ বলেন, যে দলই হোক, আমরা ভিন্নধর্মী রাজনীতি চাই। শুধু দলবদল নয়, উন্নয়নভিত্তিক প্রতিযোগিতাও দরকার।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ড. জাহাঙ্গীর করিম বলেন, এ অঞ্চলে ঐতিহাসিকভাবে বিএনপি শক্তিশালী। কিন্তু মনোনয়নবঞ্চিতদের ক্ষোভে মনে হচ্ছে তাদের দলগত ঐক্য নড়বড়ে। এর ফলে জামায়াত এ বছর বাড়তি প্রভাব ফেলতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আনোয়ার হোসেনের মতে, এ জেলায় জামায়াত তাদের তৃণমূল সংগঠনকে অত্যন্ত গুছিয়ে মাঠে নামিয়েছে। দীর্ঘদিন পর তাদের মধ্যে নতুন উৎসাহ দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংকট যদি না থামে, তাহলে বেশ কয়েকটি আসনে কাঙ্ক্ষিত জয় পেতে তারা সমস্যায় পড়তে পারে।


সমানে সমান লড়াই হবে বিএনপি-জামায়াতের