আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

মাওলানা ভাসানী ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করেননি

প্রতিনিধি, ঢাবি

মাওলানা ভাসানী ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করেননি

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ক্ষমতা অর্জনের জন্য রাজনীতি করেননি। তিনি কখনো মন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রদূত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেননি। বরং আজীবন মেহনতি মানুষের পাশে থেকে তাদের মুক্তির সংগ্রামের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন বলে মন্তব্য করেছেন প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

মঙ্গলবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে ‘বি-উপনিবেশায়ন ও মওলানা ভাসানী’ শীর্ষক দুইদিন ব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সমাপনী বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন আর্টস অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেস (কারাস)-এর আয়োজনে দুই দিনব্যাপী এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার। এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন অধ্যাপক আহমেদ কামাল। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইউনিভার্সিটি ব্রুনাই দারুসসালাম-এর সহযোগী অধ্যাপক ড. ইফতেখার ইকবাল। স্বাগত বক্তব্য দেন কারাস-এর পরিচালক অধ্যাপক ড. আশফাক হোসেন।

বক্তব্যে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মওলানা ভাসানীকে একজন প্রকৃত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, বর্তমানে আমরা যে বি-উপনিবেশায়নের আলোচনা করছি, ভাসানীর রাজনৈতিক চেতনার মধ্যে তার বিশ্বাস শুরু থেকেই বিদ্যমান ছিল।

উপমহাদেশে বহু খ্যাতিমান রাজনৈতিক নেতার জন্ম হলেও ভাসানী সে অর্থে প্রতিষ্ঠিত খ্যাতি পাননি। তবে তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র ও অসাধারণ এক রাজনৈতিক চরিত্র।

তিনি বলেন, ভাসানীর মতো মেহনতি মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে রাজনীতি করার দৃষ্টান্ত এই উপমহাদেশে দ্বিতীয়টি নেই। তিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে বিশ্বাস করতেন না, বরং সমাজতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন।

ভাসানীর রাজনৈতিক পথচলার প্রসঙ্গ টেনে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে মওলানা ভাসানী কংগ্রেসে যুক্ত থাকলেও সেখানে পুঁজিপতির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তিনি দলটি ত্যাগ করেন।

পরবর্তীতে মুসলিম লীগে যোগ দেন এই প্রত্যাশায় যে দলটি কৃষক ও গরিব মানুষের কথা বলবে। তবে তার কল্পিত পাকিস্তান ছিল কায়েদে আজমের পুঁজিবাদী পাকিস্তানের বিপরীতে একটি গণতান্ত্রিক ও মুক্তির পাকিস্তান।

তিনি বলেন, ভাসানীর স্বপ্নের পাকিস্তানে একাধিক জাতিসত্তার সমান অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করা হবে এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে। এই দর্শনের প্রতিফলন দেখা যায় তার ঘোষিত ২১ দফা, ১৪ দফা ও ১১ দফা কর্মসূচিতে, যেখানে নদী, পানি ও বন্যা সমস্যার মতো সাধারণ মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়গুলো বিশেষ গুরুত্ব পায়।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, ভাসানী পাকিস্তানকে বিভিন্ন জাতিসত্তার কারাগার হিসেবে দেখতেন। তিনি শুধু বাঙালির নয়- পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচ ও পাঠানসহ সব জাতিসত্তার মুক্তির কথা বলেছেন। এই কারণেই তাকে কোনো নির্দিষ্ট পরিচয়ে সীমাবদ্ধ না রেখে একজন সমাজ বিপ্লবী হিসেবেই মূল্যায়ন করা উচিত- যিনি জনগণের ক্ষমতায় বিশ্বাস রেখে আজীবন মুক্তির স্বপ্ন লালন করেছেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেন, মওলানা ভাসানী কেবল একজন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না; তিনি ছিলেন একটি নৈতিক কণ্ঠস্বর ও বিবেক। তিনি বিশ্বাস করতেন ধর্ম মানুষের নৈতিক শক্তির উৎস হতে পারে। তবে রাষ্ট্র পরিচালনায় নাগরিক অধিকার, সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদাই হওয়া উচিত মূল ভিত্তি।

তিনি বলেন, এই দৃষ্টিভঙ্গিই ভাসানীকে তার সময়ের অন্যান্য নেতাদের থেকে আলাদা করেছে এবং আজকের বাংলাদেশের জন্যও তা একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার জায়গা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

ভাসানী ক্ষমতার রাজনীতির চেয়ে জনতার রাজনীতিকে বেশি গুরুত্ব দিতেন উল্লেখ করে উপদেষ্টা আরও বলেন, ভাসানী উপলব্ধি করেছিলেন যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা তখনই অর্থবহ হয়, যখন তা মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, সাংস্কৃতিক মর্যাদা এবং আত্মসম্মান রক্ষা করতে পারে। এই নীতিগত অবস্থান থেকেই তিনি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থার ভেতরের বৈষম্য ও অবিচার চিহ্নিত করতে সক্ষম হন।

মওলানা ভাসানীকে বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার প্রতীক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভাসানী ক্ষমতার প্রশ্নে কোনো আপোষ করেননি। এই চেতনা থেকেই আমরা শিখি—বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় হতে হবে এমন জায়গা, যেখানে বিতর্ক নিরাপদ, ভিন্ন মত প্রকাশ সম্ভব এবং সত্য বলার সাহসকে উৎসাহিত করা হয়। যে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রশ্নকে ভয় পায়, সে ব্যবস্থা কখনো ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে পারে না।

সম্মেলনের মূল প্রবন্ধে সহযোগী অধ্যাপক ড. ইফতেখার ইকবাল বলেন, মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক জীবন ও চিন্তাধারাকে বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের এখনো অনেক কাজ বাকি রয়েছে। আমরা যত বেশি ভাসানীকে শুনবো ও পাঠ করবো, তা আমাদের সমাজ ও রাজনীতির জন্য ততই ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।

তিনি ভাসানীকে নিয়ে রচিত লেখাগুলো একত্রিত করা এবং তাকে কেন্দ্র করে একটি গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন।

স্বাগত বক্তব্যে কারাস-এর পরিচালক অধ্যাপক ড. আশফাক হোসেন বলেন, মওলানা ভাসানী ছিলেন এশিয়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে অন্যতম অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ নেতা।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে দুপুর ১২টায় প্রতিকৃতি আলোকচিত্রী ও লেখক নাসির আলী মামুনের একটি বিশেষ আলোকচিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এরপর মওলানা ভাসানীকে নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...