কৃত্রিম সংকটে বাড়তি দামে সার বিক্রি, বিপাকে কৃষক

সরদার আনিছ
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮: ৩৩
ছবি: সংগৃহীত

সিন্ডিকেটের খপ্পরে সারা দেশে সারের কৃত্রিম সংকট দেখা দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় টাকা দিয়েও সঠিক সময়ে সার কিনতে পারছেন না কৃষক। আবার কোনো কোনো এলাকায় সরকার নির্ধারিত দামের চেয়েও বেশি দামে ডিলাররা সার বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা।

বিজ্ঞাপন

বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের বীরগ্রাম গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান আমার দেশকে বলেন, ১০ বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছি। কিন্তু বাজারে সব ধরনের সারের দাম সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি। এরপরও কিনতে গিয়ে সার পাচ্ছি না।

একই উপজেলার সুঘাট ইউনিয়নের বিনোদপুর গ্রামের কৃষক ইমদাদুল হক জানান, বাজারে অতিরিক্ত দাম দিয়েও সার পাচ্ছেন না। টিএসপি সার প্রতি বস্তা সরকারি মূল্য ১৩৫০ টাকা হলেও বিভিন্ন এলাকায় ১৭০০ থেকে ১৮০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। এরপরও সময়মতো পাওয়া যাচ্ছে না। অন্য সব সারের দামও বেশি নেওয়া হচ্ছে।

বিনোদপুর গ্রামের কৃষক ফাইজুল ইসলাম জানান, তিনি চার বিঘা জমিতে ধান লাগিয়েছেন। কিন্তু বাজারে টিএসপি পাচ্ছেন না। টিএসপি সার কিনতে না পেরে জমিতে তিনি মরিচের চারা রোপণ করতে পারছেন না।

এছাড়া রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল, রংপুর ও কুষ্টিয়ার কৃষকও অভিযোগ করছেন সেখানে সরকার নির্ধারিত দামে সার মিলছে না। অধিকাংশ ডিলার অতিরিক্ত দামে সার বিক্রি করছেন। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, সারের কোনো ঘাটতি নেই।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দাবি, সরবরাহ ব্যবস্থায় ত্রুটি থাকলেও তেমন সংকট নেই। অন্তর্বর্তী সরকারকে বিব্রত করতে বিশেষ সিন্ডিকেট সার নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি করছে।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (উপকরণ) রওশন আলম আমার দেশকে বলেন, দেশে সারের মজুত বা সরকারিভাবে সরবরাহের কোনো ঘাটতি নেই, কোনো সংকটও নেই। দেশের কোথাও কোথাও কিছু সমস্যার কথা শুনতে পাচ্ছি, অভিযোগ পেলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, বুঝতেই পারছেন ডিলারদের অধিকাংশই বিগত সময়ের, সেহেতু তারা কিছুটা তো ডিস্টার্ব করতেই পারেন। এ বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি।

কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া বলেন, দেশে সারের কোনো সংকট নেই; ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের পর্যাপ্ত সার মজুত আছে। এ মৌসুমে সার নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।

এরপরও বগুড়া, রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মাগুরা, রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় টিএসপি, ডিএপি ও এমওপি সারের সংকট চলছে। ডিলারদের কাছ থেকে বিঘাপ্রতি ১০ কেজির বেশি সার পাচ্ছেন না কৃষক। কিন্তু কৃষকদের মতে, সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বাড়তি টাকা দিলে সার পাওয়া যাচ্ছে। ব্যবসায়ী-ডিলাররা সারের কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছেন; সেজন্য সারের দাম কেজিতে পাঁচ থেকে ছয় টাকা বেড়েছে। কোনো কোনো এলাকায় এরচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে সার।

সরকার নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী ইউরিয়া ও টিএসপি সার কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ২৭ টাকা, এমওপি ২০ ও ডিএপি প্রতি কেজি ২১ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। অন্যদিকে জমির উর্বরতা, মাটির ধরন ও ফসলের জাতের ওপর নির্ভর করে প্রতি একর জমিতে ইউরিয়া প্রায় ১৩০-১৪০ কেজি, টিএসপি ৫০-৬০ ও এমওপি ৪০-৫০ কেজি প্রয়োজন হতে পারে কৃষকের।

চলতি বছর সারা দেশে রাসায়নিক সারের চাহিদা ৫৭ লাখ ৮৫ হাজার টন। এ চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ বিভিন্ন দেশ থেকে সরকারিভাবে আমদানি করা হচ্ছে। বাকি সারের চাহিদা মেটে দেশের কারখানাগুলোর মাধ্যমে।

আমদানির বাইরে যে ২০ শতাংশ সার দেশে উৎপাদন হয়, এসব সার সরবরাহের জোগান দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। এ দুই প্রতিষ্ঠান উৎপাদন, আমদানি-পরবর্তী মজুত ও সরবরাহ নিশ্চিত করে মূলত নিজেদের নিয়োগ করা পরিবহন ঠিকাদার ও ডিলারদের মাধ্যমে।

বিএডিসির তথ্য বলছে, বর্তমানে বিভিন্ন গুদামে ছয় লাখ ৩০ হাজার ৬১৩ টন ইউরিয়া সার মজুত রয়েছে। এছাড়া দুই লাখ ১৭ হাজার টন টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট), দুই লাখ ৭৩ হাজার টন ডিএপি এবং দুই লাখ ৮১ হাজার টন এমওপি মজুত রয়েছে। এই সার দিয়ে দেশে অন্তত তিন মাসের সারের চাহিদা মেটানো সম্ভব। পাশাপাশি ২৫ হাজার টন টিএসপি, এক লাখ ১০ হাজার টন এমওপি এবং এক লাখ ২০ হাজার টন ডিএপি জাহাজে রয়েছে—যা পর্যায়ক্রমে দেশে পৌঁছার কথা।

এদিকে দেশে সবচেয়ে বেশি সার প্রয়োজন হয় রবি মৌসুমে; অর্থাৎ নভেম্বর থেকে মার্চ (কার্তিক-ফাল্গুন) মাসে। এ সময় মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ সার প্রয়োজন হয়। পরবর্তী মৌসুম হচ্ছে আউশ ধানের সময়। এ মৌসুমের ব্যাপ্তি এপ্রিল থেকে জুলাই (চৈত্র-আষাঢ়) পর্যন্ত। এ সময় চাহিদার ৩০ শতাংশ এবং আমন মৌসুমে সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর (আশ্বিন-মাঘ) বাকি ৩০ শতাংশ সারের দরকার পড়ে। চলতি আমন মৌসুমেও কৃষি উৎপাদনের অন্যতম উপকরণ সারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

বিষয়:

কৃষকসার
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত