উচ্চশিক্ষা বিস্তারের পথিকৃৎ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ

এম হাসান, কুমিল্লা
প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২৫, ০৫: ১২

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ। দক্ষিণ-পূর্ববাংলার ঐতিহ্যবাহী শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই অঞ্চলে উচ্চশিক্ষা বিস্তারে প্রথিকৃতের ভূমিকা পালন করছে বিদ্যা নিকেতনটি। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানভিত্তিক ও প্রগতিশীল শিক্ষা বিস্তারে এটির অবদান অসীম। বর্তমানে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করলেও পাঠদানে নিয়োজিত মাত্র ১৭০ জন শিক্ষক। নিয়ম অনুযায়ী ৩২০ জন শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও স্বল্পসংখ্যক শিক্ষক দিয়ে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। এতে চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষার মান।

বিজ্ঞাপন

কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা

মহান মুক্তিযুদ্ধে ভিক্টোরিয়া কলেজের ৩৩৪ জন ছাত্র অংশ নেন। তাদের মধ্যে ৩৫ জন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে এ কলেজের শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। কলেজের কৃতী শিক্ষার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রতিষ্ঠার মহানায়ক।

বাঙালি সাহিত্যিক ও প্রকাশক ফরিদ উদ্দিন খাঁ, বাংলা ও হিন্দি গানের কিংবদন্তি সংগীত পরিচালক, সুরকার, গায়ক ও লোকসংগীত শিল্পী শচীন দেববর্মণ, শিক্ষাবিদ ও শহীদ বুদ্ধিজীবী শরাফত আলী, সাহিত্যিক জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর মতো বরেণ্য ব্যক্তিত্ব।

এছাড়াও আছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নেতা ও ভাইস চেয়ারম্যান বিএনপি আব্দুল আউয়াল মিন্টু, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ ও সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, বাংলাদেশের ২২তম প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, ইসলাম প্রচারক ও পূর্ববঙ্গের আইনসভা সদস্য আবদুল খালেক, সংগীতশিল্পী ও অভিনেতা আসিফ আকবর, চিকিৎসক ও শিল্পপতি নরেন্দ্রনাথ দত্তসহ প্রমুখ।

প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

আজ থেকে ১২৫ বছর আগে এই কলেজের গোড়াপত্তন হয়। কলেজটির নামকরণ করা হয়েছে ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞী রানী ভিক্টোরিয়ার নামে। ১৮৮৮ সালে মহারানী ভিক্টোরিয়ার ‘জুবিলি জয়ন্তী’ স্মরণে ‘ভিক্টোরিয়া স্কুল’ হিসেবে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে ১৮৯৯ সালে‌ রায় বাহাদুর আনন্দ চন্দ্র রায় এই স্কুলটিকে কলেজে উন্নীত করেন এবং এর নামকরণ করেন ‘ভিক্টোরিয়া কলেজ’।

অবিভক্ত কুমিল্লা জেলা তথা চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এটি। কুমিল্লার সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী ও জমিদার রায় বাহাদুর আনন্দচন্দ্র রায় ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। কলেজটি প্রতিষ্ঠার পর ব্রিটিশ ভারতীয় সরকার তাকে রায় বাহাদুর উপাধি দেয়। তার স্মৃতি রক্ষার্থে ভিক্টোরিয়া কলেজের ফটকে শ্বেতপাথর দিয়ে তার একটি আবক্ষ ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়।

জানা যায়, আনন্দচন্দ্র রায় ঠিকাদারি ব্যবসা ও জমিদারি থেকে প্রভূত সম্পত্তি আয় করেন এবং সেই আয়ের অর্থায়নে ১৮৮৬ সালে কুমিল্লায় ‘রায় এন্ট্রান্স স্কুল’ নামে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় কলেজটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ হিসেবেও তালিকাভুক্ত হয়। ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে কলেজের স্নাতক শাখার অধিভুক্তি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অর্পিত হয়।

সুযোগ-সুবিধা

বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি উচ্চ মাধ্যমিক শাখা ও ডিগ্রি শাখা নামে দুটি শাখায় বিভক্ত। উচ্চ মাধ্যমিক শাখাটি কুমিল্লা কান্দিরপাড় এবং ডিগ্রি শাখাটি কুমিল্লা ধর্মপুর এলাকায় অবস্থিত। ১৮৯৯ সাল থেকে শুরু হওয়া এই প্রতিষ্ঠানে এখন পর্যন্ত ৫৬ জন অধ্যক্ষ দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে কলেজে ২২টি বিভাগে ২৫টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু আছে। এগুলোর প্রায় প্রত্যেকটি বিষয়ে চালু আছে মাস্টার্স কোর্স। শিক্ষার্থীদের আবাসনের জন্য রয়েছে তিনটি ছাত্রাবাস— কবি কাজী নজরুল হল, সোহরাওয়ার্দী হল, ইসলামি হল এবং তিনটি ছাত্রীনিবাস— নওয়াব ফয়জুন্নেসা হল, শেরে বাংলা হল ও রবীন্দ্র হল।

সহশিক্ষা কার্যক্রম

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশে রয়েছে বিএনসিসি (সেনা), বিএনসিসি (বিমান), রেড ক্রিসেন্ট, ভিক্টোরিয়া কলেজ বিতর্ক পরিষদ, ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটার, রোভার স্কাউট, ক্যাম্পাস বার্তা, রক্তদাতা সংগঠন বাঁধন, বাংলা সাহিত্য পরিষদ, পদার্থবিজ্ঞান সমিতি, রসায়ন সমিতি, বোটানি সোসাইটি, ম্যাথ অ্যাসোসিয়েশন, ক্যারিয়ার ক্লাব ও বিজ্ঞান ক্লাব, ভিক্টোরিয়া কলেজ সাংবাদিক সমিতি-কুভিকসাস।

কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা যা বললেন

১৯৬৫ ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থী বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, ছড়াকার, কবি ও কুমিল্লা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জহিরুল হক দুলাল বলেন, ষাটের দশকে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ার জন্য দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শিক্ষার্থীরা আসত। তখনকার সময়ে যারা এই কলেজের অধ্যক্ষ হতেন তারা হতেন দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ। যেমন বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খাঁন। তখনকার সময় প্রতি বছরই ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো।

কলেজের জলাবদ্ধতা বিষয়ে তিনি বলেন, যখন ডিগ্রি শাখার ভবনগুলো করা হয় তখন জমির ওপরে করা হয়েছিল। তখন ওই স্থানগুলোতে পানি উঠত না। এখন তো পুরো কুমিল্লা শহর জুড়েই জলাবদ্ধতা। এগুলোর বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি দেওয়া উচিত।

সাবেক শিক্ষার্থী সাংবাদিক খালেদ সাইফুল্লাহ বলেন, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ, শতবর্ষী প্রাণের বিদ্যাপীঠ, ঐতিহ্য ও গৌরবে সমুন্নত। মুক্তিযুদ্ধ, জুলাই গণঅভ্যুত্থানসহ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এমনকি বন্যাসহ জাতির যে কোনো প্রয়োজনে কলেজের শিক্ষার্থীদের সাহসী ভূমিকা সব সময় প্রশংসিত হয়েছে।

তবে শ্রেণিকক্ষ সংকট, লাইব্রেরিতে পর্যাপ্ত বইয়ের অভাব, ক্যাম্পাসে জলাবদ্ধতা এবং ছাত্রাবাসের জরাজীর্ণ অবস্থা বড় চ্যালেঞ্জ। কান্দিরপাড়ে উচ্চ মাধ্যমিক ও ধর্মপুরে ডিগ্রি-পোস্ট গ্র্যাজুয়েটের পৃথক ক্যাম্পাস থাকলেও অবকাঠামো উন্নয়ন জরুরি বলে তিনি জানান।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব প্রাক্তন শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সাইফুল হাসান বলেন, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ঐতিহ্যের দীপ্ত প্রতীক। আমি ১৯৯৫ সালে এই কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করি এবং কুমিল্লা বোর্ডে বাণিজ্য বিভাগে সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করি। এই প্রতিষ্ঠান আমার জীবনের ভিত্তি নির্মাণে অসামান্য ভূমিকা রেখেছে।

সাবেক শিক্ষার্থী কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ ডা. আরিফ মোর্শেদ খান বলেন, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ আমাদের প্রাণের প্রতিষ্ঠান, গৌরবের প্রতিষ্ঠান। ষাটের দশকে আমার মা এই কলেজে মহিলাবিষয়ক সম্পাদক হয়েছিলেন। এটা আমাদের জন্য খুবই গৌরবের একটা বিষয় ছিল।

কলেজের অধ্যক্ষের বক্তব্য

কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আবুল বাশার ভূ্ঞা বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর জনতার বিক্ষুব্ধ অবস্থা এবং পানির মধ্যে আমি এই কলেজে যোগদান করেছি। ধর্মপুর এলাকার ডিগ্রি কলেজ শাখায় আশপাশের ভবনগুলো উঁচু হয়ে যাওয়াতে ভিক্টোরিয়া কলেজে সব সময় জলাবদ্ধতা থাকে। এখন প্রয়োজন বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসটিকে উঁচু করা। এছাড়া পাঠদান ও ক্লাস পরীক্ষা নিতে সমস্যার কথা জানান তিনি।

তিনি আরো বলেন, শিক্ষকের চাহিদার তুলনায় অর্ধেক শিক্ষক দিয়েই পাঠদান চলছে। শিক্ষকের ঘাটতির কারণে পাঠদান চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ৩২০ জন শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র ১৭০ জন।

তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে পর্যাপ্তসংখ্যক বাস নেই। ছাত্রদের কাছ থেকে যেই টাকা নেই সেই টাকা দিয়ে বাস সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। আরো চার-পাঁচটি বাস পেলে শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনেকটা পূরণ হতো। বাস থাকলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেধাবীরা এখানে আসতে পারত। কলেজটি অনেক দিন ধরে অবহেলিত রয়েছে। শতবর্ষী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই কলেজটি উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত