আগামী সপ্তাহে চূড়ান্ত হতে পারে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) খসড়া নীতিমালা। চলতি সপ্তাহে স্টক এক্সচেঞ্জ, মার্চেন্ট ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশনসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের মতামত গ্রহণ করবে সংস্কার কমিটি। তাদের মতামতের পরই চূড়ান্ত খসড়া প্রস্তুত করে তা পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের কাছে হস্তান্তর করবে কমিটি।
সংস্কার কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে বলেন, চলতি সপ্তাহের মধ্যে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা শেষ করে আগামী সপ্তাহে আইপিও বিধিমালার খসড়া চূড়ান্ত হবে বলে আশা করছি।
কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, আইপিও খসড়ায় অডিটর ও ইস্যু ম্যানেজারকে জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে। যে প্রতিষ্ঠান যে কাজের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত, সে কাজের জন্য তার জবাবদিহি থাকবে। আগে একজন অপরের ওপর দায় চাপিয়ে দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা করত কিন্তু এখন প্রত্যেককে তার কাজের জন্য দায়িত্ব নিতে হবে। যদি কোনো কোম্পানির আর্থিক হিসাব বিবরণীতে কোনো ধরনের অনিয়ম থাকে, সেখানে শুধু অডিটরই নয়; কোম্পানির বোর্ডকে তার জন্য জবাবদিহির আওতায় আনার সুপারিশ থাকছে খসড়ায়। এ ছাড়া কোম্পানির শেয়ারের দর নির্ধারণ, লক-ইন, স্টক এক্সচেঞ্জর ক্ষমতাসহ অনেক বিষয় খসড়াবিধিতে সংযোজন করা হচ্ছে।
জানা গেছে, খসড়া বিধিমালায় কোনো কোম্পানির তালিকাভুক্তির আবেদন মূল্যায়ন করবে স্টক এক্সচেঞ্জ। আর্থিক বিবরণীসহ সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে কোম্পানির তালিকাভুক্তির বিষয়ে স্টক এক্সচেঞ্জ তাদের মূল্যায়ন বিএসইসি বরাবর প্রেরণ করবে। বিএসইসি তাদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে কোম্পানির তালিকাভুক্তির বিষয়ে চূড়ান্ত অনুমোদন দেবে। বিএসইসি কোনো কোম্পানির তালিকাভুক্তির বিষয়ে নিজ থেকে কোনো ধরনের আদেশ বা নির্দেশ দিতে পারবে না। শুধুমাত্র স্টক এক্সচেঞ্জর মূল্যায়নের ভিত্তিতে তালিকাভুক্তির অনুমোদন কিংবা অনুমোদন না দেওয়ার বিষয়ে কমিশন তার সিদ্ধান্ত জানাবে।
আইপিওতে আবেদনকারী কোম্পানির মূল্যায়নে স্টক এক্সচেঞ্জের ভূমিকার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী আমার দেশকে বলেন, কোনো কোম্পানি আইপিওর আবেদন জমা দিলে স্টক এক্সচেঞ্জ কোম্পানিটির আর্থিক বিবরণী পর্যালোচনা করে আইপিও অনুমোদনের বিষয়ে সুপারিশ করত। কিন্তু এম খায়রুল হোসেনের কমিশন স্টক এক্সচেঞ্জের সে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণমূলক মতামত দেওয়ার মধ্যে সীমিত করে দিয়েছিল। কিন্তু অনেক সময় দেখা গেছে, স্টক এক্সচেঞ্জ তার পর্যবেক্ষণ দেয়ার আগেই আইপিও অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে কমিশন। অনেক সময় স্টক এক্সচেঞ্জ কোনো কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করতে চায়নি কিন্তু বিএসইসি তার ক্ষমতাবলে নির্দেশ দিয়ে তালিকাভুক্ত করতে বাধ্য করেছে। আর এভাবে অনেক দুর্বল কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। নতুন আইপিও খসড়ায় স্টক এক্সচেঞ্জের আগের সে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে কোম্পানির শেয়ারের দর নির্ধারণেও বেশকিছু সুপারিশ থাকছে খসড়ায়। শেয়ারের সঠিক মূল্য নির্ধারণে বুকবিল্ডিং পদ্ধতি চালু হলেও বিভিন্ন কারণে ওই পদ্ধতির মাধ্যমে কারসাজির ঘটনা ঘটেছে। কারসাজি রোধ করে শেয়ারের সঠিক মূল্য নির্ধারণে বেশকিছু শর্ত থাকছে। তবে সেসব শর্তের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। তবে বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে বৈধ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রিতে ফের লক-ইন প্রথা চালু করার সুপারিশ থাকছে। বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রিতে কোনো লক-ইন নেই। তবে আগে লক-ইন প্রথা ছিল এবং ওই প্রথা পুনরায় বহাল করার সুপারিশ করা হয়েছে খসড়ায়। আগের বিধি অনুযায়ী, লেনদেন শুরুর দিন থেকে ৫০ শতাংশ শেয়ার বিক্রিতে কোনো লক-ইন থাকবে না। বাকি ২৫ শতাংশ শেয়ার লেনদেন শুরুর তিন মাস পর এবং বাকি ২৫ শতাংশ শেয়ার ছয় মাস পর বিক্রি করতে পারবেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা।
এ প্রসঙ্গে এক সদস্য জানান, লক-ইন না থাকার কারণে শেয়ারের দর কারসাজির মাধ্যমে বাড়ানোর একটি প্রবণতা দেখা যায়। এ ধরনের প্রবণতা রোধ করতেই আগের লক-ইন প্রথা ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমানে বুকবিল্ডিংয়ে তালিকাভুক্তির প্রথম তিন দিন শেয়ার বিক্রিতে কোনো সার্কিট নেই এবং সেটি বহাল রাখার সুপারিশ থাকছে খসড়ায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পুঁজিবাজারে কোম্পানির তালিকাভুক্তিতে অনেক অনিয়ম হয়েছে। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে যেমন অনেক দুর্বল কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে তেমনি বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতেও আইনের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে। বিশেষ করে গত দেড় দশকে অধ্যাপক এম খায়রুল হোসেন ও অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলামের আমলে দুর্বল কোম্পানির তালিকাভুক্তিতে বিএসইসি নানাভাবে হস্তক্ষেপ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির এক-চতুর্থাংশের বেশি কোম্পানি ‘জেড’ ক্যাটাগরিভুক্ত। তালিকাভুক্তির কয়েক বছরের ব্যবধানে বেশকিছু কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে কিংবা বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েছে। ওই সব কোম্পানির শেয়ার কাগুজে শেয়ারে পরিণত হয়েছে। এসব বিবেচনাকে গুরুত্ব দিয়ে আইপিও খসড়া তৈরি করছে সংস্কার কমিটি।
সংস্কার কমিটি গত ১০ ফেব্রুয়ারি মার্জিন লোন ও মিউচুয়াল ফান্ড নামে দুটি বিধিমালার খসড়া কমিশনে প্রস্তাব আকারে পেশ করে। প্রয়োজনীয় সংশোধনের নিমিত্তে অংশীজনদের মতামতের জন্য ওয়েবসাইটে খসড়া বিধিমালা দুটি প্রকাশ করেছে কমিশন। তাদের মতামতসাপেক্ষে কমিশন বিধিমালা দুটি চূড়ান্ত করবে।
উল্লেখ্য, গত বছরের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলামের পদত্যাগের পর খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বে বিএসইসি পুনর্গঠন করে সরকার। পুঁজিবাজারে কাঙ্ক্ষিত সংস্কারে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট টাস্কফোর্স গঠন করে কমিশন। কমিশনের সদস্যরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেএএম মাজেদুর রহমান, নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং-এর জ্যেষ্ঠ অংশীদার এএফএম নেসারউদ্দীন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিএসই বিভাগের অধ্যাপক মো. মোস্তফা আকবর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন।

