দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ১৭টির মোট ঋণের ৫০ থেকে ৯৯ শতাংশই খেলাপি হয়ে গেছে, যা দেশের আর্থিক ব্যবস্থার জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর শেষে ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৫ থেকে ১০ শতাংশ, ১৩ ব্যাংকের ১০ থেকে ২০ শতাংশ এবং ছয় ব্যাংকের ২০ থেকে ৫০ শতাংশ।
ব্যাংকাররা বলছেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনেক ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার নামে লুটপাট হয়েছে। সে সময় এসব ঋণ খেলাপি হওয়ার যোগ্য হলেও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে তা শ্রেণিকরণ করা হয়নি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর খেলাপি ঋণ কম দেখানোর প্রবণতা বন্ধ হওয়ায় এখন ব্যাংক খাতের প্রকৃত চিত্র সামনে আসছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের রূপালী, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট, জনতা ও বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৫১ থেকে ৭৩ শতাংশে পৌঁছেছে। সেপ্টেম্বর শেষে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫১ দশমিক ১৯ শতাংশ। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এক হাজার ৯৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫২ দশমিক ৪৬ শতাংশ। একই সময় বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আট হাজার ৮১১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭০ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭৩ দশমিক ১৮ শতাংশ।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেসরকারি খাতের একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৫৬ থেকে ৯৬ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণের হার ইউনিয়ন ব্যাংকের। এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২৭ হাজার ১১৩ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৯৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের হার ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের, যেখানে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫৯ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা বা ৯৬ দশমিক ২০ শতাংশ। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৯৫ দশমিক ৭০ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৭০ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৫৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এক্সিম ব্যাংক ছিল বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের নিয়ন্ত্রণে এবং বাকি চারটি ছিল চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের কর্ণধার ও বহুল আলোচিত ব্যবসায়ী সাইফুল আলমের নিয়ন্ত্রণে। তারা দুজনই ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
ব্যাংক-সংশ্লিষ্টরা জানান, ওই সময়ে এসব ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে মালিকপক্ষ ঋণের নামে বিপুল অঙ্কের টাকা তুলে নেয়। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এসব ঋণ খেলাপি হিসেবে দেখানো হয়নি। সরকার পরিবর্তনের পর লুকিয়ে রাখা খেলাপিযোগ্য ঋণগুলো খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হলে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত আর্থিক অবস্থা প্রকাশ পায়। গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী আমানত ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকার এসব ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ পাঁচ হাজার ২২৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯৪ দশমিক ১৭ শতাংশ; আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬৩১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯১ দশমিক ৩৮ শতাংশ; এবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮৪ দশমিক ০৪ শতাংশ; ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩২ হাজার ৪০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ; বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এক হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭১ দশমিক ১১ শতাংশ; আইএফআইসি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২৭ হাজার ৫৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬০ দশমিক ৬৩ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ছয় হাজার ২৭৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫৮ দশমিক ২৪ শতাংশ। বিদেশি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি—৯৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ বা এক হাজার ৩৭০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশ। এক বছর আগে একই সময়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে তিন লাখ ৫৯ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা, অর্থাৎ দ্বিগুণেরও বেশি। দেশের মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে ১০টি ব্যাংকের চার লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের প্রায় ৭০ শতাংশ।
বিশ্লেষকদের মতে, খেলাপি ঋণের এই লাগামহীন বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতি, বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।

