বহুমুখী সংকটে সরকারি চার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ

রকীবুল হক
প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৫, ১৪: ২৯

দীর্ঘদিন ধরে বহুমুখী সংকটে চলছে দেশের সরকারি চার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। উন্নত শিক্ষার আশায় এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভর্তি হলেও বিভিন্ন সমস্যার কারণে পুরো সুফল মিলছে না। শিক্ষক সংকট, স্থায়ী অধ্যক্ষ নিয়োগ না দেওয়া, ফলাফল জট, গবেষণাবান্ধব পরিবেশের অভাবসহ নানা সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে বিরাজ করলেও কার্যকর কোনো সমাধান পাননি শিক্ষার্থীরা। এসব সমস্যা সমাধানে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি বিগত আওয়ামী সরকার।

বিজ্ঞাপন

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (বিআইটি) মডেলে একটি নতুন, স্বাধীন, টেকসই ও সময়োপযোগী স্বতন্ত্র কমিশন করে স্থায়ী সমাধান দাবিতে গত আড়াই মাসের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করছে চার কলেজের শিক্ষার্থীরা। ক্লাস বর্জনসহ নানা কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় ঢাকায় অবস্থানও করেছেন তারা। একপর্যায়ে গত ২৯ জুলাই আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি ও কলেজ অধ্যক্ষদের সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের পক্ষ থেকে বেশকিছু দাবি পূরণের আশ্বাস দেওয়া হয়। তবে তাতে শিক্ষার্থীরা আশ্বস্ত না হয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। পরে ৩১ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারকে দাবি পূরণে ১০ দিনের আলটিমেটাম দেন। একই সঙ্গে কলেজগুলোতে ক্লাস বর্জনও অব্যাহত রয়েছে। এতে শিক্ষা কার্যক্রমে চরম অচলাবস্থা বিরাজ করছে।

জানা গেছে, আলটিমেটাম শেষে আজ রোববার ফের ঢাকায় অবস্থান কর্মসূচিতে নামবেন শিক্ষার্থীরা। পরবর্তী সময়ে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরণ অনশনের ঘোষণা দেওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

এদিকে সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছে ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ বিভিন্ন সংগঠন।

গত শুক্রবার ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জেনারেল নূরুল ইসলাম সাদ্দাম এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, দেশের বিভিন্ন সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন এবং একাডেমিক শাটডাউনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, তা প্রকৌশল শিক্ষার দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও অব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি ন্যায়সংগত প্রতিবাদ। আমরা এই ন্যায্য আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করছি এবং শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিসমূহ দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

আন্দোলনে শিক্ষা কার্যক্রমে অচলাবস্থার কথা জানিয়ে ফরিদপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আলমগীর হোসেন আমার দেশকে বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো নিয়ে সরকারের সঙ্গে মিটিং হয়েছে। অনেকগুলো দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়েছে সরকার। তবে সব দাবি না মানায় শিক্ষার্থীরা এখনো ক্লাসে আসছেন না। তিনি বলেন, যেহেতু অনেকগুলো দাবি মেনে নিয়েছে, আমরা তাদের বোঝাচ্ছি ক্লাসে ফিরে আসতে। আশাকরি শিগগিরই সমাধান হয়ে যাবে।

আন্দোলন বিষয়ে বরিশাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ শিক্ষার্থী ধ্রুব জানান, আমরা গত ৮০ দিন যাবৎ ক্লাস পরীক্ষা বর্জনসহ একাডেমিক ও প্রশাসনিক শাটডাউন পালন করে আসছি। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে ১৮ বছর ধরে চলে আসা বৈষম্য ও সংকট নিরসনের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রত্যেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সচিবদের সঙ্গে আমাদের কয়েকদফা মিটিংয়ের পরও কোনো সমাধান হয়নি। গত ২৯ জুলাইয়ের মিটিংয়ে যেসব দাবি পূরণের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, তারও কোনো অগ্রগতি নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে রোববার (আজ) সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত আমরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করব। এরপর আগের ঘোষণা অনুযায়ী বেলা ১১টা থেকে প্রেস ক্লাবের সামনে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করব।

এ বিষয়ে শিক্ষা উপদেষ্টার একান্ত সচিব (উপসচিব) একেএম তাজকির-উজ-জানান, আবাসন, অ্যাম্বুলেন্স সুবিধাসহ শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিগুলো পূরণের আশ্বাস দিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা। শিক্ষক সংকট কাটাতেও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে তারা বিআইটির আদলে করার দাবিতে অনড়, যা পলিসিগত ও সময়সাপেক্ষ বিষয়। এ মুহূর্তে বর্তমান সরকারের পক্ষে তা পূরণ করা সম্ভব নয় বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে।

সূত্রমতে, দেশের প্রকৌশল শিক্ষার উন্নয়নে বিভিন্ন সময়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রতিষ্ঠিত হয় ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশাল ও সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। আধুনিক তিনটি বিভাগে প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে এই চার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।

২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত ফরিদপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ২০১৩ সাল থেকে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজটি ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। বরিশাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠা হয় ২০১৮ সালে। সিলেট ছাড়া বাকি তিনটি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত।

সূত্রমতে, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে প্রতি সেশনে তিনটি ডিপার্টমেন্টে ৬০টি করে আসন। অর্থাৎ প্রতি সেশনে ১৮০টি আসন। বরিশাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে দুটি ডিপার্টমেন্টে ৬০টি করে ১২০টি আসন। সেখানে বাকি একটি ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠার আট বছরেও শিক্ষক নিয়োগ না হওয়ায় চালুই হয়নি।

চার কলেজের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে আন্দোলনকারীরা জানান, দীর্ঘ ১৮ বছরেও একজন স্থায়ী অধ্যক্ষ নিয়োগ হয়নি। অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা অধ্যক্ষরা নীতিগত ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম, ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনেকটা অভিভাবকহীন অবস্থায় চলছে। শিক্ষক নিয়োগে দীর্ঘসূত্রতা ও জটিলতায় এসব পদ দীর্ঘদিন ফাঁকা রয়েছে।

সূত্রমতে, বরিশাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সিভিল বিভাগে রয়েছেন মাত্র একজন শিক্ষক (প্রভাষক)। অথচ পূর্ণাঙ্গ বিভাগ চালাতে প্রয়োজন কমপক্ষে ৮-১০ জন শিক্ষক। তাছাড়া চারটি কলেজে অধ্যাপক আছেন মাত্র দুজন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চরম সেশনজট ও পরীক্ষায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা বলেন, ফলাফল প্রকাশে ছয়-সাত মাস বিলম্ব, অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নপত্র, মূল্যায়নে অস্বচ্ছতা—এসব কারণে শিক্ষার্থীদের জীবন, উচ্চশিক্ষা ও চাকরির প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

তারা জানান, প্রকৌশল কলেজগুলোতে আউটকাম বেজড এডুকেশন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা মানসম্মত ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়া আইবির স্বীকৃতি না পাওয়ায় স্নাতকরা ইঞ্জিনিয়ার পদবি ব্যবহার ও চাকরির ক্ষেত্রে ন্যায্য সুযোগ হারাচ্ছেন, যা পেশাগত ভবিষ্যতের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা।

আন্দোলনকারীরা জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাস্তবসম্মত এবং কাঠামোগত সমাধান একটাই তাহলো, বিআইটি মডেলের একটি স্বাধীন কমিশন। কারণ বিআইটি কাঠামো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজস্ব একাডেমিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা দেয়, যেখানে একাধিক দপ্তর ও কর্তৃপক্ষের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করতে হয় না।

তারা আরো জানান, এ মডেলেই প্রকৌশল শিক্ষা ছিল দক্ষ, স্বশাসিত এবং জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃত। এতে আমাদের সমস্যাগুলোর মূল অবকাঠামোগত সমাধান দিতে পারে। তাই ঢাবি অধিভুক্তি বাতিল করে বিআইটি মডেল অনুসরণে একটি নতুন, স্বাধীন, টেকসই ও সময়োপযোগী স্বতন্ত্র কমিশন করে একটি স্থায়ী সমাধান চান তারা। যাতে চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের একাডেমিক ও প্রশাসনিক স্বাতন্ত্র্যতা নিশ্চিত করবে বলে তাদের প্রত্যাশা।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত