রাজধানীর বাজারে আবারও ইলিশের আকাল দেখা দিয়েছে। এতে বাজারে সরবরাহ কমে অনেক বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এমনিতেই এবার বাজারে সরবরাহ কম, চলতি সপ্তাহে তা আরো কমেছে। এতে মূল্যও বেড়েছে কেজিতে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইলিশের প্রজনন রক্ষায় আগামীকাল শুক্রবার রাত ১২টার পর থেকে পদ্মা-মেঘনায় সব ধরনের মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা শুরু হচ্ছে। ঠিক তার আগ মুহূর্তে বাজারে সরবরাহ কমে গেছে। সে সঙ্গে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার কারণে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে ইলিশ।
গতকাল বুধবার কারওয়ান বাজারের মাছ ব্যবসায়ী আবদুল কাদের বলেন, সরবরাহ কমে যাওয়ায় চলতি সপ্তাহে আগের সপ্তাহের তুলনায় ইলিশের দাম বেড়ে গেছে। ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ দুই হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা আগের সপ্তাহে ৫০০ টাকা কমে বিক্রি হয়েছে। এক থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার ৫০০ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল দুই হাজার ৮০০ থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যে। আর ছোট ইলিশের কেজি এখন এক হাজার ৬০০ থেকে দুই হাজার টাকা। এই ইলিশই গত সপ্তাহে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, বুধবার ঢাকার বাজারে আকারভেদে প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হয় ৯০০ থেকে সর্বোচ্চ দুই হাজার ২০০ টাকা দরে। দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরেই ঢাকার বাজারে এ দরে কেনাবেচা হচ্ছে ইলিশ।
কেরানীগঞ্জ থেকে নয়াবাজারে আসা ক্রেতা আব্দুর রহমান বলেন, দুদিন পরই ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা আসবে বলে আজ ইলিশ কিনতে এসে দেখি দাম অনেক বেশি।
কেরানীগঞ্জের বউবাজারের খুচরা ইলিশ বিক্রেতা রমজান আলী বলেন, কদিন আগেও জাটকা ইলিশ বেশ কমে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এখন সেগুলোর দামও হাজার টাকার কমে পাওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে বাজারে ইলিশের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এর কারণ অনুসন্ধান, সরবরাহ ব্যবস্থা পর্যালোচনা, প্রতি কেজি ইলিশ সংগ্রহে ব্যয়, সংরক্ষণ ব্যয়, সরকারের নীতি-সহায়তা, রপ্তানি ও রপ্তানি মূল্য পর্যালোচনা করতে সম্প্রতি এক সমীক্ষা চালায় বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)।
সংস্থাটি বলছে, ইলিশ মাছ জেলেদের হাত থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতেই কয়েকবার হাতবদল হয়। এর ফলেই দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। তাদের ভাষ্য, নদী ও সাগর থেকে জেলেদের ধরা মাছ চার থেকে ছয়বার হাতবদল হয় এবং প্রতিবারই ৬০ শতাংশের মতো দাম বেড়ে যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইলিশ মাছ জেলে থেকে মাছ ঘাট, আড়তদার, পাইকার ও খুচরা বিক্রেতা হয়ে ভোক্তার হাতে যায়। চার থেকে ছয়বার হতবদলের প্রতিবারই দাম বাড়ে ৫৯ থেকে ৬০ শতাংশ। এ জন্য আগের বছরের তুলনায় এবার দাম বেড়ে অস্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
সমীক্ষায় ইলিশের দাম বৃদ্ধির জন্য আরো কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছে কমিশন। এর মধ্যে ভরা মৌসুমে কম দামে কিনে হিমাগারে সংরক্ষণ করে পরে চড়া দামে বিক্রি করার কথাও বলা হয়েছে। এজন্য আড়তদারদের দায়ী করেছে কমিশন।
এতে বলা হয়, ইলিশ মাছ রপ্তানি নিষিদ্ধ থাকলেও প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করার সুযোগ থাকায় অভ্যন্তরীণ বাজারে ঘাটতি বেড়েছে। আর আগের বছরের তুলনায় এবার নদীর মোহনায় ইলিশের পরিমাণ দুই-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। পাশাপাশি গভীর সমুদ্রেও ইলিশের সংগ্রহ কমে গেছে। এতে জেলেদের ট্রলার খরচ একই হলেও মাছ কম পাওয়ায় প্রতি কেজি ইলিশ সংগ্রহের পেছনে গড় ব্যয় বেড়েছে।
সমীক্ষা প্রতিবেদনের বরাতে বিটিটিসি বলছে, প্রতি কেজি ইলিশ আহরণে এবার জেলেদের গড়ে খরচ পড়ছে ৪৮৭ টাকা। এসব কারণে আগের বছরের তুলনায় এবার বাজারে প্রতি কেজি ইলিশের দাম ২০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। তাই ইলিশের খুচরা মূল্য যেন মাছের আকার ও ওজন অনুযায়ী নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, তার সুপারিশ করেছে ট্যারিফ কমিশন।
গত আগস্টে ইলিশের বাজার সম্পর্কে সমীক্ষায় বলা হয়, এ সময়ে বাজারে ২৫০ গ্রাম থেকে ৪৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি ছিল ৭০০ থেকে ৮৫০ টাকা, ৫০০ গ্রাম থেকে ৭৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশ এক হাজার ২০০ থেকে ৪০০ টাকা, ৭৫০ গ্রাম থেকে এক কেজির ইলিশের দর এক হাজার ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, এক থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশের দাম দুই হাজার ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা এবং দেড় কেজির বেশি ওজনের ইলিশের কেজির মূল্য ছিল দুই হাজার ৮০০ থেকে তিন হাজার টাকা।
অথচ আগের বছরের আগস্টে দেড় কেজির বেশি ওজনের ইলিশের দর ছিল এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার টাকা। আর এক থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশের দর ছিল এক হাজার ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। এ দুই শ্রেণির ইলিশের দাম গত বছরের তুলনায় সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ ৯০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা বেড়েছে। ২৫০ গ্রাম থেকে এক কেজির কম ওজনের ইলিশের দাম বেড়েছে প্রতি কেজিতে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।
এদিকে গত সোমবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, বাজারে ইলিশের চড়া দাম এবং তা কমানোর বিষয়ে সুখবর দিতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করছি। এর ব্যাখ্যায় তিনি জানান, প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি মানবসৃষ্ট নানা প্রভাবের কারণে ইলিশের উৎপাদন কমছে; ফলে দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, ইলিশের স্থায়ী উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে মৎস্য সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী প্রধান প্রজনন মৌসুমে পরিপক্ব ইলিশের নিরাপদে ডিম দেওয়া নিশ্চিত করা এবং সারা দেশে ইলিশ ধরা, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। চলতি বছর ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম ৪ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত মা ইলিশ রক্ষায় বিশেষ অভিযান চলবে। জলসীমার বাইরে থেকেও মাছ ধরা ট্রলারের অনুপ্রবেশ ঠেকানো হবে।
মৎস্য উপদেষ্টা স্বীকার করেন, গত জুনের মাঝামাঝি সময়ে জাটকা ইলিশ আহরণের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর বাজারে ইলিশের প্রাপ্যতা বাড়বে বলে আশা করা হলেও জুলাই ও আগস্ট মাসে ইলিশ আহরণ ২০২৪ সালের তুলনায় ৩৩ দশমিক ২০ ও ৪৭ দশমিক ৩১ শতাংশ কম হয়েছে।

