রাজশাহীতে অনলাইন জুয়ার নীরব আগ্রাসন

মঈন উদ্দিন, রাজশাহী
প্রকাশ : ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ০৯: ৫৩

রাজশাহী মহানগরী থেকে শুরু করে আশপাশের জেলা ও গ্রামীণ জনপদ—সবখানেই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে অনলাইন জুয়ার পাল্লা। এক সময় সন্ধ্যা নামলেই উঠোনের আড্ডা, চায়ের দোকানের গল্প ছিল গ্রামীণ জীবনের চেনা দৃশ্য। এখন সেই জায়গা দখল করেছে স্মার্টফোন। লুডু, ক্যাসিনো, স্পিন বা ডাইস— এ ধরনের গেমের আড়ালে বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে নগদ টাকার জুয়া চলছে অবাধে।

বিজ্ঞাপন

তরুণ থেকে মধ্যবয়সি দিনমজুর, চা দোকানি কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী— অনেকেই এ নেশায় ডুবে যাচ্ছেন। এতে ব্যাহত হচ্ছে কাজকর্ম, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবার ও সমাজ। স্ত্রী-সন্তানদের প্রতি নির্যাতনের ঘটনাও ঘটছে, যা গ্রামীণ সমাজে নতুন এক অশান্তির সূচনা করেছে।

পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভার কৃষক সুলতানুল হক বলেন, যে মানুষ সারাদিন খেটে ৫০০-৭০০ টাকা আয় করে, সেই টাকাই রাতে মোবাইলে উড়িয়ে দিচ্ছে। হারলে ঋণ করে আবার খেলে, এভাবেই নিঃস্ব হচ্ছে পরিবার।

তিনি বলেন, প্রায় সময়ই চায়ের দোকান, গাছতলা কিংবা রাস্তার মোড়ে মোবাইল হাতে কয়েকজন যুবককে বসে থাকতে দেখা যায়। কেউ কেউ অনলাইনে টাকা লেনদেন করে খেলে। ক্রমেই আসক্তির গভীরে ঢুকে পড়ছে তারা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, অনলাইন জুয়ার কারণে অনেক পরিবারে এখন অশান্তি নেমে এসেছে। কেউ ঘরবাড়ি বিক্রি করছে, কেউ ঋণের ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, এমনকি আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে।

কর্ণহার গ্রামের শ্রমিক তাজুল ইসলামের ভাষায়, চায়ের দোকানের পাশে প্রতিদিন তাস খেলা চলে। অনেকে হেরে গিয়ে ঋণ করছে। আবার কেউ মোবাইলে অ্যাপে জুয়া খেলছে। এই কারণে পরিবারে সহিংসতা বাড়ছে। আগে সবাই মিলেমিশে চলত, এখন সামান্য টাকার জন্য মারামারি লাগে। ঘরেই ঝগড়া, বাইরে চিৎকার, জুয়াই সব সর্বনাশ করছে।

এ ব্যাপারে সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক নুরে আলম সিদ্দিকী বলেন, এটি কেবল প্রযুক্তির অপব্যবহার নয়, বরং গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক নীরব দুর্যোগ। এখনই ব্যবস্থা না নিলে এ আসক্তি সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করবে। তিনি আরো বলেন, একজন জুয়াড়ি কেবল নিজের ক্ষতি করে না, তার পরিবারে যে চাপ ও সহিংসতা তৈরি হয়, তা পুরো সমাজে অসন্তোষের আগুন ছড়িয়ে দেয়।

সমাজকর্মী তৌফিক আহম্মেদ বলেন, তরুণ শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী যখন জুয়ায় সময় দেয়, তখন শুধু তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, পুরো সমাজ তাতে ভুক্তভোগী হয়। এখনই কঠোর পদক্ষেপ না নিলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নেমে আসতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবার, স্কুল ও মসজিদভিত্তিক সচেতনতা কর্মসূচি চালু করতে হবে। তরুণদের জন্য বিকল্প বিনোদন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়মিত অনলাইন মনিটরিং জোরদার করতে হবে।

স্থানীয় সমাজ বিশ্লেষক ও মানবাধিকার কর্মী আনোয়ার হোসেন বলেন, এটি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, সমাজে ‘বিশ্বাসঘাটতি’ ও অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছে। এ প্রবণতা বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে গ্রামীণ অর্থনীতি ও সামাজিক সম্পর্ক দুই-ই ভেঙে পড়বে।

রাজশাহী জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও বিশেষ শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল আলম বলেন, জুয়া একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অনলাইন মাধ্যমে যারা এতে জড়িত তাদের শনাক্তে প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে। আমরা তথ্য পেলেই আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত