ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি ইস্যুতে নতুন অস্থিরতায় সাত কলেজ

রকীবুল হক
প্রকাশ : ০১ অক্টোবর ২০২৫, ১০: ১২

রাজধানীর সাত কলেজ নিয়ে জটিলতা যেন কাটছেই না। শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) থেকে অধিভুক্তি বাতিল করে এই সাত কলেজ নিয়ে নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় করার উদ্যোগ নেয় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) মাধ্যমে সব কলেজ প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে দফায় দফায় মিটিং ও মতামত নিয়ে ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয় কার্যক্রম চালাচ্ছে সরকার।

বিজ্ঞাপন

বিশ্ববিদ্যালয়টির খসড়া প্রকাশ করে মতামত নিচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাঠামোসহ খসড়ার নানা বিষয় নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক চলছে সংশ্লিষ্ট মহলে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নানা শঙ্কা, দাবি আর আন্দোলন, হুঁশিয়ারি—এসবের কারণে নতুন করে অস্থির হয়ে উঠেছে রাজধানীর সাত কলেজ।

সূত্রমতে, প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন সাত কলেজে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকরা। কলেজগুলোর স্বাতন্ত্র্য হারানো, নারী শিক্ষার সুযোগ সংকোচনসহ নানা আশঙ্কার কথা বলে এই প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করছেন তারা। একই ধরনের অভিযোগে আন্দোলনে নেমেছে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। আর এসব আন্দোলনের পেছনে মূলত আওয়ামীপন্থি শিক্ষকরা মূল ভূমিকা রাখছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রোভিসি, রেজিস্ট্রারসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের বিষয়ে আগেই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।

তবে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় দ্রুত বাস্তবায়নের পক্ষেও শক্ত অবস্থানে আছেন অনেকে। এ ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে— শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ প্রক্রিয়া আর সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করেই বিশ্ববিদ্যালয়টির খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। এতে কোনো বিষয়ে আপত্তি থাকলে মতামতের সুযোগ রয়েছে। এ নিয়ে অহেতুক বিতর্ক বা উত্তেজনা সৃষ্টি অযৌক্তিক।

সূত্র জানায়, গত ২৪ সেপ্টেম্বর অংশীজনের মতামত চেয়ে প্রস্তাবিত ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’র খসড়া অধ্যাদেশ প্রকাশ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব নাঈমা খন্দকার স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে খসড়া অধ্যাদেশ প্রকাশ করে সাত কর্মদিবসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ইমেইল অথবা সরাসরি মতামত দেওয়ার অনুরোধ করা হয়।

খসড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন সম্পর্কে বলা হয়— ঢাকা মহানগরের (ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজ) সাতটি কলেজের অবকাঠামো এবং ক্যাম্পাস স্থায়ীভাবে দিনের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য (দুপুর ১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা) ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি একাডেমিক ক্যাম্পাস থাকবে, অর্থাৎ সাতটি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি ক্যাম্পাস হিসেবে পরিচিত হবে। যেমন—ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি তিতুমীর কলেজ ক্যাম্পাস এবং ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি ইডেন মহিলা কলেজ ক্যাম্পাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন, শিক্ষার্থী-শিক্ষক কেন্দ্র, অডিটোরিয়াম ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র একটি স্বতন্ত্র স্থান হতে পরিচালিত হবে। এটা একটি ইন্টারডিসিপ্লিনারি বিশ্ববিদ্যালয় হবে।

খসড়ায় আরো বলা হয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত ঢাকা মহানগরের সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট ক্যাম্পাসের পরীক্ষাগারসহ অন্যান্য সমজাতীয় সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজনে শর্তসাপেক্ষে ব্যবহার করতে পারবেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ, জন্মস্থান বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন—সব শ্রেণির দেশি-বিদেশি উপযুক্ত শিক্ষার্থীর ভর্তি, জ্ঞানার্জন ও ডিগ্রি সমাপনের পর সনদ প্রাপ্তির জন্য উন্মুক্ত থাকবে।

বিশ্ববিদ্যালয়টিতে থাকবে চারটি স্কুল। সাতটি কলেজ ক্যাম্পাসকে চারটি স্কুল, যেমন—স্কুল অব সায়েন্সেস, স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ, স্কুল অব বিজনেস স্টাডিজ এবং স্কুল অব ল অ্যান্ড জাস্টিসে বিভক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে।

ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের কলেজগুলোর বিরাজমান পরিচয়, বৈশিষ্ট্য, অবকাঠামো ও অন্যান্য বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা অক্ষুণ্ণ থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদান পদ্ধতি হাইব্রিড পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে এবং সব পরীক্ষা সশরীরে হবে।

প্রস্তাবিত খসড়া প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক ও ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ২৪টি মিটিং করে একটি খসড়া জমা দিয়েছি। এখন পরবর্তী দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের।’ তিনি বলেন, কারো অভিমত থাকতেই পারে। এ জন্য সবার সুযোগ রয়েছে। এ নিয়ে অহেতুক অস্থিরতা ও বিরোধিতার যৌক্তিকতা নেই।

এক প্রশ্নের জবাবে ড. তানজীম উদ্দিন খান বলেন, প্রথম দুবছর মৌলিক সাবজেক্টগুলো পড়তে হবে। পরে অন্য সাবজেক্ট নিয়ে একাডেমিক কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে। এখানে ইসলামিক স্টাডিজ বা অন্য কোনো সাবজেক্ট পড়াতে বাধা নেই।

সূত্রমতে, সম্প্রতি সাত কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে আলাদাভাবে মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করে প্রকাশিত অধ্যাদেশের খসড়া নিয়ে সমালোচনা করা হয়। তারা প্রস্তাবিত কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না করে সাত কলেজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে অক্সফোর্ড মডেল বা অধিভুক্তির ক্ষমতাসম্পন্ন আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। এ ছাড়া ইডেন ও বেগম বদরুন্নেসার শিক্ষার্থীরা সহশিক্ষার সুযোগ রাখার বিরোধিতা করছেন।

যদিও গত ২৮ সেপ্টেম্বর শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর খোলা চিঠি দিয়েছেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের প্রতি নানাভাবে হয়রানি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে কর্মসূচি পালনে বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়।

চিঠিতে বলা হয়, সম্প্রতি সাত কলেজকে ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি (ডিসিইউ) করার পদক্ষেপকে কেন্দ্র করে কিছু বিসিএস ক্যাডার শিক্ষক প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করছেন। এই প্রতিবাদ কেবল মতামত দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না; বরং তারা আমাদের দৈনন্দিন শিক্ষাজীবনকেও প্রভাবিত করছেন। এসব কর্মকাণ্ড যেমন প্রজাতন্ত্রের একজন সরকারি কর্মচারীর আচরণবিধির নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, তেমনি আমাদের জন্য বিব্রতকর ও উদ্বেগের বিষয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, খসড়ার বিষয়ে প্রাপ্ত মতামত পর্যালোচনা এবং বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা করেই এটি চূড়ান্ত করা হবে। মতামত দেওয়ার সময় এক মাস বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন মহল থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে বলেও জানা গেছে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত