শেখ হাসিনার দুঃশাসনে গুম, খুন ও ক্রসফায়ার ছিল নিয়মিত ঘটনা। এর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী ছিলেন দক্ষিণ-পশ্চিমের সাতক্ষীরা-খুলনা অঞ্চলের মানুষ। ক্রসফায়ারের মাধ্যমে এ অঞ্চলের অর্ধশত মানুষকে হত্যা করা হয়।
৬০ হাজার নিরপরাধ মানুষকে আসামি করা হয় ৯৭৮ হয়রানিমূলক মামলায়। এছাড়াও নির্যাতনের বহু কায়দা ছিল বিরোধীদের দমনে। এর মধ্যে একটি ছিল টার্গেট নিক্যাপিং বা হাঁটুতে আঘাতের মাধ্যমে পঙ্গু করে দেওয়া। এর মাধ্যমে চিরপঙ্গু করে দেওয়া হয় ওই অঞ্চলের কয়েকশ তরুণকে, যাদের মধ্যে এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ৮৫ জনকে শনাক্ত করতে পেরেছে।
বিরোধী মত দমনে ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে শেখ হাসিনার নির্দেশে পুলিশ ও র্যাব এসব ভয়াবহ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে ভয়াবহ এ তথ্য উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও এ-সম্পর্কিত অনেকগুলো অভিযোগ জমা পড়েছে। তবে যারা এসব গর্হিত কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন, তারা এখনো রয়ে গেছেন অধরা।
অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এসব মিশনের মূল হোতা ছিলেন সাতক্ষীরার তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সদ্যসাবেক সচিব ও সাতক্ষীরার সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) নাজমুল আহসান এবং সাতক্ষীরা সরকারি হাসপাতালের তৎকালীন সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম। এর মধ্যে ডা. জাহাঙ্গীর কথিত বন্দুকযুদ্ধের নাটকের পর ভুক্তভোগীদের পরিকল্পিতভাবে নিক্যাপিং করতে পুলিশকে সহায়তা করতেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত এসব সরকারি কর্মকর্তা এখনো অধরাই রয়ে গেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাতক্ষীরার সাবেক এসপি মঞ্জুরুলকে জুলাই বিপ্লবের পর গ্রেপ্তার বা শাস্তি না দিয়ে শুরু বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়, তাও একটি প্রমোশন দিয়ে। অবসরে পাঠানোর আগে তিনি অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক হিসেবে পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার নোয়াখালীতে কর্মরত ছিলেন। ২০২৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর তাকে অবসরে পাঠানো হয়। সাবেক ডিসি নাজমুল পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে গত ১৭ আগস্ট অবসরে যান। তাদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ধরনের আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
নিক্যাপিং নাটকে পঙ্গু বহু যুবক
বিরোধী মত দমনে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরিতে ভয়াবহ সহিংস পদ্ধতি নিক্যাপিং চালু করে আওয়ামী লীগ। বিচারবহির্ভূত এই অপরাধের মাধ্যমে কারো হাঁটুতে বা হাঁটুর নিচে কিংবা আশপাশে পরিকল্পিতভাবে গুলি এবং আঘাত করে তাকে চিরপঙ্গু করে দেওয়া হতো।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, নিক্যাপিংয়ের মাধ্যমে পঙ্গু করে দেওয়া খুলনা-সাতক্ষীরা অঞ্চলের ৮৫ জনকে এ পর্যন্ত শনাক্ত করা গেছে। তদন্ত চলমান। ধারণা করা হচ্ছে, পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষে এ ধরনের নির্যাতনে পঙ্গুত্ব বরণ করা ভুক্তভোগীর সংখ্যা কয়েকশ হতে পারে।
অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যমতে, পুলিশ-র্যাবের নিক্যাপিং নাটকে সাতক্ষীরা-খুলনা অঞ্চলের পঙ্গু যুবকরা বর্তমানে পরিবারের বোঝা হয়ে বেঁচে আছেন। এসব নাটক মঞ্চস্থ করতে জামায়াত-শিবির কিংবা বিএনপি-ছাত্রদলের কাউকে কাউকে কখনো বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হতো। অনেককে আবার জনসম্মুখে জোর করে আটক করে নেওয়া হতো থানায়। আবার কাউকে আটকের পর তুলে দেওয়া হতো সাদা পোশাকধারীদের কাছে। থানায় নেওয়ার পর তাদের ওপর চলত অমানবিক নির্যাতন। পরে চোখ ও হাত-পা বেঁধে পুলিশের গাড়িতে করে মধ্যরাতে নেওয়া হতো ফাঁকা জায়গায়। নির্জন স্থানে নিয়ে পুলিশ সদস্যরাই ফাঁকা গুলি ছুড়ত। তার আগে কারো পা অবশ করতে বিশেষ ধরনের স্প্রে ব্যবহার করা হতো। এরপর ঠান্ডামাথায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে হাঁটুতে বা পায়ে গুলি করা হতো। এভাবে কখনো কখনো কয়েক ঘণ্টা থানা বা নির্জন জায়গায় ফেলে রাখা হতো। দীর্ঘ সময় এভাবে ফেলে রাখার পর ভুক্তভোগীদের হাসপাতালে নেওয়ার পর শুরু হতো আরেক ‘শাস্তি’। দ্রুত কোনো প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না দিয়ে ভয়াবহ রক্তক্ষরণ হওয়ার পর এমন পরিস্থিতি করা হতো, যেন পা কেটে পঙ্গুত্ববরণ করতে হয়।
নাশকতা দমনের নামে পরিকল্পিত নাটকে ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবারগুলোর জবানে বেরিয়ে এসেছে ভয়াবহ এসব চিত্র। তাদেরই একজন সাতক্ষীরার শিবির নেতা শামছুল আলম (বুলবুল)। পুলিশের টার্গেট কিলিং থেকে বেঁচে যাওয়ায় তাকে স্থানীয়রা ‘জীবন্ত শহীদ’ বলে ডাকেন। আমার দেশ-এর কাছে তিনি পুলিশের দ্বারা ভয়াবহ নির্যাতনের তথ্য তুলে ধরেন।
বুলবুল বলেন, ২০১৪ সালের ৩০ আগস্ট রাত সাড়ে ১২টার দিকে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নের গাজনা গ্রামের দাউদ আলী সানার বাসা থেকে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই রাতে আমাকে গ্রেপ্তার করে হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে পুলিশের গাড়িতে উঠিয়ে কলারোয়া থানায় নেওয়া হয়। রাত ২টার দিকে টর্চার রুমে নিয়ে পাঁচ-ছয়জন পুলিশ অফিসার মোটা লোহার রড দিয়ে আড়াই ঘণ্টার বেশি দুই পায়ের হাঁটু, কোমর, নিতম্ব ও পায়ের তালুতে মারতে থাকে। প্রথমে দাঁড়ানো অবস্থায় ৩০-৪০ মিনিট মারার পর আমি ফ্লোরে পড়ে যাই। এ অবস্থায় দীর্ঘক্ষণ মারার পর আবার কাঠের হাতলওয়ালা চেয়ারে বসিয়ে মুখের ভেতর গামছা দিয়ে হ্যান্ডকাফ লাগানো দুই হাত একজন পেছনে টেনে ধরে আর অন্যরা দুই পায়ের হাঁটুর উপরে মারতে থাকে।
তিনি আরো বলেন, এভাবে মারতে মারতে যখন সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন আমার দুই পায়ের হাঁটুর জয়েন্ট এবং এর উপর-নিচে ১০-১২ ইঞ্চি হাড় ভেঙে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়। রাত শেষ হওয়ার আগে তারা নির্যাতন বন্ধ করে গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে পুলিশ ভ্যানে উঠিয়ে মুরারিকাটি পাওয়ার হাউসে ঢোকার মুখে ঘাসের ওপর চিত করে শুইয়ে ভেঙে টুকরা টুকরা হওয়া দুই হাঁটুতে শটগান ঠেকিয়ে গুলি করে। ভাঙাচোরা হাড়ে গুলি করায় আমার ডান পায়ের প্যাটেলা টুকরা টুকরা হয়ে দুই-তৃতীয়াংশ, হাঁটুর উপরে পাঁচ-ছয় ইঞ্চি হাড় এবং মাসল বের হয়ে যায় এবং বাম পায়ের হাঁটুর জয়েন্ট ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে প্যাটেলাসহ হাড় এবং মাসল নিয়ে চলে যায়। এ অবস্থায় আমাকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ চিকিৎসা না দিয়ে পরিকল্পিতভবে ফেলে রাখা হয়। ফলে রক্তক্ষরণে মারা যাওয়ার মতো অবস্থা হলে দুই পা কেটে ফেলার সব বন্দোবস্ত করা হয়।
ভুক্তভোগীদের আরেকজন সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার আব্দুর রউফ। ২০১৩ সালে তিনি ইউনিয়ন বিএনপির ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। নাশকতার অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। পরে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে তার পায়ে গুলি করে। সেই থেকে পঙ্গু জীবনযাপন করছেন তিনি। এক পায়ে ভর করে কোনোরকম দিন চলছে তার।
ভয়াবহ ওই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আব্দুর রউফ বলেন, ওই দিন মধ্যরাতে আমাকে বাড়ি থেকে তুলে নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ট্রাকে করে নেওয়া হয় স্থানীয় সখিপুর কলেজ মাঠে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাঁটুর নিচে গুলি করে পুলিশ। আমার নামে আগে কোনো মামলা ছিল না। বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত থাকার কারণে পরিকল্পিতভাবে ধরে নিয়ে গুলি করে।
ভয়ার্ত ওই পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, হাসপাতালে নেওয়ার পর পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাইনি। প্রথমে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে বলা হয় চিকিৎসা না দেওয়ার নির্দেশনা আছে। এভাবে তিনদিন ফেলে রাখার পর অনুরোধ করলে খুলনায় পাঠায়। ওখানেও একই কথা বলা হয়। এভাবে কোনোরকম চিকিৎসা দিয়ে ১৬ দিনের মতো পার করে দেওয়া হয়। ওই সময়ে পা পচে গন্ধ বের হচ্ছিল। পরে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হলে পা কেটে ফেলা হয়। সময়মতো চিকিৎসা পেলে হয়তো পা কেটে ফেলা লাগত না।
এ ঘটনার পর উল্টো বিএনপি-জামায়াতের ছয়জনের নামোল্লেখ করে অজ্ঞাত এক থেকে দেড় হাজারজনকে আসামি করে মামলা করেন দেবহাটা থানার তৎকালীন এসআই বছির উদ্দীন। অভিযোগে বলা হয়, বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা আগ্নেয়াস্ত্র, ককটেল, লাঠিসোঁটা ও দা নিয়ে যৌথবাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। আত্মরক্ষায় পাল্টা গুলি ছোড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দুষ্কৃতকারীদের গুলিতে দুজন গুলিবিদ্ধ হন। এছাড়া দুষ্কৃতকারীদের ঘটানো বিস্ফোরণে আরো দুজন মারা যান।
সেদিন আব্দুর রউফের ভাগনে তৎকালীন ছাত্রদল নেতা রিয়াজুল ইসলামকেও তুলে নিয়ে হাঁটুর নিচে গুলি করা হয়। ওই ঘটনায় রিয়াজুলও স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে চিরপঙ্গু হন। রিয়াজুল বলেন, ২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত আমার বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ার কারণে সাজানো বন্দুকযুদ্ধে আমি নিক্যাপিংয়ের শিকার হই। পায়ে গুলি করার পর থেকে সেটি এখন অকেজো।
ওই ঘটনায় পুলিশের করা সাজানো মামলায় মোট সাক্ষী করা হয় ২৮ জনকে। এদের মধ্যে নিরপেক্ষ তিনজন, বাকি সাক্ষী পুলিশ ও চিকিৎসক। মামলার নিরপেক্ষ সাক্ষীরা জানান, মনগড়া কথা লিখে শুধু সই নেওয়া হয়। ঘটনা সম্পর্কে কিছু না জানলেও তাদের সাক্ষী করা হয়। পুলিশের এজাহার ও তদন্ত প্রতিবেদনেও রয়েছে গরমিল। পুলিশের এজাহারে দুজনের মৃত্যু ও দুজন গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা বলা হলেও তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সেদিন হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
নিক্যাপিংয়ের শিকার দেবহাটা উপজেলার গড়ানবাড়িয়া এলাকার রুহুল আমীনের ঘটনাও একই রকম। রুহুল আমিনের এক পা কেড়ে নেয়া হয় কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ নামে নাটক সাজিয়ে। এক সময় এলাকায় তিনি ভালো ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিতি ছিলেন। ২০১৫ সালের ২৫ জুলাই সন্ধ্যার পর তিনি বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। হঠাৎ বাড়ি ঘিরে ফেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাকে জোর করে থানায় নেওয়া হয়। থানায় বেঁধে তার ওপর চলে নির্মম নির্যাতন। পরে রাতে অজ্ঞাত স্থানে নেওয়া হয়। একপর্যায়ে সেখানে ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। এরপর পায়ে গুলি করে ফেলে রাখা হয়।
রুহুল বলেন, তখন মনে হয়েছিল পুলিশ আমাকে মেরে ফেলবে। পরে হাসপাতালে নেওয়ার সময় আমি পানি চাই। একটু পানি খাওয়ার পর কিছুটা জ্ঞান ফিরলে বলে, ‘এ তো শুয়োরের জান, এতক্ষণ তো মরে যাওয়ার কথা।’ হাসপাতালে নেওয়ার পর ঠিকমতো চিকিৎসা দেওয়া হয় না। বলেÑনির্দেশনা আছে, পা কেটে ফেলতে হবে। পরে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে পা কেটে ফেলে। টার্গেট ছিল মেরে ফেলার। পরে যখন বেঁচে যাই তখন পঙ্গু করে দেয়, যেন ভবিষ্যতে দাঁড়াতে না পারি।
তৎকালীন সরকারি দলের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের দমনে পুলিশ এতটাই বেপরোয়া ছিল যে, পায়ে গুলি করার পর হাসপাতালে নেওয়া হলেও তাদের যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। ফলে অনেকের পা কেটে ফেলা হয় এবং এগুলো করা হয় পরিকল্পিতভাবে।
পরে রুহুলের ঘটনায় দেবহাটা থানার তৎকালীন এসআই মনিরুল ইসলাম একটি মামলা করেন। এজাহারে বলা হয়, ঘোনাপাড়া এলাকায় জাকির মেম্বারের হ্যাচারির সামনে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা গোপন মিটিং করছিল। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে গুলি ও বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় তারা। সেখানে ১০-১২ মিনিট গোলাগুলির পর রুহুল আমীনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
মামলার সাক্ষী করা হয় স্থানীয় শামসুর রহমান গাজীকে। তিনি বলেন, আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত। ঘটনার কিছুই জানি না। পুলিশ রাত ৩টার দিকে ডেকে ঘটনাস্থলে নিয়ে যায়। ওখানে কোনো জিহাদি বই বা আসামিদের সঙ্গে পুলিশের গোলাগুলি দেখিনি। শুধু একজনকে গুলিবিদ্ধ দেখেছিলাম।
স্থানীয়রা জানান, রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য রুহুল আমিনকে গুলি করে পঙ্গু করার পর সেটি ধামাচাপা দেওয়ার এ কৌশল ধোপে টিকবে না জেনেও পুলিশ মিথ্যা নাটক সাজায়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, মামলায় নিরপেক্ষ সাক্ষীর ১০ জনই স্থানীয় আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা, যাদের অনেকেই এখন পলাতক।
ভুক্তভোগী পরিবার এবং নির্যাতনের শিকার অনেকে জানান, ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে থেকে শুরু হওয়া এ ঘটনাগুলো এতটাই ব্যাপক আকার ধারণ করে যে, সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে এক ধরনের ত্রাসের রাজত্ব চলছিল।
তদন্ত সংস্থার অনুসন্ধান সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালে শুধু সাতক্ষীরা জেলায়ই শতাধিক বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। এসব বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় পা হারানোর ঘটনা অন্তত অর্ধশতাধিক, যাদের টার্গেট করে পায়ে গুলি করা হতো এবং পরে হাসপাতালে নেওয়া হলেও যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হতো না। পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং প্রশাসনের যোগসাজশে ঘটানো হতো এসব নৃশংস ঘটনা। আরো ভয়াবহ বিষয় হলো, সে সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি করার আগে পা অবশ করার জন্য বিশেষ ধরনের স্প্রে ব্যবহার করত, যেগুলো প্রশাসনিকভাবে সরবরাহ করা হতো।
২০১৫ সালে সংঘটিত আরেক ঘটনার ভুক্তভোগী হলেন আব্দুল মজিদ সরদার। ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত মজিদ বলেন, ২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তারের পর আমাকে অজ্ঞাত স্থানে নেওয়া হয়। ওই দিন রাতেই একটি মাইক্রোবাসে কয়েকজন সাদা পোশাকধারীর হাতে আমাকে তুলে দেয় শার্শা থানা পুলিশ। পরে কলারোয়ার কাজীরহাট কলেজের পাশে নিয়ে পায়ে গুলি করে। সেদিন প্রথমে চোখ ও হাত বাঁধে, এরপর গাড়ি থেকে নামায়। পরে পায়ে এক ধরনের স্প্রে করে। একটু পরেই ফাঁকা গুলি, মাটিতে গুলি করে বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজায় এবং একপর্যায়ে পায়ে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে গুলি করে।
আরেকটি ঘটনায় ২০১৬ সালের ৩ আগস্ট যশোরের চৌগাছা থানার দুই শিবির নেতাকে আটক করা হয়। কিন্তু সে সময় তাদের গ্রেপ্তার না দেখিয়ে থানায় আটক করে পরদিন ৪ আগস্ট পরিকল্পিতভাবে দুই হাঁটুতে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে মারাত্মক আহত করা হয়। ‘বন্দুকযুদ্ধে’ গুলিবিদ্ধ হয়েছে এবং সে কারণে তারা আহত হয়েছে উল্লেখ করে পরে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। পরে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসার নামে প্রেরণ করা হলেও যথাযথ চিকিৎসা না দিয়ে পঙ্গু করে পা কেটে ফেলতে বাধ্য করা হয়।
জুলাই বিপ্লবের পর ভুক্তভোগীদের অনেকেই ন্যায়বিচারের জন্য সোচ্চার হন। এসব ঘটনায় জড়িত জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার মঞ্জুরুল, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শামীম হাসান, হোসাইন শওকত ও ইকবাল হোসেনসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন তারা।
এ বিষয়ে গুম কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী নাবিলা ইদ্রিস আমার দেশকে বলেন, বিগত সময়ে নিক্যাপিং, গুমসহ বিচারবহির্ভূত যেসব ঘটনা ঘটানো হয়েছে, ওই সব ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনা উচিত। এ বিষয়ে আমরা সোচ্চার রয়েছি। আর আইনগত কিছু বিষয়ের কারণে গুম কমিশন এখন শুধু গুমের বিষয় নিয়ে কাজ করছে।
নাবিলা ইদ্রিস আরো বলেন, আমরা সে সময়কার অনেক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি। অনেককে তখন কথিত ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা হয়, অনেকের পায়ে গুলি করে চিরপঙ্গু করে দেওয়া হয়। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি তখন অনেক সাধারণ মানুষের ওপরও নৃশংসতা করা হয়েছে। ওই সব ঘটনায় জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা উচিত।
নিক্যাপিংয়ের মতো ভয়াবহ টার্গেটেট নৃশংসতা প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বহু নিক্যাপিং ও ক্রসফায়ারের অভিযোগ আমরা পাচ্ছি। আমাদের তদন্ত সংস্থা অভিযোগগুলো গুরুত্বসহকারে তদন্ত করছে এবং এ-সংক্রান্ত মামলার অগ্রগতি আপনারা শিগগির দেখতে পাবেন। নিক্যাপিংয়ে পঙ্গু করার পাশাপাশি কথিত বন্দুকযুদ্ধে খুন, অনেকের বাড়িঘরে আগুন, বুলডোজার দিয়ে বাড়ি ভাঙাসহ নানা স্পর্শকাতর অভিযোগও আছে। এ মামলাগুলো ট্রাইব্যুনাল আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে বিচার কার্যক্রম শুরু করবে।

