হুমকিতে দেশীয় শিল্প

কসমেটিকস খাতে বছরে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার

অর্থনৈতিক রিপোর্টার
প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৬: ১৬
আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৮: ১৪

বাংলাদেশে কসমেটিকস ও স্কিন কেয়ার সামগ্রীর বার্ষিক বাজার প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই আসে আমদানিকৃত ফিনিশড গুডস থেকে। কিন্তু এই আমদানির পেছনে চলছে ভয়াবহ অনিয়ম—আন্ডার ইনভয়েসিং, ওজন গোপন এবং শুল্ক ফাঁকির মাধ্যমে প্রতিবছর হাজার কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কসমেটিকস খাত থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে মাত্র ৯৬ কোটি টাকা। অথচ বাস্তব হিসাবে এই অংক হওয়ার কথা ছিল অন্তত ৭০০ কোটি টাকার বেশি। যদি প্যাকেজিং উপকরণে শুল্ক আরোপ করা হতো, তবে এই রাজস্ব দেড় হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারত।

বিজ্ঞাপন

এনবিআরের আমদানি পরিসংখ্যান বলছে, চলতি অর্থবছরে প্রায় ২৫ লাখ টন কসমেটিকস পণ্য আমদানি করা হলেও, শুল্ক আদায় হয়েছে মাত্র ৬ লাখ ২৫ হাজার টনের ওপর—যা প্রকৃত আমদানির মাত্র ২৬ শতাংশ। এর বাইরে রয়েছে ব্যাপক আকারে আন্ডার ইনভয়েসিং, যেখানে প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই পণ্যের প্রকৃত মূল্য গোপন করে সর্বনিম্ন দামে ঘোষণা দিচ্ছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কিছু পণ্যের আমদানিমূল্য দেখানো হচ্ছে ৫০ থেকে ৭০ টাকা। অথচ সেই একই পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকার বেশি দামে। ফলে প্রতি ইউনিট পণ্যে সরকার হারাচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকার রাজস্ব। এই ফাঁকিগুলো পূর্ণ দামে ও পূর্ণ ওজনে হিসাব করলে কেবল এই খাত থেকেই হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ সম্ভব ছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই জালিয়াতির সুযোগ তৈরি করেছে শুল্কনীতির একটি ফাঁক। ২০১৭ সালে একটি আদেশে বলা হয়েছিল, প্যাকিং কনটেইনারকে শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে গণ্য করতে হবে। কিন্তু ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে এনবিআরের একটি আদেশে এই নির্দেশনা স্থগিত করা হয়। এরপর থেকে আমদানিকারকেরা শুধু ভেতরের উপাদানের ওপর শুল্ক দিয়ে পণ্য ছাড় করছে, যার ফলে সরকারের বিপুল রাজস্ব হারাতে হচ্ছে।

দেশীয় বাজারে বিদেশি প্রসাধন সামগ্রীর প্রাধান্য দিন দিন বেড়ে চলেছে। কিন্তু এসব পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছেন না দেশীয় উৎপাদকরা। কারণ বিদেশি পণ্য শুল্ক ফাঁকির কারণে বাজারে বিক্রি হয় তুলনামূলক কম দামে, অথচ স্থানীয় উৎপাদনে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্কসহ অন্যান্য খরচ বেশি পড়ে যায়। ফলে অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিযোগিতায় ঝুঁকিতে পড়েছে দেশীয় শিল্পখাত।

স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা বলছেন, নীতিগত বৈষম্য এবং শুল্ক ফাঁকির এই অনিয়ম বন্ধ না হলে স্থানীয় শিল্প পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়বে। বর্তমানে কসমেটিকস খাতে দেশীয়ভাবে যেসব পণ্য উৎপাদন হয় তার মধ্যে রয়েছে ঠোঁট, চোখ, হাত, পা ও ত্বকের প্রসাধন, সুগন্ধিযুক্ত বাথ সল্ট এবং অন্যান্য গোসল সামগ্রী। এসব উৎপাদনের কাঁচামালের প্রায় ৯০ শতাংশই আমদানি করতে হয়, যার ওপর আবার উচ্চ শুল্ক বিদ্যমান।

তথ্য অনুযায়ী, কিছু প্রতিষ্ঠানের আমদানিকৃত পণ্য ৩৫ টাকায় শুল্কায়িত হলেও বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়। এতে সরকারের প্রাপ্ত শুল্ক কমে যাচ্ছে এবং আমদানিকারকেরা অতিরিক্ত মুনাফা করছে ভোক্তার পকেট থেকে। একটি চালানেই সরকার হারাচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এভাবে শত শত চালানে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে কয়েক হাজার কোটি টাকায়।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে কেবল দুটি এইচএস কোড (৩৩০৪১০০০ এবং ৩৩০৪২০০০) এর আওতায় দেশে আমদানি হয়েছে প্রায় ১,৯১৫ টন পণ্য। কিন্তু ঘোষণায় দেখানো হয়েছে মাত্র ২৭৮ টন। আমদানিমূল্য দেখানো হয়েছে ৪৫ কোটি টাকা, যেখানে প্রকৃত মূল্য দাঁড়ায় কয়েকশ কোটি টাকা। ঘোষিত দামের ভিত্তিতে সরকার পেয়েছে ৬৫ কোটি টাকার মতো শুল্ক, অথচ পাওয়ার কথা ছিল ৪০০ কোটি টাকারও বেশি।

এই পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আমদানি নীতিমালায় পরিবর্তন না আনা হলে কসমেটিকস খাত আবার আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে দেশের সম্ভাবনাময় একটি শিল্প ধ্বংসের মুখে পড়বে।

অভিযোগ রয়েছে, নীতিনির্ধারকদের একাংশের রহস্যজনক ভূমিকা এবং সিদ্ধান্তহীনতা এই অনিয়মকে উৎসাহ দিচ্ছে। তারা বলছেন, যেখানে সরকার রাজস্ব আদায় বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে, সেখানে একটি বড় শিল্পখাত থেকে হাজার কোটি টাকা হারানো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

স্থানীয় উদ্যোক্তারা দীর্ঘদিন ধরে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে আসছেন। এই খাতে সুষ্ঠু ও ন্যায়সঙ্গত নীতির প্রয়োগ না হলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান—উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত