রাজধানীর হালচাল

ফুটপাত পুরোটাই দখল, পথচারীর ভরসা সড়ক

হকারদের ব্যবহার করা হয় রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে

মাহমুদুল হাসান আশিক
প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৪: ৫৭
আপডেট : ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৫: ০৩
রাজধানীর জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন ফুটপাতের পুরোটাই দখল নিয়েছে হকাররা। ছবি: আক্তার হোসেন

রাজধানীর ফুটপাতগুলো এখন আর পথচারীদের চলাচলের রাস্তা নয়, তা পরিণত হয়েছে হকারদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ফার্মগেট, গুলিস্তান, নিউ মার্কেট, মতিঝিল, পল্টন, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, উত্তরা, বাড্ডা, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ীসহ শহরের প্রায় প্রতিটি সড়কের ফুটপাতজুড়ে বসে নানা পণ্যের দোকান। ফলে সাধারণ মানুষের হাঁটার জায়গা থাকছে না, তারা হাঁটছে সড়কপথে, যেখানে চলার কথা যানবাহন। এতে সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ যানজট, দুর্ঘটনা ও বিশৃঙ্খলা। এতে মানুষের গুরুত্বপূর্ণ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে।

এই দখলদারির পেছনে রয়েছে কিছু রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়া। তবে তাদের পরিচয় স্পষ্ট করতে রাজি নয় কেউই। প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলো হকারদের কাছ থেকে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। যার পরিমাণ এককালীন ৩০ হাজার থেকে শুরু করে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। শুধু আর্থিক সুবিধাই নয়, মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশেও তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এ অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। আর এই দখলদারিত্ব নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ঘটেছে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাও।

বিজ্ঞাপন

সংসদ ভবনের সামনের সড়ক মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, সচিবালয়ের পাশ ঘেঁষে যাওয়া তোপখানা রোড থেকে শুরু করে সব গুরুত্বপূর্ণ সড়কের কোনোটিতেই এখন আর ফুটপাত নেই। মেডিকেল, বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি দাপ্তরিক গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো থেকে শুরু করে ফার্মগেট, গুলিস্তান, নিউ মার্কেট, মতিঝিল, মিরপুর, উত্তরা, বিমানবন্দর, বাড্ডা ও পল্টনসহ রাজধানীর কোনো এলাকাই এখন হকারমুক্ত নয়। সকাল-বিকাল ফুটপাত দখল করে রাখেন তারা। কেউ জামাকাপড়, কেউ ফলমূল, কেউ মোবাইলের এক্সেসরিজ বা খেলনা, কেউবা কসমেটিক্স বিক্রি করে থাকেন।

মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর সড়ক দিয়েই সংসদে প্রবেশ করেন দেশের শীর্ষ কর্তারা। সেখানে সরেজমিনে দেখা যায়, সড়কটির ফুটপাত হকারদের দখলে চলে গেছে। সে সঙ্গে সড়কটির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত চলছে ঘোড়ার গাড়ি ।

পথচারী মেহেদী মাহবুব বলেন, ফ্যাসিবাদীরা কী অবস্থা করে গেছে এবং কতটুকু সংস্কার হয়েছে তা বোঝার জন্য এই সড়কগুলোর দিকে তাকালেই হয়। এত গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো হকাররা দখলে নিয়েছে, যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

বিশ্বের আধুনিক শহরের মতো মহানগরীতে প্রথম দেড়শ ফুট চওড়া দৃষ্টিনন্দন সড়ক তৈরি করা হয় আগারগাঁওয়ে। যে সড়কের সঙ্গে আছে প্রশস্ত ফুটপাত, সাইকেল লেন, রোডসাইড গাড়ি পার্কিংয়ের মতো সুবিধা। ফুটপাতে আছে দেশি-বিদেশি নানা জাতের গাছ। এই এলাকাজুড়ে রয়েছে নির্বাচন কমিশন, পাসপোর্ট অফিস, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, সমাজসেবা, পরিসংখ্যান, প্রত্নতত্ত্ব, সরকারি কর্মকমিশন, বিজ্ঞান জাদুঘর, পরমাণু শক্তি কমিশন, বেতার ভবন ও জাতীয় গ্রন্থাগারসহ বহু সরকারি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর।

গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক এলাকাটির সড়কও রক্ষা পায়নি হকার ও দখলদারদের হাত থেকে। তা এখন পরিণত হয়েছে পিকনিক স্পটে। সড়কের ওপর বসানো হয়েছে সারি সারি দোকান। সাইকেল লেন, ফুটপাত ও পার্কিং জোনে বসানো হয়েছে চেয়ার-টেবিল। যে কারণে পথচারীরা হাঁটছেন মূল সড়কে, যেখানে চলাচল করার কথা যানবাহনের।

গত ২৩ সেপ্টেম্বর এ এলাকায় ফুটপাতে দোকান বসানো নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। প্রায় আধঘণ্টা ধরে চলা ওই সংঘর্ষে কয়েকজন আহত হন। পরদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় চা-দোকানি মো. বাবুল মারা যান।

পথচারী তৌফিকুল ইসলাম বলেন, এত সুন্দর সড়ক তৈরি করা হলো; এটিকেও দখলদার ও হকারদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেননি দায়িত্বরতরা। আমাদের ফুটপাতে হাঁটার জায়গা না পেয়ে নেমে আসতে হয় মূল সড়কে। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।

সচিবালয় দেশের প্রশাসনিক সদর দপ্তর। এই সদর দপ্তর ঘেঁষে যাওয়া সড়কটির নাম তোপখানা রোড। এই সড়কটির ফুটপাতেও রয়েছে বিভিন্ন দোকান। সড়কটি থেকে শুরু করে মতিঝিল হয়ে গুলিস্তান ও সদরঘাট পর্যন্ত প্রায় সবকটি সড়কের ফুটপাত হকারদের দখলে। সে সঙ্গে মূল সড়কের অংশও দখলে নিয়েছে তারা। যে কারণে সরকারি-বেসরকারি কাজে আসা বেশিরভাগ পথচারীর একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল সড়ক। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট, নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা। আর দুর্ঘটনার সম্ভাবনা তো রয়েছেই।

দেশের জনপ্রিয়, পরিকল্পিতভাবে তৈরি আদর্শ আবাসিক ও বাণিজ্যিক উপশহর এলাকা হিসেবে পরিচিত উত্তরা। এই এলাকাটির ফুটপাতগুলোও এখন আর দখলমুক্ত নেই। সরেজমিনে উত্তরায় গিয়ে দেখা যায়Ñরাজলক্ষ্মী, আজমপুর, হাউস বিল্ডিং, চৌরাস্তা ও আবদুল্লাহপুরসহ উত্তরার প্রায় সবকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের ফুটপাত হকারদের দখলে। শুধু তা-ই নয়, এ অঞ্চলে অবস্থিত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনের মূল সড়কের ফুটপাতও হকারদের দখলে।

উত্তরায় বসবাসকারী কামরুল হাসান দিনের কাজ শেষে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার সময় ফুটপাতে হাঁটার জায়গা পান না বলে জানিয়েছেন। আমার দেশকে তিনি বলেন, বাসায় ফিরতে অর্ধেক সময় নষ্ট হয় শুধু ফুটপাত ও সড়ক দখলের ফলে সৃষ্ট যানজটে। উত্তরার জ্যামের ৫০ শতাংশ হয় ফুটপাত কিংবা সড়ক দখল করে হকাররা দোকান করার কারণে। উত্তরার নাগরিকদের জীবনমান ঠিক রাখার জন্য যেকোনো মূল্যে হকারমুক্ত সড়ক করতে হবে। প্রশাসন মাঝে মাঝে হকার উচ্ছেদে উদ্যোগ নেয়; কিন্তু দু-একদিনের মধ্যেই আগের মতো হয়ে যায়। এর পেছনে শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত, যারা নিয়মিত চাঁদা গ্রহণ করে এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে দোকান বসতে দিয়ে থাকে।

রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় হকাররা বেপরোয়া। এতদিন আওয়ামী লীগ এ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল। বর্তমানে অন্যরা এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে।

হকাররা কীভাবে ফুটপাত দখলে নেয় এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে মুখ খুলতে চাচ্ছিলেন না অধিকাংশ হকার। তবে মিরপুরে সড়ক ও ফুটপাত দখলে নিয়ে জুতার দোকান দেওয়া মোহাম্মদ রমজান এবং নিউ মার্কেট ফুটপাতের ওপর কসমেটিকসের দোকানি কামরুল বলেন, আমরা এখানে অনেক বছর ধরে ব্যবসা করে করে খাই। বসার সময় কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে বসেছি। এরপর আওয়ামী লীগ আমলে প্রতিদিন পুলিশকে ৭০ টাকা, সপ্তাহে ১০০ টাকা; আর বিদ্যুৎ বিল ৩০ টাকা দিতাম। এখন তো কোনো সরকার নেই। এখন কাউকেই টাকা দিই না। তবে আওয়ামী লীগের সময় মোটামুটি মিছিল-সমাবেশে সব দোকান থেকেই এক-দুজন করে যেতাম। এখনো আমরা যাই। আমগোরে বড় ভাইয়েরা দেখে রাখে। তারা ডাকলে এখনো যাই। এখন বিএনপির ভাইয়েরা ডাকলেও যাই। কারণ, আমরা তো ব্যবসা করেই খেতে হবে। আবার যদি জামায়াতও ক্ষমতায় আসে, তখনো আমাদের ডাকলে যাব।

পরিচয় আড়াল করে এই প্রতিবেদক দোকান নেওয়ার কথা জানালে গুলিস্তান ফুটপাতে ব্যবসা করা এক তরুণের কাছে জানতে চাইলে সে বলে, এখানে কোনো জায়গা খালি নেই। এরপরও যদি কোনো খালি জায়গা পাওয়া যায়, তবে আপনি দুইভাবেই নিতে পারেন। এখানে ফুটপাত ভাড়াও হয়, বিক্রিও হয়। ভাড়া নিলে অ্যাডভান্স দেড় থেকে দুই লাখ টাকা লাগবে। আর যদি কেনেন, তাহলে জায়গা বুঝে পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা লাগবে। পরদিন পরিচয় জানিয়ে যোগাযোগ করলে তিনি এসব নিয়ে প্রতিবেদন না করার অনুরোধ করেন।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ আমার দেশকে বলেন, দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে উচ্ছেদ অভিযান নিয়মিত চললেও তা টেকসই হচ্ছে না । তার মতে, ফ্যাসিবাদী শক্তির পতনের পর এসব হাতবদল হয়েছে। স্থানীয় চাঁদাবাজ গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক আশ্রয়ের কারণে উচ্ছেদ অভিযান সফল হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না। আমাদের নিজস্ব বাহিনী নেই, জনবলও কম। একদিকে উচ্ছেদ করলে অন্যদিকে আবার বসে যায়। এ সময় হকারদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকায় বসার ব্যবস্থা, ফুডকোট, স্ট্রিট ভেন্ডিং জোন এবং ঢাকা হাটসহ নানা ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।

তিনি বলেন, মানুষকে ফুটপাতে হাঁটার অধিকার দিতে হবে। আবার যাদের জীবিকা ফুটপাতে, তাদেরও বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া আমার দেশকে বলেন, এ এলাকায় অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ এবং ফুটপাত উদ্ধারে ২০২৪-এর ৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিএসসিসি মোট ৮৬টি উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেছে। এতে মামলা, অর্থদণ্ড প্রদান ও গণবিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়।

হকারদের দৌরাত্ম্য কেন দিন দিন বাড়ছেÑএর উত্তর নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটির সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা, কর্মসংস্থান, বিভিন্ন পেশার প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, অভ্যন্তরীণ অভিবাসন, দলীয় রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মতো স্পর্শকাতর বিষয়াবলি জড়িত। তবে অনিয়ন্ত্রিত হকার পরিকল্পিত নগরায়ণ ও নাগরিক সুবিধাদি নিশ্চিতকরণে বড় বাধা।

ইতোমধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে সৌন্দর্য বর্ধনের অংশ হিসেবে উভয় পাশের ফুটপাত ও খালি জায়গায় ফ্লাওয়ার বেড, নান্দনিক নকশার বসার বেঞ্চ, ফাউন্টেন অবকাঠামো, বৃক্ষরোপণসহ ল্যান্ডস্কেপিং বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যেই আমরা একটি নান্দনিক ও স্বস্তিদায়ক ফুটপাত উপহার দিতে পারব। তবে ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে স্থানীয় নাগরিক সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা আরো বেশি প্রয়োজন বলে জানান তিনি।

সিটি করপোরেশন পরিচালিত উচ্ছেদ অভিযানের পর ফুটপাত রক্ষায় পুলিশ কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তা জানার জন্য ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমানকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদেবার্তায় প্রশ্ন পাঠালেও তিনি কোনো জবাব দেননি।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত