দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ হু হু করে বাড়ছে। এগুলো আদায়ে প্রতিষ্ঠানগুলো মামলা করেও খুব একটা সুফল পাচ্ছে না। কারণ যে পরিমাণ মামলা হচ্ছে, তার বিপরীতে নিষ্পত্তির হার খুবই কম। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত অর্থঋণ আদালতে মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ২২ হাজার ৩৪১টি। এসব মামলায় আটকে আছে চার লাখ সাত হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। তবে গত মার্চ পর্যন্ত দুই লাখ ১৯ হাজার ৬৩৩ মামলায় আটকে ছিল তিন লাখ ২০ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন বিভাগের এক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
গতকাল রোববার ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। এ সময় খেলাপি ঋণের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে ঋণ আদায় কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করতে ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
মূলত আগের মামলা নিষ্পত্তিতে গতি কমে যাওয়া এবং নতুন দায়েরের পরিমাণ বাড়ায় মামলার স্তূপ কমছে না। প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল-জুন সময়ে ১১ হাজার ৯৪৪টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর বিপরীতে অর্থ আদায় হয়েছে মাত্র দুই হাজার ৯১০ কোটি টাকা। অপরদিকে একই সময়ে নতুন করে খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলো ১৪ হাজার ৬৫২টি মামলা করেছে। এর বিপরীতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ৯৬ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা।
চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ তিন মাসে নিষ্পত্তি হওয়া মামলার সংখ্যা ১০ হাজার ৬৪টি এবং আদায়কৃত অর্থের পরিমাণ এক হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ মার্চ প্রান্তিকের তুলনায় জুন প্রান্তিকে এক হাজার ৮৮০টি মামলা বেশি নিষ্পত্তি হয়েছে এবং এক হাজার ৭৬ কোটি টাকা বেশি আদায় হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে বের করা ঋণ স্বাভাবিক নিয়মে আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। বারবার সুবিধা ও ছাড় দেওয়ার পরও এসব ঋণ ফেরত দিচ্ছেন না খেলাপিরা। আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে এসব ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা হলেও নিষ্পত্তি হচ্ছে খুবই কম।
ব্যাংকাররা বলছেন, প্রয়োজনের তুলনায় অর্থঋণ আদালতের সংখ্যা কম হওয়া, বিচারকের অভাব এবং আইনি মতামতের জন্য ব্যাংকের আইনজীবীকে পর্যাপ্ত সময় ও সহায়ক জামানতের পর্যাপ্ত দলিলাদি সরবরাহ করতে না পারায় অর্থঋণ আদালতে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব মামলায় বিপুল পরিমাণ আর্থিক সংশ্লিষ্টতা থাকায় ব্যাংক বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং দেশের অর্থনীতির ওপর সীমাহীন নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
সম্প্রতি খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোর লিগ্যাল টিম শক্তিশালী করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন নির্দেশনায় লিগ্যাল টিমে কর্মকর্তা ও প্যানেল আইনজীবী নিয়োগ এবং তাদের বার্ষিক মূল্যায়ন কীভাবে করতে হবে, সে সম্পর্কে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে জারি করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়, সামগ্রিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় আদায় কার্যক্রম সুসংহত করার ক্ষেত্রে ব্যাংকের আইন বিভাগের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংকিং সেক্টরে বিদ্যমান খেলাপি ঋণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অর্থঋণ আদালতে মামলাধীন।
অনেক খেলাপি ঋণের বিপরীতে ঋণগ্রহীতা সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ বা আপিল বিভাগে রিট পিটিশন দায়ের করেছেন। যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ব্যাংকের লিগ্যাল টিমকে আরো শক্তিশালী করা হলে বিচারাধীন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা যাবে। এতে একদিকে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায় হবে, অন্যদিকে ব্যাংকের আর্থিক সক্ষমতা বাড়বে।
গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছিল ছয় লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকায়, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। বর্তমান খেলাপি ঋণের এ হার দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

