অক্ষর-পত্র ও পাঞ্জেরী প্রকাশনীর প্রতারণা

একই পাণ্ডুলিপির বই ভিন্ন মোড়কে বাজারে

মাহফিজুল ইসলাম রিপন, পার্বতীপুর (দিনাজপুর)
প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৫, ১২: ০২

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের নামে অবৈধ গাইড বইয়ের একটি পাণ্ডুলিপি শুধু মোড়ক পরিবর্তন করে তিনটি ভিন্ন নামে বাজারজাত করা হচ্ছে। বই তিনটির লেখকও আলাদা। অথচ এ বইগুলোর দাড়ি, কমা, পৃষ্ঠা নম্বর হুবহু এক ও অভিন্ন। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত একই অবস্থা। শুধু শ্রেণিভেদে পাণ্ডুলিপি আলাদা। বছরের পর বছর চলে আসছে অক্ষর-পত্র প্রকাশনী ও পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.-এর অভিনব প্রতারণা। শিক্ষা নিয়ে এমন প্রতারণার যেন দেখার কেউ নেই।

বিজ্ঞাপন

সারা দেশে অক্ষর-পত্র প্রকাশনী ও পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি. ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ এবং ইংরেজি গ্রামার এভাবে বাজারজাত করছে। একই পাণ্ডুলিপির বই তিনটি হলো বাংলা- ১) ‘বিদ্যার্থী ব্যাকরণ ও নির্মিতি’, লেখক ড. সোলায়মান কবীর, এম এ তারেক মাহমুদ; ২) ‘আধুনিক ব্যাকরণ ও নির্মিতি’, লেখক মো. মাহমুদুল আলম, আকরামুজ্জামান, মোহাম্মদ আবু বকর এবং ৩) ‘নন্দন ব্যাকরণ ও নির্মিতি’, লেখক মনিরুল মোমেন ও মোহাম্মদ আবুল হোসেন। ইংরেজি-১) ‘Rapid Learner’s Communicative English Grammar & Composition’, Writer Jahangir Alom & Paretosh Deb; ২) ‘Young Learner’s Communicative English Grammar & Composition’, Writer Md. Abdullah Al Mamun, Abdul Karim & Pabel Kanti Das এবং ৩) ‘Radiant Learner’s Communicative English Grammar & Composition’, Writer Nasrin Anjuman Runi.

অনুসন্ধান করে অক্ষর-পত্র প্রকাশনী ও পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.-এর এসব বই সংগ্রহ করা হয়েছে। আরো কয়েকটি প্রকাশনীর বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে। কয়েকটি প্রকাশনী ও পাবলিকেশন্স এতই ধূর্ত যে, তারা একই বই ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় ভিন্ন মোড়কে বাজারজাত করে। যেমন—দিনাজপুর সদর, পার্বতীপুর, নবাবগঞ্জ, সেতাবগঞ্জে ‘বিদ্যার্থী ব্যাকরণ ও নির্মিতি’; ‘Young Learner’s. ফুলবাড়ী; চিরিরবন্দরে ‘নন্দন ব্যাকরণ ও নির্মিতি’, ‘Radiant Learner’s; নীলফামারীর সৈয়দপুর, রংপুরে ‘আধুনিক ব্যাকরণ ও নির্মিতি’ এবং ‘Rapid Learner’s নামে বাজারজাত করা হয়। ফলে সহজে ধরারও উপায় নেই।

ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রণীত বাংলা ব্যাকরণ ও ইংলিশ গ্রামার শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ট। অথচ অনৈতিক সুবিধা নিয়ে একশ্রেণির শিক্ষক শিক্ষার্থীদের চাপ দিয়ে পাবলিকেশন্সের এসব বাংলা ব্যাকরণ ও ইংরেজি গ্রামার এবং সহায়ক বই কিনতে বাধ্য করছেন। কয়েকটি পাবলিকেশন্স নির্বাচিত শিক্ষকদের এবং ক্ষেত্রবিশেষে সংশ্লিষ্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষককে অনৈতিক আর্থিক সুবিধা দিয়ে থাকে বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। দিনাজপুর জেলার ১৩ উপজেলায় কয়েক মাস ধরে অনুসন্ধান করে মিলেছে একই তথ্য।

অক্ষর-পত্র প্রকাশনী ও পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেডের ন্যাশনাল মার্কেটিং ম্যানেজার মোজাম্মেল হোসাইন একই পাণ্ডুলিপি ভিন্ন ভিন্ন নামে ছাপিয়ে বাজারজাত করা অনৈতিক বলে স্বীকার করেন। তবে তারা ব্যবসায়িক স্বার্থে এসব কাজ করেন। অনেক স্কুলে ডোনেশন দিতে হয়। তাছাড়া বই নকল প্রতিরোধে ভিন্ন ভিন্ন নামে বই প্রকাশ করা হয়। তবে এটা ব্যবসায়িক ত্রুটি বলে তিনি মনে করেন।

তিনি বলেন, বাংলা ব্যাকরণ এবং ইংরেজি গ্রামার তারা একই টেক্সট শুধু কভার পাল্টে তিন নামে প্রকাশ ও বাজারজাত করেন। কিন্তু এমনও প্রকাশনী-পাবলিকেশন্স আছে—যারা একই টেক্সট ছয়টি নামে প্রকাশ ও বাজারজাত করে। আগামী বছর থেকে আর এভাবে বই বাজারজাত করা হবে না বলে তিনি জানান।

এছাড়া, সহায়ক বইয়ের নামে গাইড বই বা নোট বই অবাধে বিক্রি হচ্ছে। এতে সহায়তা করছেন একশ্রেণির অসাধু শিক্ষক ও স্থানীয় পুস্তক ব্যবসায়ী। সারা দেশের মতো পার্বতীপুর উপজেলার বিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশ শিক্ষক বিভিন্ন প্রকাশনীর সহায়ক বইসহ এসব বাংলা ব্যাকরণ ও ইংরেজি গ্রামার কিনতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করছেন।

এ উপজেলায় অক্ষর-পত্র প্রকাশনী ও পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.-এর এসব বাংলা ব্যাকরণ ও ইংরেজি গ্রামারসহ সহায়ক বই শিক্ষার্থীদের কিনতে বাধ্য করছেন যেসব বিদ্যালয়ের শিক্ষক, তার মধ্যে পার্বতীপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, পার্বতীপুর এএসএম উচ্চ বিদ্যালয়, রোস্তমনগর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, দাগলাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়, সেরাজুল হুদা উচ্চ বিদ্যালয়, ঝাড়ুয়ারডাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়, দক্ষিণ শালন্দার মডেল উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকুলা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, যশাই উচ্চ বিদ্যালয়, পাটিকাঘাট সুলতানপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, পাটিকাঘাট উচ্চ বিদ্যালয়, খলিলপুর হাজী সানাউল্যা উচ্চ বিদ্যালয়, ভোটগাছ উচ্চ বিদ্যালয়, মেরিগোল্ড উচ্চ বিদ্যালয় অন্যতম।

তবে এসব বিদ্যালয়ের কয়েকজন প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষককের বক্তব্য হলো— শিক্ষার্থীদের সহায়ক বই কেনার জন্য চাপ দেওয়া হয় না, পরামর্শ দেওয়া হয়। যাদের সামর্থ্য আছে, ইচ্ছে হলে তারা কিনবে।

অক্ষর-পত্র প্রকাশনী ও পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সের দিনাজপুর জেলা প্রতিনিধি আরিফ আহমেদ এবং পার্বতীপুর উপজেলা প্রতিনিধি রবিউল ইসলাম (জিয়া) একই পাণ্ডুলিপির ভিন্ন ভিন্ন নামে তিনটি বাংলা ব্যাকরণ ও তিনটি ইংরেজি গ্রামার বই বাজারজাত করার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। তবে তাদের দাবি, এটা দোষের কিছু বলে নয়।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত