ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সুনামগঞ্জের ৫টি আসনে নির্বাচনি উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। তবে জেলার সুনামগঞ্জ– ১ (ধর্মপাশা–তাহিরপুর–মধ্যনগর–জামালগঞ্জ) এবং সুনামগঞ্জ– ৩ (জগন্নাথপুর–শান্তিগঞ্জ) আসনে জামায়াতসহ ৮ দলের নির্বাচনি সমঝোতা জোটে অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তা বেড়েছে।
এ অনিশ্চয়তা শুধু দুটি আসনেই। বিশেষ করে বারবার দলবদল করা দুই আলোচিত রাজনীতিক ডা. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী ও অ্যাডভোকেট মাওলানা শাহীনূর পাশা চৌধুরীকে ঘিরে জোটের তৃণমূলে তৈরি হয়েছে নানান প্রশ্ন ও অনাস্থা।
জানা গেছে, সুনামগঞ্জ–১ আসনে ডা. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী আবারো আলোচনার কেন্দ্রে। ছাত্রদল দিয়ে রাজনীতি শুরু করে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য পর্যন্ত পৌঁছালেও তার রাজনৈতিক জীবনে একাধিক দলবদল ভোটারদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করেছে। ২০০৮ সালে চারদলীয় জোটের প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে পরাজয়ের পর ২০১৮ সালে মনোনয়ন না পেয়ে বিএনপি ছাড়েন তিনি। পরে বিকল্পধারায় যোগ দিয়ে প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে সমর্থন জানান। একই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নেন। সর্বশেষ ২০২৫ সালের নভেম্বরে তিনি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশে যোগ দিয়ে জামায়াত-নেতৃত্বাধীন আটদলীয় জোটের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন।
অন্যদিকে দীর্ঘদিন মাঠে সক্রিয় জেলা জামায়াত আমির উপাধ্যক্ষ মাওলানা তোফায়েল আহমদ খানকে এই আসনে তুলনামূলক শক্ত ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থী হিসেবে দেখছেন স্থানীয়রা। তাদের মতে এ আসনে রফিকুল ইসলামকে প্রার্থী করা হলে জোটের ভোটব্যাংক ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
অন্যদিকে আলোচনায় রয়েছে সুনামগঞ্জ– ৩ আসন। এখানে দলীয় প্রার্থী হয়েছেন রিকশা প্রতীকে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের অ্যাডভোকেট মাওলানা শাহীনূর পাশা চৌধুরী, জামায়াত প্রার্থী অ্যাডভোকেট ইয়াসিন খান এবং খেলাফত মজলিস প্রার্থী শেখ মুশতাক আহমেদ। এ তিনজনই জোটের ভোটের মাঠে লড়াই করতে মুখিয়ে আছেন।
জানা গেছে, অ্যাডভোকেট মাওলানা শাহীনূর পাশা চৌধুরী দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে একাধিকবার দল পরিবর্তন করেছেন। ২০০৪ সালে চারদলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও সর্বশেষ নির্বাচনে দলবদল করে তৃণমূল বিএনপি থেকে ২০২৪ সালে নির্বাচন করে জামানত হারান। এরপর থেকে রাজনীতির মাঠে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেন তিনি। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির হিসেবে জোটের টিকিট নিশ্চিত করতে সক্রিয় রয়েছেন।
তবে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশ তার প্রার্থিতায় অনাগ্রহ প্রকাশ করছেন। তাদের মতে, বারবার দলবদলের কারণে তার রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
এর বিপরীতে জামায়াত মনোনীত অ্যাডভোকেট ইয়াসিন খান গত ছয়মাস ধরে নিয়মিত গণসংযোগ চালিয়ে মাঠে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন। স্থানীয় নেতাকর্মীদের ভাষ্য, তিনি তুলনামূলকভাবে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির এবং ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রার্থী।
শান্তিগঞ্জের ভোটার এম জে কে শাহজাহান বলেন, মাওলানা শাহিনুর পাশা চৌধুরী একজন আলেম মানুষ। একজন আলেম হয়ে ফ্যাসিবাদি সরকারে ডামি নিবাচনে অংশগ্রহণ করা মোটেও সমীচীন হয়নি। আলেম সমাজের কাছে তিনি গ্রহনযোগ্যতা হারিয়েছেন। বার বার দলবদল করে এবার খেলাফত মজলিসের হয়ে টিকেট নিয়ে ৮ দলীয় জোটের প্রার্থী করা হলে ভোটের মাঠে ভরাডুবির শংকা রয়েছে।
জেলা জামায়াত আমির ও কেন্দ্রীয় মজলিসের শুরা সদস্য মাওলানা তোফায়েল আহম্মেদ খাঁন আমার দেশকে বলেন, দীর্ঘদিন হাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ- ১ আসনে ঘুরে বেড়িয়েছি। দাঁড়িপাল্লার পক্ষে ভোট প্রার্থনা করছি। দাঁড়িপাল্লার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সহস্রাধিক কমী মাঠে কাজ করছে। হঠাৎ করে ৮ দলীয় জোটে বিতর্কিত কাউকে মনোনয়ন দেয়া হলে ভোটাররা মেনে নেবে না। এমনকি ভোটের মাঠে ঐ প্রার্থীকে ফিট মনে করি না। ৮ দলীয় জোট চায় না আসন হারাতে, তাই মাঠ জরিপ করেই প্রার্থী ঘোষণা হবে ইনশাআল্লাহ।
ডা. রফিকুল ইসলাম দলবদলের কথা স্বীকার করে বলেন, আমি ৫৭ বছর ধরে রাজনীতি করি। আমার নির্বাচনি আসনে আমার বিজয়ী হওয়ার মতো ভোটার রয়েছেন। আমি এমপি নির্বাচন করার মূল কারণ হলো নির্বাচিত হলে গণমানুষের কল্যাণে বাকি জীবনটাকে উৎস্বর্গ করবো।
জামালগঞ্জের সচেতন ভোটার ফখর উদ্দিন বলেন, সুনামগঞ্জ- ১ আসনে ৮ দলীয় জোটের প্রার্থী ডা. রফিককে ঘিরে গুঞ্জন উঠছে। তিনি বারবার দলবদল করেছেন। এসব রাজনৈতিক শিষ্টাচার নয়। নৈতিকতা মানদণ্ড নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। ডিগবাজি করে জোটের মনোনয়ন ভাগিয়ে নিলে ভোটের মাঠে ফলাফল খুব একটা ভালো হবে বলে মনে হয় না। তিনি ২০০৮ সালে চারদলীয় জোটের প্রার্থী ছিলেন তখন ৯৪ হাজার ভোট পেয়ে পরাজিত হন। এই ভোটগুলো ছিল জোটগত কারণে। এছাড়া তখন ৪ দলীয় জোটের জোয়ার ছিল। দলবদলের কারণে এবার ৮ দলীয় জোটের প্রার্থী করা হলে জোয়ার বইবে না।
অ্যাডভোকেট ইয়াসিন খান বলেন, সুনামগঞ্জ- ৩ একটি অত্যান্ত মর্যাদাপূর্ণ আসন। এখানকার জনগণ সবসময় যোগ্য ও ক্লিন ইমেজের প্রার্থীকে নির্বাচিত করেছেন। আমরা গ্রামেগঞ্জে ঘুরে দেখেছি সচেতন মানুষ দাঁড়িপাল্লা প্রতীকের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে চান। জরিপের ভিত্তিতে মনোনয়ন না দিয়ে বিতর্কিত কাউকে প্রার্থী করলে জোটের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হবে। প্রয়োজনে এই আসন উন্মুক্ত রাখাই জোটের জন্য লাভজনক হবে।
নিজের দলবদল ও ডামি নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে মাওলানা শাহীনূর পাশা চৌধুরী বলেন, দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে আমি সর্বদা ফ্যাসিবাদি শক্তির বিরুদ্ধে আপসহীন ছিলাম। সে কারণেই আমাকে গুমের হুমকি দেওয়া হয়। যারা আমার দলবদল নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তাদের জানাতে চাই—এই পরিবর্তন কোনো ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য ছিলো না। বিগত ৩৫ বছরে জনগণের কাছে আমি যে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছি, আমার ভোট ব্যাংক ষড়যন্ত্রকারীদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। গুম থেকে বাঁচতে এবং বৃহত্তর ইসলামী আন্দোলনের কৌশলগত প্রয়োজন হিসেবেই আমি ডামি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি।
খেলাফত মজলিস নেতা শেখ মুশতাক আহমেদও সতর্ক করে বলেন, বিতর্কিত কাউকে মনোনয়ন দিলে জোট নিশ্চিতভাবে ভরাডুবির মুখে পড়বে।
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

