বগুড়ায় সমিতি-ফাউন্ডেশনের নামে ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ

সবুর শাহ্ লোটাস, বগুড়া
প্রকাশ : ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ১০: ০৫

বগুড়ায় সমিতি, ফাউন্ডেশন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ভুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে গত ১৫ বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। উচ্চ মুনাফার লোভে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ এসব প্রতারকচক্রের ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। কেউ কেউ গ্রেপ্তার হলেও বেশিরভাগই এখন পর্যন্ত গা ঢাকা দিয়েছে।

আরিফুজ্জামান পিন্টুর নেতৃত্বে ‘রেইনবো গ্রুপ’ নামের একাধিক প্রতিষ্ঠান প্রতি লাখে মাসে এক হাজার ৭০০ টাকা মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বগুড়া আদালতের একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে আরিফুজ্জামান পিন্টু ও রেইনবোর বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা চলমান রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

ভুক্তভোগী মাসুদ রানা ও গোলাম রব্বানী জানান, রেইনবো গ্রুপের বেশ কয়েকটি কোম্পানিতে তারা ১৭ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের অবসরপ্রাপ্ত এক শিক্ষক প্রায় ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এ রকম ভুক্তভোগীর সংখ্যা অনেক। তারা জানান, প্রথম কয়েক মাস লাভ দিলেও গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে সব বন্ধ। আসল-মুনাফা হারিয়ে আজ তারা পুরোপুরি নিঃস্ব। ভুক্তভোগীরা তার বাড়ি ও অফিসের সামনে বিক্ষোভ করেও কোনো অর্থ ফেরত পায়নি।

এক সূত্রের বরাতে জানা গেছে, আরিফুজ্জামান পিন্টু বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে নয়টি কোম্পানি বানিয়ে চার হাজার গ্রাহকের আনুমানিক ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। গ্রাহকদের বিক্ষোভের মুখে কিছু টাকা শোধ করলেও এখন ধুরন্ধর পিন্টুকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে রেইনবো ই-কমার্স, রেইনবো প্রপার্টিজ, রেইনবো হোমসহ তার কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে বলে জানা গেছে।

মল্লিকা সঞ্চয় সমিতির হেলালের ৩০ কোটি টাকার কেলেঙ্কারি

২০১০ সালে নামুজা এলাকায় হেলাল উদ্দিন ‘মল্লিকা সঞ্চয় সমিতি’ গড়ে তুলে গ্রামের সহজ-সরল লোকজনকে অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখান। ২০১৮ সালে ‘মল্লিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা’ নামেও আরেকটি প্রতিষ্ঠান চালু করেন। দুই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রামের লোকজনদের কাছ থেকে প্রায় ৩০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে গা ঢাকা দিয়েছিলেন। তিনি নিজের নামে ২৫ বিঘা জমি ও একটি বহুতল ভবন ক্রয় করেছেন বলে জানা গেছে। বর্তমানে হেলাল গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকলেও প্রতারক চক্রের সদস্য তার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, জামাতা, বেয়াই প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

হেলালের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ রিটায়ার্ড প্রাইমারি স্কুল শিক্ষিকা নিলুফা খাতুন, মঞ্জুয়ারা বেগম, সামান্তা মারিয়াম সিঁথি, রিনা খাতুন ও তার স্বামী মিজানুর রহমান, দুদু মিয়া, রাজমিস্ত্রী আরিফুল ইসলামসহ আরো অনেকের। তারা বলেন, আমরা কেউ তিন লাখ, কেউ পাঁচ লাখ, ১০ লাখসহ বিভিন্ন পরিমাণে টাকা রেখেছি। সব মিলিয়ে আমাদের প্রায় ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে সে নিজের নামে অনেক সম্পদ গড়ে তুলেছে। আমরা এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছি।

আমেনা ফাউন্ডেশনের আজাদের ৫০ কোটি টাকার প্রতারণা

বগুড়া, গাইবান্ধা, গোবিন্দগঞ্জ ও জয়পুরহাট আদালতে একাধিক অর্থ আত্মসাৎ মামলার আসামি আমেনা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ। আওয়ামী লীগের দুজন এমপি ও কিছু নেতার যোগসাজশে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজেক্ট ও অনুদান এনে দেওয়ার কথা বলে বগুড়া ও আশপাশের জেলাগুলোর বহু স্থানীয় এনজিও, ফার্ম ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের থেকে বিভিন্ন কৌশলে প্রায় ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় সে। এগুলো দিয়ে সে বগুড়া, ঢাকা, রংপুর, ফরিদপুর, রাজশাহী ও গাইবান্ধায় বাড়ি-ফ্ল্যাট ও খামার করেছে। তার স্ত্রী আমেনাও এ অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত।

আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী দুই এমপির সহায়তায় দীর্ঘদিন নির্বিঘ্নে প্রতারণা চালানো আজাদ পরিস্থিতি পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির নাম ব্যবহার করে প্রতারণামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। গত ১৬ আগস্ট তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার নামে প্রতারণা ছাড়াও মাদক চোরাচালানের মামলা রয়েছে।

তার সমিতির ক্ষতিগ্রস্ত ভুক্তভোগীরা বলেন, আমরা তার প্রকল্পে দীর্ঘদিন কাজ করেও টাকা পাইনি। আবার অনেকে জামানত হিসেবেও টাকা রেখেছেন। পাওনা টাকা উদ্ধারে এখন আমরা পথে পথে ঘুরছি।

প্রফেশনালস ইউনিভার্সিটির নামে ২০ কোটি টাকার ভুয়া সনদ বাণিজ্য

শুরুটা হয়েছিল প্রফেশনালস ফাউন্ডেশনের নামে। পরে সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন ছাড়াই ‘প্রফেশনালস ইউনিভার্সিটি’ নামে প্রতিষ্ঠান খুলে ভুয়া সার্টিফিকেট বিক্রি করতে শুরু করে শহরের কাটনারপাড়া এলাকার প্রতারক সোহেল ও সহযোগী ভোলানাথ পাল। চক্রটি গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের সনদ দেওয়ার টার্গেট করে, ভুয়া পরীক্ষার আয়োজন করে, প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যানার টানিয়ে সার্টিফিকেট বাণিজ্য করত বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা গড়ে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে এ পর্যন্ত এক হাজারের অধিক ভুয়া সনদ বিক্রি করেছে। এভাবে ২০ কোটি টাকার প্রতারণা হয়েছে বলে ধারণা। এই অভিযোগে সম্প্রতি পুলিশ তাদের দুজনকে গ্রেপ্তার করে।

অভিযুক্তদের কয়েকজন গ্রেপ্তার এবং বাকিরা আত্মগোপনে থাকায় এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

বিষয়টি নিয়ে জেলার অ্যাডভোকেট বার সমিতির সভাপতি আতাউর রহমান মুক্তা, জেলা সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযানের (সুপ্র) সাধারণ সম্পাদক কেজিএম ফারুক বলেন, এসব প্রতারকের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য আইনের সঠিক প্রয়োগ প্রয়োজন। এদিকে জেলা পুলিশ সুপার জেদান আল মুসা বলেন, আমরা আইনের মধ্য থেকে কাজ করার চেষ্টা করছি। অবশ্যই এদের বিচার প্রয়োজন আছে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত