নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য পূরণে ৪২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন

অর্থনৈতিক রিপোর্টার
প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৫, ১৯: ০৩

বাংলাদেশে ২০৪০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য পূরণ করতে হলে ৩৫ গিগা ওয়াট বিদ্যুৎ সক্ষমতা স্থাপন করতে হবে। এ জন্য ৩৫ দশমিক ২ বিলিয়ন থেকে ৪২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। তবে নীতিমালার অসংগতি, জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধে পরিকল্পনার অভাব এবং বিনিয়োগ অনিশ্চয়তার কারণে এই লক্ষ্য অর্জন হুমকিতে পড়তে পারে বলে জানিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)।

বিজ্ঞাপন

রোববার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে “২০৪০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পুনর্মূল্যায়ন: ‘স্মার্ট’ লক্ষ্য ও প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের পূর্বাভাস” শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন সিপিডির প্রোগ্রাম অ্যাসোসিয়েট মেহেদী হাসান শামীম।

সংস্থাটির এ গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় নীতি পরিকল্পনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য ভিন্ন ভিন্ন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব লক্ষ্যে বাস্তবতাকে পাশ কাটানো হয়েছে। মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যানে ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০২৫-এ ২০৪০ সালের মধ্যে এ লক্ষ্য ৩০ শতাংশ। আবার সমন্বিত বিদ্যুৎ জ্বালানি মহাপরিকল্পনায় (আইইপিএমপি) ২০৪০ সালের মধ্যে পরিচ্ছন্ন জ্বালানির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০ শতাংশ।

প্রতিবেদনে আইইপিএমপির “পরিচ্ছন্ন জ্বালানি” সংজ্ঞার সমালোচনা করে বলা হয়েছে, যেখানে পারমাণবিক বিদ্যুৎ ও কার্বন ক্যাপচারের মতো অপ্রমাণিত প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে ২০৪১ সালের লক্ষ্য পূরণের মাত্র ৯ শতাংশ প্রচলিত নবায়নযোগ্য উৎস—সৌর ও বায়ু থেকে আসবে।

এদিকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত জাতীয় গ্রিডে নবায়নযোগ্য জ্বালানি যুক্ত হয়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৬ শতাংশ, যেখানে গ্যাসভিত্তিক জীবাশ্ম জ্বালানির সক্ষমতা ৪৩ দশমিক ৪ শতাংশ। এছাড়া আমদানিকৃত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতাও সমান তালে বাড়ছে।

সিপিডির গবেষণা বলছে, সরকারের জ্বালানি পরিকল্পনার “অসামঞ্জস্যতার ফলে একদিকে দেশে জীবাশ্ম জ্বালানির উদ্বৃত্ত সক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে লক্ষ্য থাকলেও নবায়নযোগ্য খাতে বিশাল ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সরকারের লক্ষ্য পূরণ করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রয়োজনীয় নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা হতে হবে ১৮ হাজার ১৬২ মেগাওয়াট। অথচ বর্তমান পরিকল্পনায় রয়েছে মাত্র ১ হাজার ৯৬৭ মেগাওয়াট—যা আগামী পাঁচ বছরে ১৬ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি ঘাটতি তৈরি করবে।

বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য পূরণে সিপিডির গবেষণায় বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে প্রধানত বিনিয়োগ চ্যালেঞ্জের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে সিপিডি। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বাংলাদেশকে ২০৪০ সালের নবায়নযোগ্য জ্বালানি লক্ষ্য পূরণ করতে মোট ৩৫ দশমিক ২ বিলিয়ন (আমদানি বাদে) থেকে ৪২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন ২০২৫–২০৩৫ সময়কালে, প্রায় ২৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার।

এর মধ্যে: সৌর শক্তি: ১৬.৫ বিলিয়ন ডলার, বায়ু শক্তি: ১২.৬ বিলিয়ন ডলার, জলবিদ্যুৎ: ৬ বিলিয়ন ডলার, আমদানি ও অন্যান্য: ৭.৪ বিলিয়ন ডলার।

তবে পরিকল্পনায় নানা জটিলতা বিদ্যমান থাকায় বিনিয়োগকারীরা বিভ্রান্ত হতে পারেন বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। এদিকে সিপিডি বলছে, নবায়নযোগ্য জ্বালানির মিশ্রণে সৌর বিদ্যুৎই প্রধান, যা বর্তমানে প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট থেকে ২০৪০ সালে ১৭ হাজার ২২৯ মেগাওয়াটে উন্নীত করতে হবে। বায়ু বিদ্যুতের প্রবৃদ্ধি আরও নাটকীয়, যা ৬২ মেগাওয়াট থেকে ১৩,৬২৫ মেগাওয়াটে পৌঁছাতে হবে যা খুবই চ্যালেঞ্জিং।

বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিপিএ) সাবেক প্রেসিডেন্ট ইমরান করিম বলেন, বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশ মাত্র ২%, কিন্তু ২০৩০ সালের মধ্যে এটিকে ২০%-এ উন্নীত করতে হলে ১২-১৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনঃস্থাপন জরুরি; এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সরকার সম্প্রতি নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য এলওআই (লেটার অব ইনটেন্ট) দিয়েছে, তবে দ্রুত টেন্ডার নিষ্পত্তি জরুরি, যাতে অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়।

বিদ্যমান জীবাশ্ম বিদ্যুৎকেন্দ্র অবসরের জন্য বাধ্যতামূলক, সময়সীমা নির্ধারিত কৌশল না থাকায় জ্বালানি রূপান্তর প্রক্রিয়ায় বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে বলে সিপিডিবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের পাশাপাশি অচল জীবাশ্ম কেন্দ্র বজায় রাখতে গিয়ে ব্যয়বহুল অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সক্ষমতার সংকট তৈরি হতে পারে।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বাংলাদেশ যদি নীতিগত অস্পষ্টতা ও জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বজায় রাখে, তবে আর্থিক সংকট ও জলবায়ু লক্ষ্যে ব্যর্থতার ঝুঁকি বাড়বে। অন্যদিকে, ঐক্যবদ্ধ ও ‘স্মার্ট’ কৌশল গ্রহণ করলে বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সফল রূপান্তর করতে পারবে। এখনই সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার সময়।জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সফলভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে উত্তরণে বেশকিছু সুপারিশ করেছে সিপিডি। এসবের মধ্যে রয়েছে-সব জাতীয় নীতিতে সমন্বিতভাবে একটি ২০৪০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য গ্রহণ করতে হবে।

২০৩০ ও ২০৩৫-এর জন্য স্পষ্ট মাইলফলকসহ একটি জ্বালানি উৎস-ভিত্তিক বাস্তবায়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, যাতে জীবাশ্ম বিদ্যুৎকেন্দ্র অবসরের সময়সূচিও থাকে।

নেপাল, ভুটান ও ভারতের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি সমৃদ্ধ প্রতিবেশী দেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করে স্বল্পমেয়াদি সক্ষমতার ঘাটতি পূরণ এবংআন্তঃ সীমান্ত- বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে হবে।

বহুজাতিক উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি, এআইআইবি, বিশ্বব্যাংক) এবং জলবায়ু তহবিলের সঙ্গে কৌশলগতভাবে সম্পৃক্ত হয়ে স্বল্প সুদে অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে, প্রকল্প ঝুঁকি কমাতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ৩৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগে বেসরকারি পুঁজি আকর্ষণ করতে হবে।

গ্রিড অবকাঠামো, বিদ্যুৎ সঞ্চয় প্রযুক্তিতে জরুরি বিনিয়োগ করতে হবে এবং ছাদে সৌরবিদ্যুৎ (রুফটপ সোলার) ও মিনি-গ্রিডের মতো বিকেন্দ্রীকৃত জ্বালানি ব্যবস্থা প্রসার করতে হবে।

অনুষ্ঠানে প্যানেলিস্ট হিসেবে বক্তব্য দেন, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ নাভিদ সলিমুল্লাহ, ফাহমিদা খানম, পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশের চেয়ারম্যান রেজওয়ান খান, বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনস এর সাবেক প্রেসিডেন্ট ইমরান করিম, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মির্জা শওকত আলীসহ প্রমুখ।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত