অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সভায় সিদ্ধান্ত

ছয় প্রকল্পে এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন

ইমদাদ হোসাইন
প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১: ২২

বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরতা দীর্ঘদিনের। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সহজ শর্তের (কনসেশনাল) ঋণের প্রবাহ কমে যাওয়ায় দেশকে ক্রমেই ঝুঁকতে হচ্ছে কঠিন শর্তের (নন-কনসেশনাল) ঋণের দিকে। এ প্রবণতার সাম্প্রতিক প্রতিফলন দেখা গেল গতকাল বুধবার অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অনমনীয় ঋণসংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভায়।

বিজ্ঞাপন

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে ওই সভায় মোট ছয়টি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য এক বিলিয়ন ডলারের বেশি নন-কনসেশনাল ঋণ নীতিগতভাবে অনুমোদন করা হয়। ইআরডির একাধিক কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

সূত্র জানায়, সভায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল—কীভাবে এই নন-কনসেশনাল ঋণগুলো আরো কম সুদে এবং দীর্ঘমেয়াদে পাওয়া যেতে পারে। কারণ, বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ইতোমধ্যে কনসেশনাল ঋণের সুযোগ সীমিত করে ফেলেছে, যা বাংলাদেশের মতো মধ্যম আয়ের পথে থাকা দেশের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করছে।

সবচেয়ে আলোচিত প্রকল্প ছিল ময়মনসিংহ বিভাগের পাঁচটি জলবায়ু সহনশীল সেতু নির্মাণের উদ্যোগ। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইএসডিবি) দেবে দুই হাজার ৮৫০ কোটি টাকা (প্রায় ২৩৩ মিলিয়ন ডলার)।

বৈঠকের নথি অনুযায়ী, এ ঋণের প্রায় পুরোটা কঠিন শর্তের। সেতুগুলো নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জ সীমান্তবর্তী দুর্গম এলাকায় নির্মাণ করা হবে। যেমন দুর্গাপুরের মহাদেব, গণেশ্বরী-৩, নিতল এবং সোমেশ্বরী-২ সেতু। এগুলো নির্মাণ করা হলে শুধু সড়ক যোগাযোগই উন্নত হবে না; বরং দুর্গাপুরের কৌশলগত সম্পদ বিজয়পুর সাদা মাটির (চীনা মাটি) বাণিজ্যিক ব্যবহারের পথও সুগম হবে। ২৫ লাখ টনের বেশি উচ্চমানের এই খনিজ মজুতকে কেন্দ্র করে নতুন শিল্প সম্ভাবনার দ্বার খুলে যেতে পারে।

এছাড়া ঢাকা ওয়াসার দুটি প্রকল্পের মধ্যে সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার (ফেজ-৩) প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংক (ইআইবি) এখান থেকে দেবে ১১ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা ঋণ। এর পুরোটাই কঠিন শর্তের। একই ভাবে ঢাকা এনভায়রনমেন্টালি সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রকল্পেও ইআইবি আরো ৯০ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে, যার পুরোটাই নন-কনসেশনাল। ফলে ওয়াসার দুটি বড় প্রকল্পেই বিদেশি তহবিল আসছে কঠিন শর্তে, যা ভবিষ্যতে পানির দামে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রেল খাতেও বড় অঙ্কের কঠিন শর্তের ঋণ আসছে। সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম-দোহাজারী মিটারগেজ রেলপথকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরের প্রকল্পে এডিবি দিচ্ছে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা বা ৫০০ মিলিয়ন ডলার। পুরো অর্থই নন-কনসেশনাল, যা দীর্ঘমেয়াদে রেলওয়ের আর্থিক সক্ষমতার জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

একই সংস্থা খুলনায় পানি সরবরাহের দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য ১৫০ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে, যার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ (৫০ মিলিয়ন ডলার) কঠিন শর্তের। এছাড়া উত্তরাঞ্চলের নেসকো এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়নে আরো ৯১ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে এডিবি।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ প্রবণতা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সতর্ক সংকেত। এখন পর্যন্ত সরকার সহজ শর্তের ঋণকে প্রাধান্য দিয়ে আসছিল। কিন্তু কনসেশনাল ঋণের উৎস সীমিত হয়ে যাওয়ায় উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ ধরে রাখতে সরকার বাধ্য হচ্ছে কঠিন ঋণের ফাঁদে পা রাখতে। এতে প্রকল্প ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে সুদ পরিশোধের চাপও বাড়বে, যা ভবিষ্যতে বাজেট ঘাটতি আরো তীব্র করতে পারে।

ইআরডির এক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, নন-কনসেশনাল ঋণ নেওয়ায় ঝুঁকি থাকলেও উন্নয়ন প্রকল্পের চাহিদা মেটানো ছাড়া সরকারের সামনে বিকল্প নেই। তিনি বলেন, কৌশলগতভাবে চেষ্টা হচ্ছে সুদ ও শর্ত কমিয়ে আনার। তবে পরিস্থিতি এমনই যে, সহজ শর্তের ঋণ পাওয়া দিনদিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত